যে কারণে মরণযাত্রা by রোকনুজ্জামান পিয়াস

দীর্ঘ সময় ধরে স্থবির বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। নানা ইস্যুতে বন্ধ হয়ে গেছে প্রধান প্রধান বাজার। বাংলাদেশের কর্মীদের এ শূন্যতা পূরণ করছে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বিকল্প বাজারের কথা বলা হলেও সেসব দেশে কর্মীর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত তেমন কোন অগ্রগতি নেই। কোনও কোনও দেশে বছরে সর্বোচ্চ ২০ জন কর্মী পাঠানো হয়েছে। বৈধপথ সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ায় অবৈধ পথ অবলম্বন করার প্রবণতাও বাড়ছে বিদেশ গমনেচ্ছুদের। দালালের খপ্পরে পড়ে বেছে নিচ্ছেন ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথ। এদিকে শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হওয়াকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার ধসে সরকার নির্ধারিত ভুলনীতিরও সমালোচনা করেন তারা। তাদের মতে- এখনই সময় মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে জি টু জি পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়নের। এ পদ্ধতিতে মাইগ্রেশন খরচ কমলেও দেশটিতে বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ একই সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক কর্মী যাচ্ছে সেদেশে। গতবছর শুধু নেপাল থেকে দেশটিতে কর্মী গেছে এক লাখ। যেখানে বাংলাদেশ থেকে গেছে মাত্র তিন হাজারের মতো। বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া। ২০০৮ সাল থেকে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। আর মালয়েশিয়া সরকার ২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশী শ্রমশক্তি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে এ তিনটি দেশে গত বছর বৈধভাবে গেছেন ৩৮ হাজার ৭৬৩ জন কর্মী। অথচ ২০০৭ সালে দেশ তিনটিতে বৈধ পথে গিয়েছিলেন ৭ লাখ তিন হাজার ৭০৫ জন। ২০০৮ সালে যান ৬ লাখ ৮৩ হাজার ২৪১ জন। যদিও বিএমইটির তথ্যে গোঁজামিলের অভিযোগ রয়েছে। নতুনের পাশাপাশি পুরনো শ্রমিক যারা ছুটিতে দেশে এসে আবার যান তাদের আলাদা কোন পরিসংখ্যান নেই। ২০০৭ সালের পরেই ধস নামে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বাজারে। ২০১৩ সালে ধস নামে আরব আমিরাতের বাজারেও। গত সাত বছরে এই তিন দেশে জনশক্তি রফতানি কমেছে ৯৫ শতাংশ। গত বছর মালয়েশিয়ায়  গেছেন মাত্র তিন হাজার ৮৭৪ জন। ২০১৩ সালে সংখ্যাটি ছিল মাত্র তিন হাজার ৮৫৩। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার কুয়েত, আবুধাবীতে। নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে লিবিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে কর্মী নিয়োগ একপ্রকার বন্ধ।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে বিদেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মী গেছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। সরকারি হিসেবে সে সময় কর্মী গেছে ১৭ লাখ ৭ হাজার ৬৬৪ জন। তবে ওই সময় যাওয়া কর্মীদের একটি বড় অংশ বিভিন্নভাবে ভোগান্তিরও স্বীকার হয়েছেন। এরপরের বছর ২০০৯ সালে গেছে প্রায় অর্ধেক। ২০১০ সালে এ সংখ্যা আরও কম, মাত্র ৩ লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জন। পরের বছরগুলোতে কর্মী নিয়োগ বাড়লেও ২০১৩ সাল থেকে আবারও ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করেছে। ২০১১ সালে কর্মী গেছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬২ জন এবং ২০১২ সালে গেছে ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন। ২০১৩ সালে বিদেশে কর্মী নিয়োগ হয়েছে ৪ লাখ ৯২৫৩ জন। ২০১৪ সালে বহির্গমনের পরিমাণ ৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৪ জন। আর এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গেছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬১ জন। তবে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার জনশক্তি রপ্তানি থেমে নেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার। বাংলাদেশের শ্রমবাজার অনেকাংশেই দখল করেছে তারা। সরকারের তৈরী ১৯ লাখ ৫০ হাজার ডাটাবেজের মধ্য থেকে কর্মী পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। তবে ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ওই ডাটাবেজ তৈরী হলেও এর মধ্য থেকে কতজন কর্মী বিদেশ গেছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। এদিকে কর্মী পাঠানোর এ ধীরগতির ফলে সুযোগ নিচ্ছে এক ধরনের দালাল শ্রেণী। তাদের প্রলোভনে পড়ে বিদেশ গমনে অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছে সহজ-সরল মানুষ। শ্রমবাজারের বিশাল এ শূন্যতা পূরণ করতে বিকল্প কয়েকটি দেশে বাজার খোঁজা হলেও তা খুবই নগণ্য। রামরুর তথ্যমতে, শুধু নেপাল থেকেই গতবছর মালয়েশিয়ায় গেছে ১ লাখ কর্মী। সেখানে বাংলাদেশ থেকে গেছে ৩ হাজার ৮৭৪ জন। বন্ধ শ্রমবাজার চালু হওয়ার পর দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের দেশের পক্ষ থেকেই জি টু জি পদ্ধতি চালু করা হয়। অভিযোগ রয়েছে অত্যন্ত ধীরগতির এ পদ্ধতির প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকেই দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া ইতিমধ্যে জি টু জি পদ্ধতির নানা ত্রুটিও ধরা পড়েছে। মালয়েশিয়ার একটি মানবাধিকার সংস্থা ‘তেনাগানিতা’ এ পদ্ধতির কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছে। তারা বলেছে, সেদেশের সরকারী কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থও নেয়। তারা বলেছে, এর আগে মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহ দেখাতো। এ ছাড়া জি টু জি পদ্ধতির ফলে সাগর পথে অবৈধ অভিবাসনকে উৎসাহিত করছে। এই পরিস্থিতিতে এ পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে বারবার বলা হয় প্রবাসী কল্যাণ ও জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে বিকল্প শ্রমবাজার সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়, বর্তমান বিশ্বে ১৫৯টি কর্মী পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ওইসব দেশে কর্মী পাঠানোর হার এখনও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। বিএমইটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর নির্দিষ্ট ২০টি দেশের বাইরে বাকি অন্যান্য দেশে পাঠানো কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১১ হাজার ৬৯০ জন।
এদিকে বৈধপথে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ায় সম্প্রতিক সময়ে কাজের সন্ধানে অবৈধ উপায়ে দেশের সীমান্ত পাড়ি দেয়ার হার বেড়ে গেছে। আর এ কারণে সমুদ্রপথে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। ইউএনএইচসিআর-এর তথ্যমতে, গত বছর জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ৮৭ হাজার মানুষ সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া গেছে। যা পূর্ববর্তী ২০১৩ সালের তুলনায় ৬১ ভাগ বেশি। ২০১৪ সালে সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছেন ৫৪০ জন।  
এ ব্যাপারে ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ফারুক আহমেদ বলেন, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বৈধ উপায়ে কর্মী যেতে না পারায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছে। তিনি বলেন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল মালয়েশিয়ায় ৫ লাখ কর্মী যাবে। সেখানে সে চাহিদা রয়েছে। জি টু জি পদ্ধতির মাধ্যমে কম খরচে লোক যাবে। কিন্তু এ পর্যন্ত যে সংখ্যক লোক এ পদ্ধতিতে গেলেও তা খুবই নগন্য। ফলে মানুষ চাহিদা মেটাতে এবং বৈধপথে সুযোগ না পেয়ে দালালের খপ্পরে পড়ছে। তিনি বলেন, মানবপাচার বা সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে নদীপথ স্বশস্ত্র বাহিনীর অধীনে দেয়ার পরামর্শ দেন। তার মতে অন্যান্য যে কোন বাহিনীর তুলনায় এই বাহিনী বেশি তৎপর। তাদেরকে সকল ধরনের ইকুপমেন্ট দিয়ে দায়িত্ব দিলে মানবপাচার বন্ধ করা সম্ভব হবে। ফারুক আহমেদ বলেন, যারা মানবপাচারের হোতা তাদের মেরে না ফেলে, যদি সম্ভব হয় তাহলে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এর পেছনের রাঘব বোয়ালরা বের হতো। কয়েকদিন ধরে সাগরে ভাসমান মানুষের ব্যাপারে তিনি বলেন আমাদের সরকার আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা চাইতে পারতো। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশীদের চিহ্নিত করে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করতো।
অভিবাসী নিয়ে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান রামরু’র ফেলো মো. আনসার উদ্দিন আনাস বলেন, সমুদ্রপথে মানবপাচারের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা ৮০ ভাগ দায়ী। বর্তমান রুটটি তাদের মাধ্যমেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।  রোহিঙ্গাদের বিষয়টি যদি ভালভাবে পরিচালনা করা যেত তবে আজকে এ অবস্থা হতো না। শুরুতে রোহিঙ্গাদের রিফিউজি স্ট্যাটাস দিয়ে যদি এখানে বাস করার সুযোগ দেয়া হতো তাহলে ওই রুটটিও আবিষ্কার হতো না। তিনি বলেন, বর্তমান যারা সাগরপথে যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য মালয়েশিয়া। তবে থাইল্যান্ডের ফিশিং ট্রলারে কাজ করতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া বেসরকারিভাবে ছেড়ে দিলে বৈধভাবে কর্মী পাঠানোর পরিমাণ বাড়তো।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম’র ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার আসিফ মুনির বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে পাচারকারীদের ভেতরে ভয়ভীতি কাজ করে। তারা গা-ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু সমুদ্রপথে অনেকগুলো রুট রয়েছে, সবগুলো রুট বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ রুটগুলো বন্ধ করতে না পারলে কখনও মানবপাচার পুরোপুরি বন্ধ হবে না। তাছাড়া দালালচক্র এদের বলে, টাকা পরে দিতে হবে, ফলে এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে হাতছাড়া করতে চান না প্রতারিত মানুষ। আবার অনেকে মনে করেন এখন যেহেতু ডাটাবেজের বাইরে কেউ যেতে পারবে না তাই সমুদ্রপথই সহজ উপায়। মানুষকে সচেতন করার জন্য এখনও যথেষ্ট প্রচারণা চালানো হয়নি বলে তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.