অভিবাসীদের বাঁচার আকুতি by টিপু সুলতান

শেখ আমানউল্লাহ (২০)। বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। কেমন আছেন? প্রশ্ন করতেই শার্টের বোতাম খুলে হাড্ডিসার শরীর দেখালেন। তারপর ডুকরে কান্না। একটু পর বললেন, ‘আসার সময় আমার ওজন ছিল ৯০ কেজি, এখন ৬৫।’
এই আমানউল্লাহ থাইল্যান্ডের সঙ্খলা প্রদেশের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো শহর হাতজ্জাইয়ে পুলিশ হেফাজতে আছেন পাঁচ সপ্তাহ ধরে। তাঁর সঙ্গে আছেন আরও ১২ বাংলাদেশি। সবার বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। অবৈধভাবে থাইল্যান্ড যাওয়ায় এক বছর সাত মাস জেল খেটেছেন তাঁরা। সাজার মেয়াদ শেষে তাঁদের জায়গা হয়েছে থানায়। তাঁরা সবাই দেশে ফেরার আকুতি জানালেন। এঁদের সঙ্গে থাকা অন্য দুজন কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
সম্প্রতি সাগরপথে মানব পাচারের বিষয়টি বেশ আলোচিত হলেও এই তরুণদের কাছেই জানা গেল, দালালেরা শুধু সাগরপথে নয়, আকাশপথেও মানুষ পাচার করছে। যার শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের নাগরিক ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানেরা। গত নয় দিনেই থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে অন্তত তিন হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা উদ্ধার হয়েছেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বলছে, আরও ছয় থেকে আট হাজার অভিবাসী সাগরে নৌকায় ভাসছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সাগরে ভাসতে থাকা অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতি আহ্বান জানালেও দেশগুলো তাঁদের তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না। সেখানে খাবার ও পানির অভাবে অভিবাসী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
মানব পাচারের এ পরিস্থিতিতে হাতজ্জাই পুলিশ স্টেশনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ওই ১২ তরুণের। বাংলাদেশি বন্দীদের ডাকতেই প্রথমে আসেন আমানউল্লাহ। পরে এলেন গোলাম রসুল, মনিরুল ইসলাম, মাসুদ রানা, রেজাউল করিম, ইকবাল, আল-আমিন, শিমুল, রুবেল, তরিকুল, রাসেল ও নজরুল। শেষ দুজন ছাড়া বাকিদের বাড়ি যশোরের মণিরামপুর ও ঝিকরগাছা উপজেলায়। রাসেলের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ ও নজরুলের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরায়। এঁদের সঙ্গে সেলিম ও উজ্জ্বল প্রামাণিক ছিলেন। একজন ৭ ডিসেম্বর, আরেকজন ২৫ ডিসেম্বর কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
১৪ বছরের বাংলাদেশি কিশোর আফসারুদ্দিন। গতকাল ফোনে দেশে মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। কয়েক সপ্তাহ ধরে নৌকায় সাগরে ভাসার পর অনেকের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে উদ্ধার হয় ছেলেটি। এখন তার আশ্রয় মিলেছে আচেহ প্রদেশের একটি শিবিরে l ছবি: এএফপি
ঝুঁকি নিয়ে এ পথে কেন পা বাড়ালেন? রাসেল বললেন, ‘আমরা তো জানতাম না থাইল্যান্ড আসব। আমরা তো মালয়েশিয়া যাব স্টুডেন্ট ভিসায়। সেভাবে দালাল বলেছে।’ একই কথা জানালেন অন্যরাও। দালালের খপ্পরে পড়লেন কীভাবে? আমানউল্লাহর উত্তর, ‘আমি এইচএসসি পাস করেছি। বাবলু দালাল বলল, আর লেখাপড়া করে কী হবি? মামা-চাচা না থাকলে তো চাকরি পাবি না। তার চেয়ে মালয়েশিয়া চল স্টুডেন্ট ভিসায়। ইনকাম করবি, ভালো থাকবি, চাইলে লেখাপড়াও করতি পারবি।’ এক কথায়ই রাজি হয়ে গেলেন? ‘না, অনেক ভেবেছি। বাবলু বলল, টাকা-পয়সা আগাম লাগবে না, মালয়েশিয়া পৌঁছার পর ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিতে হবে। বৈধ ভিসা। কোনো ঝুঁকি নাই। তা ছাড়া বাবলুর বাড়ি মণিরামপুরে। বিদেশে লোক পাঠায়। সবাই চেনে।’
আমানউল্লাহ জানালেন, তারপর তাঁকে একদিন ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে বলা হলো, থাইল্যান্ড হয়ে তার পর মালয়েশিয়া পাঠানো হবে। তিন প্রতিবাদ করেছিলেন, ‘আমি এভাবে যাব না, বিপদ হতে পারে।’ তখন বাবলু দালাল তাঁকে বলে, ‘ইন্ডিয়ার গরু কীভাবে পার হয় জানো? বর্ডার পার হয়ে একবার গরুর গায়ে সিল মেরে দিলে, তাকে কোনো পুলিশ ধরে না। তোমার পাসপোর্টেও একবার সিল পড়লে, তোমারে আর কেউ ধরবে না। আর, বিপদে পড়লে আমি তো আছিই।’
আমানউল্লাহ জানালেন, তাঁদের নয়জনকে নিয়ে দালাল চক্রের এক লোক ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়ে রওনা হন ঢাকা থেকে। প্রথমে শ্রীলঙ্কা যান, তারপর ব্যাংকক হয়ে কম্বোডিয়া। সেখান থেকে লাওস। তারপর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাসে ব্যাংকক আসেন। সেখান থেকে ট্রেনে আসেন হাতজ্জাই। এখানে হাতবদল, নতুন দালাল তাদের দায়িত্ব নেয়। রওনা হন সাদাও জেলার জঙ্গলে মানবপাচারকারীদের কথিত ক্যাম্পের দিকে। পথে পুলিশের হাতে আটক হন তাঁরা।
একই সপ্তাহে থাইল্যান্ডে আসেন মনিরুলসহ তিনজন। তাঁরা অবশ্য প্রথমে বিমানে ব্যাংকক হয়ে কম্পোডিয়া যান। তারপর লাওস। লাওস থেকে আবার বিমানে ব্যাংককে ট্রানজিট ভিসায় তাঁদের নামায় দালালের লোকেরা। তাঁর মনে হয়েছে, দালালদের সঙ্গে ব্যাংকক বিমানবন্দরে অভিবাসন পুলিশের আর্থিক লেনদেন হয়েছে। যেমনটা হয়েছে, ঢাকায় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে।
এই ১২ জনের সবাই জানালেন, ঢাকা বিমানবন্দরে মহিউদ্দিন নামের একজন ইমিগ্রেশন পুলিশের কর্মকর্তা তাঁদের আলাদাভাবে আনুষ্ঠানিকতা করে পার করে দিয়েছিলেন। ওই কর্মকর্তাকে জনপ্রতি নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয়েছে বলে দালালেরা তাঁদের জানিয়েছে।
মনিরুলদের ব্যাংকক থেকে বিমানে আনা হয় হাতজ্জাই। সেখান থেকে গাড়িতে মালয়েশিয়া সীমান্তের ক্যাম্পে নেওয়ার পথে পুলিশ আটক করে। এঁরা আসেন মুকুল নামে মানব পাচারকারী এক দালালের মাধ্যমে। যার বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়।
মনিরুল জানালেন, মুকুল ও বাবলু দুজনই ঢাকার শামীম নামের এক আদম ব্যাপারীর দালাল হিসেবে লোক জোগাড় করেন। গ্রাম থেকে লোক এনে কমলাপুর বাজার রোডের গাংচিল হোটেল রাখে। ওই হোটেলে এমন অনেককে দেখেছেন তাঁরা।
দালাল চক্রের প্রলোভনে পড়া বন্দী হওয়া এই তরুণদের সবার কাহিনি প্রায় একই। এঁদের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, সাইয়াক নামে স্থানীয় একজন ব্যক্তি তখন উপস্থিত হন। যিনি পুলিশের দোভাষী হিসেবে কাজ করেন মিয়ানমারের নাগরিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়। সাইয়াক জানালেন, আকাশপথে যাদের আনা হয়, তাদেরও রাখা হয় জঙ্গলের বিভিন্ন ক্যাম্পে। তারপর সেখানে নির্যাতন করে বাড়িতে ফোন করানো হয়। টাকা আদায় করা হয়। এ ক্ষেত্রে মুক্তিপণের টাকা বেশি দিতে হয়।
১২ তরুণের বাইরে আরও দুই বাংলাদেশি সম্পর্কে কিছু জানা গেল। তাঁরা হলেন, সাতক্ষীরার রবিউল (এখানকার কাগজে নাম সাজু আজহার) ও বগুড়ার মাসুদ পারভেজ। তাঁদের জাল পাসপোর্টে সিঙ্গাপুর হয়ে ট্রানজিট ভিসায় থাইল্যান্ড আনা হয়। তারপর জঙ্গল ক্যাম্পে নিতে চাইলে তাঁরা মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। এরপর দালালের লোকেরাই তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। তাঁদের তিন বছরের সাজা হয়েছে। এখন হাতজ্জাই কারাগারে আছেন।
হাতজ্জাইয়ের পুলিশ জানায়, ওই ১২ তরুণের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা নেই—আদালত থেকে এমন ছাড়পত্র আসার পর তাঁদের পাঠানো হবে মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী এলাকা পাদাং বেশারে অবস্থিত ইমিগ্রেশন ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেখান থেকে পরে দেশে ফেরত পাঠানোর বাকি আনুষ্ঠানিকতা। তবে তদবির না করলে আদালতের ছাড়পত্র কত দিনে আসবে, তার ঠিক নেই বলে জানালেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, দূতাবাস থেকে তদবির না করলে অনেক সময় এক বছরেও কাগজ আসে না। ওই কর্মকর্তা জানালেন, বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে অসংখ্য বাংলাদেশি আটক আছে।
এ সময় লোহার শিকের ওপার থেকে মনিরুল বলেন, তাঁরা কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসে এ পর্যন্ত ১০টি চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু কেউ তাঁদের খোঁজ করতে আসেনি। তিনি বলেন, ‘জেলখানার দেয়ালে দাগ কেটে কেটে হিসাব রেখেছি এক মাস, দুই মাস, চার মাস, বছর চলে যায়, কেউ আসে না।’
এঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী নজরুল (১৮)। এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি, নীরবে কাঁদছিলেন। হাত জোড় করে বললেন, ‘ভাই আপনি যাইয়েন না, আমাদের নিয়া যান। এখানে না খেয়ে মরছি।’
জানা গেল, দুপুর দুটোয় ও সন্ধ্যায় ছোট এক বাটি ভাত ও একটা তরকারি দেওয়া হয় তাঁদের। প্রায় শূকরের মাংস থাকে তরকারিতে, তাঁরা তা খান না। খালি ভাত খান। আর টেপের পানি খেয়ে বাঁচছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন মুখপাত্র জানান, সাজা শেষ হলে, এদের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর পর থাই কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানায়। এরপর সঙ্গে সঙ্গে দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে নাম-ঠিকানা ঢাকায় পাঠায়। এরা বাংলাদেশের নাগরিক—এ মর্মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র আসার পর যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হয়।
এই মুখপাত্র জানান, এই ১২ তরুণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দূতাবাসকে থাই কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য দেয়নি। তবে দুজনের মৃত্যু সংবাদ ও তাঁদের হাতজ্জাইতে কবর দেওয়ার খবর পেয়েছেন।
দেশে ফেরার আকুতি: এক ঘণ্টা সময় পাওয়া গেছে কথা বলার জন্য। এর মধ্যে কথার চেয়ে কান্না আর ফেরার আকুতিই ছিল বেশি ১২ তরুণের। ফেরার সময় গরাদের শিকের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে এ প্রতিবেদকের জামা টেনে ধরলেন আমানউল্লাহ। বললেন, ‘আমরা বাঁচতে চাই। বাংলাদেশ সরকারকে বলেন, আমাদের যাতে নিয়ে যায়। দেশে গিয়ে বলব, আর যেন কেউ এ পথে না আসে।’

No comments

Powered by Blogger.