‘মেম’ নয়, মা-তেই মন জয় by উজ্জ্বল মেহেদী

চা–পাতা চয়নে হাতেকলমে শিক্ষা দিচ্ছেন সৈয়দ গুলশানারা।
জুলেখানগর চা–বাগান থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো
একে তো দুর্গম এলাকা, তার ওপর আবার শ্রমিক অসন্তোষ। এ দুইয়ে মিলে বেহাল দশা ছিল চা-বাগানটির। বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সিদ্ধান্ত হয় বিক্রির। তিনি মালিকপক্ষের হয়ে চা-বাগান শেষবারের মতো দেখতে গেলেন। কাহিনির শুরুটা সেখান থেকেই।
চা-বাগানে মালিকপক্ষের যেকোনো পুরুষ সদস্যকে ‘সাহেব’ আর নারীদের ‘মেম’ বলে সম্বোধন করা চা-শ্রমিকদের ঐতিহ্য। যিনি চা-বাগানে গিয়েছিলেন, তিনি মালিকপক্ষেরই একজন নারী সদস্য। শ্রমিকেরা তাই প্রথাগতভাবে ‘মেম’ বলে সম্বোধন করেন তাঁকে। তাতে ভীষণ বিব্রত তিনি। বুঝতে পেরে শ্রমিকেরাও বিস্মিত। তাহলে সম্বোধন কী হবে? সরাসরি ‘মা’ বলে ডাকার আহ্বান জানান তিনি। এ আহ্বানে যেন চা-বাগান কর্তৃপক্ষের ওপর চা-শ্রমিকদের সব ক্ষোভ প্রশমিত হয়ে যায়।
‘মেম’ নয়, মা-তেই চা-শ্রমিকদের মন জয় করা চা-বাগানটি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের জুলেখানগর। শ্রমিকদের মুখে মা সম্বোধনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা চা-বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হচ্ছেন সৈয়দা গুলশানারা। প্রায় এক দশক ধরে নির্বিঘ্নে চা-বাগান পরিচালনা করছেন।
৮৬১ দশমিক ২৬ একরের জুলেখানগর চা-বাগানের পুরোটাই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। বাগান থেকে পা বাড়ালেই ভারতের ত্রিপুরা। অভ্যন্তর ভাগ উঁচু-নিচু অসংখ্য পাহাড়-টিলাবেষ্টিত। সমতলে নেমে আসা ছড়া মাড়িয়ে কাঁচা রাস্তা যোগাযোগের একমাত্র পথ। ২০০৫ সালে বাগানটি পরিচালিত হচ্ছিল ‘সৈয়দ টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’-এর মাধ্যমে। কোম্পানির স্বত্বাধিকারী সৈয়দ উবেদুর রহমান মারা গেলে কোম্পানির চেয়ারম্যান হন তাঁর ছেলে সৈয়দ হাফিজুর রহমান। তাঁর স্ত্রী সৈয়দা গুলশানারা। কর্তৃত্ব বদলের সময় শ্রমিক অসন্তোষ দানা বাঁধে। বাগানে বেড়াতে গিয়ে ‘মেম’ থেকে ‘মা’ সম্মোহিত হওয়ার ঘটনাটি ঘটে ওই সময়। সৈয়দা গুলশানারার ওপর পারিবারিক সিদ্ধান্তে বর্তায় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব।
তিন সন্তানের জননী গুলশানারা। কোম্পানির দায়িত্ব পেয়ে তিনি চা-শিল্প ও বাগান পরিচালনায় খুঁটিনাটি রপ্ত করতে পড়াশোনায় মনোযোগী হন। বাংলাদেশ চা-গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) থেকে স্নাতকোত্তর করে ২০০৭ সালে যোগ দেন চা-বাগানে। তাঁর নেতৃত্বে চার বছরের মাথায় চা-বাগানের শ্রেণি-কাঠামোরও উন্নতি হয়। ‘বি-গ্রেড’ থেকে ‘এ’-তে উন্নীত হয়ে ২০১১ সালে আরও ৪০ বছরের জন্য বন্দোবস্তের চুক্তি নবায়ন হয়।
এমডির পাশাপাশি ২০১৪ সাল থেকে সরাসরি চা-বাগান ব্যবস্থাপকের দায়িত্বও পালন করছেন গুলশানারা। মালিকপক্ষের হয়ে মাঠপর্যায়ে থেকে একজন নারী হিসেবে বাগান ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন সিলেট অঞ্চলের ১৫২ চা-বাগানের মধ্যে তিনিই একমাত্র বলে জানালেন গুলশানারা। তাঁর কাজের সফলতার পুরোটাই ‘মেম’ থেকে ‘মা’ সম্মোহিত হওয়ার সেই শুরুর কাহিনি।
সম্প্রতি গুলশানারার সঙ্গে কথা হয় চা-বাগানে। ইতিহাস ঘেঁটে চা-শ্রমিক প্রসঙ্গে চলে কথাবার্তা। গুলশানারা বলেন, ‘আমি শুধু তাঁদের ওই মনটাকে মায়ের মন দিয়ে ধারণ করেছি মাত্র। বাকিটা আমি নই, তাঁরা (চা-শ্রমিক) ভালো বলবে।’ স্বগতোক্তির সুরে শুধু বলেন গুলশানারা।
জুলেখানগর চা-পল্লি ঘুরে দেখা গেছে, তাই পরিপাটি করে সাজানো শ্রমিকদের বসতি। আট শতাধিক চা-শ্রমিকের বসবাস সেখানে। এর মধ্যে কিশোর বাড়াইক প্রবীণ চা-শ্রমিক। সবার কথা যেন তাঁর মুখ দিয়েই শুনতে হবে। ভারতের আগরতলা থেকে এসে জুলেখানগর চা-বাগানে প্রায় এক দশক ধরে কাজ করছেন কিশোর। ‘মেম’ থেকে মা কাহিনির তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। জানালেন, জন্মভূমির টান ভুলে এ ঘটনাটিই তাঁকে জুলেখানগরে স্থায়ী করেছে। কিশোরের স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়েও চা-শ্রমিক। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এবারের নির্বাচনে জুলেখানগরের ১২টি শাখার (সেকশন) পঞ্চয়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
চা-বাগান ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে আলাপ জুড়তেই কিশোর বাড়াইক তাঁদের ভাষার টানেই বলেন, ‘উনি মেম (মালিক), হামনি মা ডাকি...। কতটা আপন হইল এমুন হয় বিবেচনায় নিন!’

No comments

Powered by Blogger.