সর্বগ্রাসী কোটা সংস্কারের উদ্যোগ নেই by নূর মোহাম্মদ

কোটায়পিষ্ট মেধাবীরা। সরকারি চাকরির ৫৬ ভাগই কোটাধারীদের দখলে। বাকি ৪৪ ভাগ মেধাবীদের। ভাল পরীক্ষা দিয়েও কোটার কাছে ধরা খেয়ে যাচ্ছেন মেধাবীরা। জুটছে না সরকারি চাকরি। ফলে দিনের পর দিন চাকরি না পাওয়ার হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন অনেকেই। এ রকম হতাশা থেকেই গত বছর ৩রা জুন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব শাহীন। এদিকে কোটা ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক হিসেবে চিহ্নিত করে একাধিক পর্যালোচনা ও রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও কোন সরকারই এ নিয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এমনকি সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) প্রতি বছর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বারবার কোটা সংস্কারের সুপারিশ করলেও আমলে নিচ্ছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির নিয়োগে প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতিনি ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ কোটা রয়েছে। সব মিলিয়ে কোটাই ৫৬ শতাংশ। অথচ পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ জন প্রতিবন্ধী। আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ৯ হাজার। এই হিসাবে মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ নৃগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষিত আছে ৫ শতাংশ, ১ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জন্য ১ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রয়েছে। অন্যদিকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির নিয়োগ পুরোটাই কোটার ভিত্তিতেই হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতিনি ৩০ শতাংশ, নারী ১৫ শতাংশ, নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, জেলা ৩০ শতাংশ, এতিম ও প্রতিবন্ধী ১০ শতাংশ এবং আনসার-ভিডিপির জন্য ১০ শতাংশ কোটা রয়েছে।
এ বিষয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ বলেন, জনপ্রশাসনে শূন্য পদ না রাখতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। এ সংস্কারের জন্য পিএসসি থেকে কয়েক দফার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটার বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সরকারের। আমরা কর্মকমিশনের মাধ্যমে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীকে বাছাই করেছি, ফলে দিন দিন সিভিল সার্ভিসের প্রতি মেধাবী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ছে। একইভাবে পিএসসির ক্রেডিবিলিটি বা গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ছে।
২০০৮ সালে পিএসসির উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক শিক্ষা সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। ওই বছরের মার্চ মাসে ‘কোটা সিস্টেম ফর সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট ইন বাংলাদেশ: এন এক্সপ্লোরেটরি’ শীর্ষক রিপোর্ট পিএসসির কাছে জমা দেন। একই বছরে কোটাব্যবস্থা সংস্কারে সুপারিশসহ রিপোর্টটি সরকারের কাছে জমা দেন তারা। আকবর আলি খান এই কোটাব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে বলেন, অধিকাংশ কোটাই অসাংবিধানিক ও ন্যায়নীতির পরিপন্থি। কোন কোটাই চিরদিন থাকতে পারে না। প্রত্যেক কোটার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, দেশে যখন ১৭ জেলা ছিল তখন চালু হয় জেলা কোটা। পরে ১৭ জেলা ভেঙে ৬৪টি করা হলেও সেই কোটাই রয়ে গেছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ২৫৭ ধরনের কোটা প্রচলিত আছে বলে তথ্য দেন সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে শতভাগ কোটা রয়েছে উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়, এ চাকরিগুলো বেশির ভাগ অদক্ষ ও কম গুরুত্বপূর্ণ বলা হলেও প্রকতপক্ষে তা পুরো সত্য নয়। এখানে কিছু পদে দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। একই সঙ্গে আনসার-ভিডিপি কোটাকে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টের সারসংক্ষেপে বিদ্যমান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে ১৫ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ এবং উপজাতি ৫ শতাংশ রাখার সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে জেলা কোটা তুলে দিয়ে জাতীয় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করা হয়।
এ ছাড়া স্বাধীনতার পরপরই বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত চাকরি পুনর্গঠন কমিশন ১৯৭৩ সালে আর ১৯৭৭-এ বেতন ও চাকরি-সংক্রান্ত রসিদ কমিশন কোটাপদ্ধতির সুস্পষ্ট বিরোধিতা করে। তাদের মতে, কোটাপদ্ধতি একটি শীর্ষ মানের জনপ্রশাাসন গড়ার প্রতিবন্ধক হবে। ১৯৯৩ সালে তদানীন্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. আইয়ুবুর রহমানের নেতৃত্বে চারজন সচিবের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কোটাপদ্ধতিতে নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় মেধাকে অস্বীকারের নামান্তর বলে মন্তব্য করেন। ২০০০ সালে কোটা নিয়ে প্রতিবেদন দেন এ টি এম শামসুল হকের নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সে প্রতিবেদনে কোটাব্যবস্থাকে সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলা হয়। কোটাব্যবস্থা কোন যৌক্তিক ভিত্তির দ্বারা সমর্থিত নয়, বরং এটা জনপ্রশাসনের গুণগত মান হ্রাসে প্রভাব ফেলছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, একদিকে সরকার মেধাবীদের সরকারি চাকরিতে আসার অনুরোধ করছে, অন্যদিকে কোটায় তাদের পিষ্ট করে রাখছে। কোটার কারণে মেধাতালিকায় অনেক নিচের প্রার্থীরাও গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং, গোড়াতেই যেখানে গলদ, সেখানে মান উন্নয়নের প্রচেষ্টা তেমন সফল হওয়ার কথা নয়। যেমন বীজ, ফলন হবে তেমনই হওয়া কথা। বিদ্যমান কোটা জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার হওয়া প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিসিএস ও প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরির নিয়োগে ৬০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েও মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছে না। অন্যদিকে বিসিএসে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি নম্বর পেয়ে অনায়াসেই চাকরি মিলছে কোটাধারীদের। অন্যান্য সরকারি চাকরিতে কোটাধারীরা ৩৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে চাকরি পাচ্ছেন। এ ছাড়া লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় কোটাধারীদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার পরও যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিটি বিসিএসে শূন্য থাকছে অসংখ্য পদ। পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ ভাগ কোটার অল্পসংখ্যকই পূরণ হচ্ছে। গত ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটা যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। সর্বশেষ ৩৩তম বিসিএসেও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২ হাজার ৭০২ শূন্যপদের বিপরীতে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় মাত্র ৪৩০ জন। আরও দেখা যায়, বিভিন্ন প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী না থাকায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০, ২৯তম ৭৯২, ৩০তম ৭৮৪, ৩১তম ৭৭৩, ৩২তম (বিশেষ) ১ হাজার ১২৪ এবং ৩৩তম বিসিএসে ৪৭৯টি (বেশির ভাগই সাধারণ ক্যাডার) শূন্যপদে সুপারিশ করতে পারেনি পিএসসি। প্রতি বছর এমনভাবেই যোগ্যপ্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও কোটাধারী না হওয়ায় শূন্যপদে নিয়োগ পাচ্ছেন না মেধাবীরা।
এদিকে শুধু সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা অনুসরণে বিধি ও বাধ্যবাধকতা থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নিয়োগেও এ কোটাব্যবস্থা কার্যকর করা হচ্ছে। এভাবে কোটার সর্বগ্রাসী প্রয়োগের ফলে মেধাবীদের আর চাকরি পাওয়া সম্ভব নয় জানিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে দুবার বিসিএস ভাইভা দেয়া জোবায়ের আবদুল্লাহ বলেন, এ কোটাব্যবস্থা সুস্পষ্ট বৈষম্যমূলক। এটি শিক্ষিত তরুণসমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। এ কোটাব্যবস্থার সংস্কার সারা দেশের তরুণসমাজের দাবি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের বলেন, কোটা সমীক্ষা রিপোর্ট ও পিএসসি সুপারিশ বিষয়ে বেশ কিছু পর্যালোচনা আমাদের কাছে রয়েছে। তবে এসব নিয়ে আপাতত কোন পরিকল্পনা সরকারের নেই। যদিও এটি সংস্কার হওয়ার প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
খোদ বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনও (পিএসসসি) বর্তমান কোটা ব্যবস্থাকে জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ উল্লেখ করে এর সংস্কার ও সরলীকরণে বারবার সুপারিশ করেছে। পিএসসি তাদের ২০০৯, ২০১১ ও ২০১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ করে বলে, বর্তমানের কোটা-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রচলিত কোটা পদ্ধতির জটিলতার কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের জন্য বর্তমানে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সরলীকরণ অপরিহার্য। গত বছর ২১শে ডিসেম্বর প্রস্তাবিত অষ্টম পে ও সার্ভিস কমিশনে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাবনা দেয়া হলেও কোটা সংস্কার নিয়ে কোন প্রস্তাবনা দেয়া হয়নি।
জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন সদস্য বাদে সবাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কোটার পক্ষে অবস্থা নেয়া এম এম জামান প্রচলিত কোটাগুলো প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু পরে ১৯৯৭ সালেই এ কোটাব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে বর্তমানে ৫৬ শতাংশ বহাল আছে।

No comments

Powered by Blogger.