যেসব নৌকায় পাচার করা হতো বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের

নৌকায় করে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রায় নামার ভয়াবহতা এখন প্রতিদিনই বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হচ্ছে। উন্নত জীবনের আশায় পাচারকারীদের ফাঁদে পা দেয়া বাংলাদেশী আর রোহিঙ্গাদের যে দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা অবর্ণনীয়। এতদিন উদ্ধারকৃত আরোহীদের মুখে উঠে এসেছে তাদের ভয়াল নৌকাযাত্রার ইতিবৃত্ত। এবারে এমন দুটি নৌকার ভেতরের ছবি প্রকাশ হয়েছে। এসব ছবিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কেমন মানবেতর আর নোংরা পরিবেশে ঠাসাঠাসি করে বহন করা হয়েছে শ’ শ’ মানুষকে। বৃটেনের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের অনলাইনে এসব ছবিসহ গতকাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, নৌকার ভেতরের জায়গাগুলো নিতান্ত সঙ্কীর্ণ আর নোংরা। যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফেলে দেয়া জামাকাপড় ও স্যান্ডেল। একটি ছবিতে এক গামলা ভাত আর আধাবালতি পানি দেখা যায়। এমন পরিবেশে নৌকায় আরোহণ করা অনেক অভিবাসী তিন মাস পর্যন্ত সময় পার করেছেন। শ’ শ’ যাত্রীকে সামান্য খাবার পানি দিয়ে মাঝ সমুদ্রে পরিত্যাগ করে পাচারকারীরা। থাইল্যান্ড সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু করার পর থেকে একাধিক নৌকা ছেড়ে পালিয়েছে তারা। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার উপকূল থেকে এমন ৭টি নৌকায় করে প্রায় ২০০০ অভিবাসীকে  উদ্ধার করা হয়। এদের প্রত্যেকে বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। গতকাল মালয়েশিয়ার এক সিনিয়র কর্মকর্তা ফার্স্ট এডমিরাল তান কোক কুউই জানিয়েছেন, আর কোন নৌকাকে তাদের উপকূলে ভিড়তে দেয়া হবে না। আগেরদিন অভিবাসীবাহী আরেকটি নৌকা ফিরিয়ে দেন ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। ওই নৌকায় ৫০০ যাত্রী ছিল। ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে তারা নৌকাটি ফিরিয়ে দিলেও নৌকার যাত্রীদের খাবার, পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। এদিকে সমুদ্রের মাঝে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ হাজার অভিবাসী আটকে আছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা। তাদেরকে দ্রুত উদ্ধার করা না হলে মারা যেতে পারে বলে সতর্কবার্তা দিয়ে জাতিসংঘ এ অঞ্চলের সরকারগুলোর প্রতি একসঙ্গে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায়। জাতিসংঘে শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার জেফ্রি স্যাভেজ বলেন, আমরা এসব মানুষদের কাছ থেকে যা শুনছি তারা মাসের পর মাস ধরে সমুদ্রে ছিল। এরপর পাচারকারীরা তাদের ফেলে রেখে চলে যায়। তাদের জন্য রেখে যায় খুবই সামান্য খাবার ও পানি। শেষ হয়ে যায় ইঞ্জিনের জ্বালানি। এমতাবস্থায় নৌকাগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে সমুদ্রে ভাসতে থাকে। জেফ্রি স্যাভেজ সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, বড় ধরনের মানবাধিকার সংকট ঘটতে যাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সাগরে ঝাঁপ দাও নয় তো গুলি করবো
সাগরে ঝাঁপ দাও, নয় তো গুলি করবো। ঠিক এভাবেই একটি জাহাজে আটক প্রায় ৪০০ শরণার্থীকে জাহাজ ত্যাগ করতে বলেছে মানব পাচারকারীরা। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বাধ্য হয়ে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয় শরণার্থীরা। এরপর সাতরে তারা পৌঁছায় তীরে। এসব শরণার্থী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নাগরিক। মালয়েশিয়ান দ্বীপ লাংকাওয়ির স্থানীয় এক বাসিন্দার বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে মালয়েশিয়ার পত্রিকা দ্য স্টার। মূলত, লাংকাওয়ি দ্বীপে কিছুদিন আগে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বেশ কয়েকটি নৌকা পাড়ি জমায়। সেখানে প্রায় সহস্রাধিক রোহিঙ্গা ছিলেন। থাইল্যান্ডে ও মালয়েশিয়ায় ওই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে যাচ্ছিল পাচারকারীরা। সেখানে তাদের জোর করে বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দেয়া হতো। কিন্তু সমপ্রতি থাইল্যান্ডে শরণার্থীদের বন্দিশিবির ও গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে দেশটি। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেশজুড়ে ব্যাপক অভিযান শুরু করে থাই কর্তৃপক্ষ। তাই সাগরে থাকা থাইল্যান্ডগামী শরণার্থীদের নিয়ে উপকূলে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলে পাচারকারীরা। ধরা পড়ার ভয়ে অনেক পাচারকারী মাঝ সমুদ্রে জাহাজে শরণার্থীদের রেখে পালিয়ে যায়। নয়তো অসহায় শরণার্থীদের জাহাজ ছেড়ে সাঁতরে উপকূলে চলে যেতে বাধ্য করে। রিদযুয়ান নামের লাংকাওয়ি দ্বীপের ওই বাসিন্দা জানান, প্রায় ৪০০ অভিবাসীকে জাহাজ থেকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করে মানব পাচারকারীরা। অন্যথায় তাদের গুলি করার হুমকি দেয়া হয়। এরপর একটি ছোট নৌকা আসে জাহাজের কাছে। সে নৌকায় করে জাহাজের ক্যাপ্টেন পালিয়ে যায়। রিদযুয়ান ও তার গ্রামের অধিবাসীরা প্রথমে গত সোমবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নৌকা দেখতে পায়। এরপর পুলিশকে সাহায্য করা ছাড়াও রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার জোগাড়ও করেন তারা। রিদযুয়ানসহ গ্রামবাসী দেখতে পান, রোহিঙ্গারা খাবারের জন্য রীতিমতো ধুঁকছে। একটি নারকেল নিয়ে পাঁচজন কাড়াকাড়ি করছে। এসব ছিল স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য বেদনার্ত এক দৃশ্য। একপর্যায়ে সবার জন্য খাবার ও পানির ব্যবস্থা করে তারা। এক রোহিঙ্গা রিদযুয়ানকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে জানান, মালয়েশিয়ায় বিমানে করে নিয়ে যাওয়া ও চাকরি পাইয়ে দেয়ার জন্য এক দালালকে ৩০০০ রিঙ্গিত সমপরিমাণ অর্থ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষে দেখা গেল তিনি ও তার সঙ্গীরা ২ মাস ধরে ধুঁকছে সাগরের মাঝে। রিদযুয়ানের পিতা পান্তাই কুয়ালা মুদা বলেন, আমরা যখন অভিবাসীদের খাবার ও পানি দিই, তারা এক প্রকার আমাদের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। গ্রামবাসীরা তাদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করেনি। আমরা বরং তাদের সাহায্য করেছি। কারণ তারা মানব পাচারের শিকার। তারা খারাপ মানুষ নয়।

No comments

Powered by Blogger.