মৌলভীবাজারে রমরমা ব্যবসা ‘রঙিন দুনিয়া’ by ইমাদ উদ দীন

মৌলভীবাজারের অলিগলিতে প্রতিনিয়তই কানে বাজে প্রচার মাইক। মাইকে ভেসে আসে ‘মাতাই নষ্ট মামা, উঠাও বাচা নাড়িয়া ছাড়িয়া একটা।’ বাচন ভঙ্গিমায় নানা কথার অন্তরালে প্রচার মাইকে হাউজি আর লটারির লোভনীয় পুরস্কার । এভাবে জেলার বিভিন্ন স্থানে নানা নামে  মেলার আয়োজন জানান দিতেই মাইকে প্রচারিত হয় নিমন্ত্রণ বাক্য। হ্যাঁ ভাই চলে আসুন আজ রাত ১০ ঘটিকায়। ঢাকা থেকে আগত নারী-পুরুষ সম্মিলিত ঝুমুর ঝুমুর নাচ, গান আর তার সঙ্গে জিতে নিন আর্কষণীয় সব পুরস্কার। সাথে  নগদ এক লাখ/দুই লাখ  টাকার  হাউজি বাম্পার। আর লটারিতে অংশগ্রহণ করে জিতে নিন মোটরসাইকেলসহ আরও কতো কি পুরস্কার।
গেল বছরের শেষদিক থেকে জেলা জুড়ে  হঠাৎ শুরু হয়েছে মেলা। যাত্রা ও যাত্রা শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার নামে চলছে মেলার নামে এমন অভিনব লাভজনক ব্যবসা। এ সব মেলা আয়োজনের অন্তরালে রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। স্থানীয় দুর্ভোগগ্রস্ত মানুষ এ ব্যবসার নাম দিয়েছেন ‘রঙিন দুনিয়া’। লোভে পড়ে রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ। আর এ কারণেই নাকি তারা এই ব্যবসার নাম দিয়েছেন রঙিন দুনিয়া। ব্যবসার আয়োজকরা লাভবান হলেও ফতুর হচ্ছেন অংশগ্রহণকারীরা। জেলাজুড়ে  দীর্ঘদিন থেকে চলা দেশীয় সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার  নামে এভাবেই চলছে এমন অপসংস্কৃতি। অশ্লীলতা আর বেহায়াপনায় ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে স্থানীয় যুব সমাজ। বিপথগামী হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। অবনতি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার। আর এ সব আয়োজনকে কেন্দ্র করে বাড়ছে চুরি-ছিনতাই আর ডাকাতির ঘটনা। সম্প্রতি দিন-দুপুরে মৌলভীবাজার শহরে ছিনতাইয়ের ঘটনা কিংবা ডাকাতির প্রস্তুতিকালে পুলিশের হাতে অস্ত্রসহ ডাকাত আটকের ঘটনায় উদ্বিগ্ন করে তুলেছে  সচেতন  মহলকে। মৌলভীবাজারে বৈশাখী মেলা, বিজয়মেলা, পাহাড়ীমেলা আর যাত্রার  নামে চলছে জুয়া, লটারি, অশ্লীল নৃত্য, ভ্যারাইটিজ শো। জেলার পাঁচটি এলাকায় গত এক বছর ধরে চলছে এসব অসামাজিক কার্যকলাপ। স্থানীয়দের বাধার মুখে ১০-১৫ দিন বন্ধ থাকলেও স্থান এবং ব্যানার পরিবর্তন করে আবার শুরু হয় মেলার নামে অবৈধ কার্যকলাপ।
সূত্র জানায়, প্রশাসনের কোন অনুমোদন ছাড়াই স্থানীয় ওইসব সিন্ডিকেট চক্র মাসের পর মাস এসব অপকর্ম করলেও যেন দেখার কেউ নেই। ধারাবাহিকভাবে চলা অবৈধ এই কার্যকলাপের ফলে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হওয়ার পাশাপাশি এলাকার তরুণ ও যুবসমাজ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। প্রতিদিন লটারি ও জুয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বাড়ছে চুরি, ছিনতাই। পাশাপাশি বসছে ওয়ানটেন, চরকি নামের জুয়ার বোর্ড। এসব জুয়ার বোর্ডে দীর্ঘদিন টাকা বিলিয়ে দিয়ে ক্রমাগত নিঃস্ব হতে চলেছে সাধারণ শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষ। অপরদিকে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা মূল্যের লটারির টিকেট। পরীক্ষার সময়ে যাত্রা-জুয়া, অশ্লীল নৃত্যে লটারি বিক্রি বন্ধে স্মারকলিপি দেন স্থানীয় এলাকাবাসী। কিন্তু কোন ফল পাওয়া যায়নি। এসব মেলা বন্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সরকারের প্রশাসনের কর্মকর্তারাও যেন নির্বিকার। এসব অবৈধ কার্যকলাপে প্রশ্রয় দেয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজনগর নন্দীউড়া, মৌলভীবাজারের শেরপুর, আথানগীরি ও মৌলভীবাজার স্টেডিয়ামে যাত্রার নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নৃত্য ও যাত্রা শিল্পীর নাম করে অন্ধকার জগতের মেয়েদের এনে রাতজুড়ে চালানো হচ্ছে অশ্লীল নৃত্য। এ সব স্থানে গভীর রাত পর্যন্ত বসানো হয় বিভিন্ন ধরনের জুয়ার জমজমাট আসর। স্থানীয় প্রভাবশালী কতিপয় অসাধু লোকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম চলছে। তবে অনেকে মানসম্মানের ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে ধারাবাহিকভাবে চলা এসব অপকর্মের কোন প্রতিকার না হওয়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
জানা যায়, মৌলভীবাজার সাইফুর রহমান স্টেডিয়ামে গত পহেলা মে থেকে বৈশাখী মেলার নামে শুরু হয়েছে জুয়া, লটারি ও ভ্যারাইটিজ শো। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এই ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে গত মঙ্গলবার দুপুরে মৌলভীবাজার পৌর এলাকার ২৪৩ জন নাগরিকের স্বাক্ষর দিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন এলাকাবাসী। স্মারকলিপিতে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান মিজান, পৌর ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাহিদ হোসেন, ১১নং মোস্তফাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ রুমেল আহমদসহ পৌর এলাকার রঘুনন্দনপুর, উত্তর জগন্নাথপুর, বনবিথি, উত্তর ও দক্ষিণ কলিমাবাদ, চুবড়া, সোনাপুর এলাকার বাসিন্দারা স্বাক্ষর করেছেন। এ সময় স্বারকলিপি দিতে আসা এলাকাবাসী জানান, ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত সৈয়দ শাহ্‌ মোস্তফা (রঃ) স্মৃতি বিজড়িত পুণ্যভূমি মৌলভীবাজার শহরের রঘুনন্দনপুর এলাকায় এম. সাইফুর রহমান স্টেডিয়ামে বৈশাখী মেলার নামে অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে। এর প্রভাবে সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে। শহর ও শহতলীতে বাড়ছে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড। বিপথগামী হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষ সরকারি দলের ছত্রছায়ায় এই ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে এমন আশঙ্কাও করছেন তারা। মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জহিরুল ইসলাম এলাকাবাসীর স্মারকলিপি গ্রহণ করে তাদের আশ্বস্ত করেন বিষয়টি তদন্ত করে আইন আনুগ ব্যবস্থা নিবেন। তার এমন বক্তব্যে সন্তুষ্ট এলাকাবাসী। তারা রয়েছেন অপেক্ষায় । তবে কয়েকদিনের মধ্যে তা বন্ধ না হলে তারা কঠোর আন্দোলনে নামবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
এদিকে মৌলভীবাজার এম. সাইফুর রহমান স্টেডিয়াম ছাড়াও বর্তমানে সদর উপজেলার শেরপুর ব্রাহ্মণগ্রাম, সাধুহাটি, কাগাবলা ইউনিয়নের আথানগীরি, রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নে চলছে মেলার নামে জুয়া, লটারি, অশ্লীল নৃত্য, ভ্যারাইটিজ শো।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান মিজান জানান, সংস্কৃতি  রক্ষার নামে অপসংস্কৃতির চর্চা হতে পারে না। আর যেভাবে বিভিন্ন স্থানে মেলার নামে অসামাজিক কার্যকলাপ হচ্ছে তা দেশ ও সমাজের স্বার্থে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কোন সুস্থ ধারার মানুষ এ সব অপকর্ম সমর্থন করে না। মেলার নামে অশ্লীলতা বন্ধে গত ১০ই মে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। ওইসব এলাকার লোকজন ফুঁসে উঠেছে অচিরেই তা বন্ধ না হলে কঠোর আন্দোলনে নামবেন তারা ।
মৌলভীবাজার চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. কামাল হোসেন জানান, দীর্ঘ এক বছর জুড়ে জেলার নানা স্থানে নানা নামে মেলার নাম করে যে অশ্লীলতা, জুয়া ও লটারির ব্যবসা শুরু হয়েছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এর কু-প্রভাব পড়ছে এলাকার যুবসমাজ ও তরুণ প্রজন্মের উপর। হুমকির মুখে আইনশৃঙ্খলা। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। দেশীয় সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এসব অপসংস্কৃতি রোধে প্রসাশনসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.