ফের ফুঁসে উঠছে শিক্ষাঙ্গন

নানা ইস্যুর আন্দোলনে টালমাটাল দেশের একডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। যৌন হয়রানি, ভিসির পদত্যাগ, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, শিক্ষক-কর্মচারীর নানা রাজনীতিসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে আন্দোলনে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠছে শিক্ষাঙ্গন। প্রতিটি আন্দোলনের পেছনে রয়েছে সরকারি দলের শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি ও আধিপত্য কাজ করছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই বিএনপি-জামায়াতের লাগাতার হরতাল-অবরোধে প্রায় তিন মাস ধরে স্থবির ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। সেই স্থবিরতা শেষ হতে না হতেই ফের নতুন করে শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর মধ্যে ভিসি ছাড়াই চলছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিদায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন শিক্ষকরা। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় যৌন হয়রানি ইস্যুতে উত্তপ্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অতিরিক্ত পরিচালক (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) ফেরদৌস জামান মানবজমিনকে বলেন, কয়েকটি শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতায় আমরাও উদ্বিগ্ন। সংকট নিরসনে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় সরজমিন পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছি। আরও দুটি শিগগিরই সরজমিন পরিদর্শন করতে যাবো। বাকিগুলো স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অভ্যন্তরীণভাবে মেটানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছি। আশা করি, খুব দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব প্রশাসনিক পদ থেকে সরকারদলীয় শিক্ষকরা পদত্যাগ করেছেন। শাবিতে প্রশাসনিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে। শিক্ষকরা জানিয়ে দিয়েছেন ড. আমিনুল হকের সঙ্গে তাদের আর কাজ করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে শাবি ভিসি ১লা মে থেকে দুই মাসের ছুটিতে গেছেন। এ অবস্থায় শাবিতে অচলাবস্থার বিষয়টি আরও ঝুলে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্দোলন যেন পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)কে। নারী কেলেংকারিসহ নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে ভিসি পদত্যাগ করলেও রেহায় পায়নি ক্যাম্পাসটি। গতকাল বেতনের দাবিতে প্রশাসন ভবন ও কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন কর্মচারীরা। ভিসির সই ছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কোন ধরনের বেতন বা বিল তুলতে পারেন না বলে জানা গেছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের রায় নিয়ে মন্তব্য করায় এক শিক্ষককে পিটিয়ে আহত করায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে ভিসি প্রফেসর ড. খালেদা একরামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগসহ বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ দফা দাবিতে সরকারদলীয় শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে রয়েছেন। তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগের কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যে প্রশাসনিক ভবনের তালা ঝুলিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া, ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘কটূক্তি’ করার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গত এক সপ্তাহ ধরে এ আন্দোলন চলছে। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও স্বস্তিতে নেই ভিসি প্রফেসর ড. রুহুল আমীন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গত সপ্তাহে হাবিপ্রবিতে দুই ছাত্র নিহত হন। এর মধ্যে মিল্টন হত্যার ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ নেতার হাতে ভিসিসহ কয়েকজন নেতা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় ক্যাম্পাসে উত্তাল অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারদলীয় শিক্ষকরা ভিসির পাশে থাকলেও বেঁকে বসেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা উল্টো ভিসি প্রফেসর ড. মিজান উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতেই আন্দোলন শুরু করেছেন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপন্থি শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কয়েক মাস অচল ছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনের মূল ইস্যু ছিল ভিসির পদত্যাগ। যেকোন মুহূর্তে আবারও আন্দোলনে নামতে পারেন শিক্ষকরা। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে বেশ কয়েকদিন। তারাও ভিসির পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলনে নামেন। বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও যেকোন সময় আবারও আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে বলে জানা গেছে। পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। গত  সোমবার  ঢাকা মেট্রোপলিটন কমিশনার (ডিএমপি) কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটার শিকার হন ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। এরমধ্যে এক নারীকে পুলিশের লাথি মারাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন চলছে। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষিকাকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় পুলিশের এক এসআইকে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষিকা ছাত্রলীগের এক নেতার দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ায় চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে ক্যাম্পাসে। সর্বশেষ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.