বাতিল ভোটের রেকর্ড by সিরাজুস সালেকিন

তিন সিটি করপোরেশনের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ভোট বাতিল হয়েছে রেকর্ডসংখ্যক। নির্বাচন কমিশনের ধারণাতেই বাতিল ভোটের এ হার আগে কখনও হয়নি। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাতিল ভোটের পরিমাণ ভোটে অনিয়মের অনেকটা প্রমাণ বহন করে। ভোটের প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা, দ্বিতীয় স্থানে বিএনপি এবং তৃতীয় অবস্থানে বাতিল ভোট। তিন সিটিতে ভোট পড়েছে ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ ভোট বাতিল হয়ে গেছে। অতীতের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে যা অস্বাভাবিক রকমের বেশি। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের (ইসি) নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপ-সচিব শামসুল আলম বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোট বাতিল হয় ভোটারদের অসচেতনতার কারণে। অতীতের নির্বাচনগুলোতেও ১ থেকে ২ শতাংশ ভোট বাতিল হতে দেখা গেছে। ভোট বাতিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সাধারণত ব্যালট পেপারে একাধিক প্রতীকে বা নির্ধারিত ঘরের বাইরে সিল মারা হলে, ব্যালট পেপারে কিছু লেখা বা ছেঁড়া হলে, ভাঁজ যথাযথ না হলে এবং কালি ছড়িয়ে পড়ার মতো বেশ কিছু কারণে ভোট বাতিল হতে পারে। ভোট কেন্দ্রে অরাজকতার কারণে ভোট শুরুর চার ঘণ্টার মাথায় দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভোটের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে। আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার পর বাতিল ভোটের সংখ্যা নির্বাচনকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনকি ভোটের হিসাব বদলে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে নির্বাচন বর্জনকারী প্রার্থীদের পক্ষ থেকে। ঢাকা উত্তরে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল মানবজমিনকে বলেন, জনরায় আমাদের দিকেই ছিল। কিন্তু সরকার অনিয়ম ও কারচুপি করে ভোটের হিসাব বদলে দিয়েছে। নির্বাচন বর্জন করার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, দিনের শেষে একটি ভোট বেশি দেখিয়ে হলেও সরকার সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হতো। তাই আমরা নির্বাচন থেকে সরে আসি। আগামীর ঢাকা মঞ্চের মেয়র প্রার্থী জোনায়েদ সাকি গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, তার বহু কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা সকালে ভোট দিয়ে আসার পর কৌতূহলবশত সন্ধ্যায় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে জেনেছেন সেখানে টেলিস্কোপ মার্কায় কোন ভোটই নাকি পড়েনি। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা সকালের দিকেই ভোট বর্জন করলেও তাদের বাক্সে বিপুল পরিমাণ ভোট দেখানো হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন দেখানোর জন্য। তিনি আরও অভিযোগ করেন, অনেকটা মাগুরা নির্বাচনের মতোই ইচ্ছামতো ভোট বরাদ্দের প্রক্রিয়া এখানে স্পষ্ট। এর মাধ্যমে একদিকে সরকারি দল এক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হিসাবে দেখাবার আয়োজন করেছে। কেন্দ্রে সাধারণ মানুষদের না যেতে পারা ও জালভোটের কারণে ভোট দিতে ব্যর্থ হবার পরও যারা টেলিস্কোপ মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদেরকে সামনাসামনি বলেছেন, টেলিফোনে জানিয়েছেন, ফেসবুকে মেসেজ দিয়েছেন, তাদের ভোটগুলোও গণনা করা হয়নি। বরং নির্বাচন কমিশন সরকারের হুকুম অনুযায়ী বানানো সব সংখ্যাকে ঘোষণা করেছে।
ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার মেয়র পদে ভোট পড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। এ নিয়ে আমাদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয় নেই। আমরা পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছি, ভোটার-নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে মত দেবেন। সরকারিভাবে ঘোষিত ফল অনুসারে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক। ১০৯৩ কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে আনিসুল পেয়েছেন ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট। তার নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত তাবিথ আউয়াল বাস প্রতীকে পেয়েছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১০৯৩টি। অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও কোন কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন। ৮৮৯টির মধ্যে ৮৮৬টি কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে ইলিশ প্রতীকের সাঈদ খোকন পেয়েছেন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস মগ প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। গোলযোগের কারণে তিনটিতে ভোটগ্রহণ স্থগিত হলেও ওই সব কেন্দ্রের ভোটের যোগফল দুই প্রার্থীর ব্যবধানের চেয়ে কম হওয়ায় রিটার্নিং অফিসার মিহির সারওয়ার মোর্শেদ আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাঈদ খোকনকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন। মোট ৭১৯টি কেন্দ্রের সবগুলোর ঘোষিত বেসরকারি ফলাফলে হাতি প্রতীক নিয়ে নাছির পেয়েছেন ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম কমলা লেবু প্রতীকে পেয়েছেন ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তিন সিটিতে করপোরেশনে ভোট গ্রহণ হয়। মোট ভোটার ছিলেন ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৬  জন। রিটার্নিং অফিসাররা বুধবার ভোরে ভোটের যে ফল প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় তিন সিটিতে মোট ভোট পড়েছে ২৬ লাখ ৪৮ হাজার ২০৫টি। এই হিসাবে ভোট পড়ার হার ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৪.৫৬ শতাংশ ভোটই বাতিল হয়ে গেছে ঠিকমতো সিল না মারাসহ বিভিন্ন কারণে। বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণে এর মধ্যে ১ লাখ ২১ হাজার ৩টি ভোট বাতিল করেছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০৯৩টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিল ২৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন। সব ক’টি কেন্দ্রের প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, এখানে ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৮ জনের ভোট বাক্সে পড়েছে। যা মোট ভোটের ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এই সিটিতে বাতিল হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৮১ ভোট। ঢাকা দক্ষিণে মোট ভোটার ছিলেন ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৩ জন। ৮৮৯ কেন্দ্রের মধ্যে ৮৮৬ কেন্দ্রের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। গোলযোগের কারণে তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। ঘোষিত কেন্দ্রের ফলাফলে দেখা যায়, মোট ভোট পড়েছে নয় লাখ পাঁচ হাজার ৪৮৪টি। যা মোট ভোট সংখ্যার ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৪০ হাজার ১৩০টি ভোট বাতিল হয়েছে। বৈধ হয়েছে ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৩৫৪টি ভোট। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭১৯টি কেন্দ্রের মধ্যে সব ক’টির ফলাফল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৯টি ভোটের মধ্যে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৩টি ভোট বাক্সে পড়েছে। ভোট পড়ার হার ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ। চট্টগ্রামে বাতিল হয়েছে ৪৭ হাজার ২৯২টি ভোট। আর আট লাখ ২১ হাজার ৩৭১টি ভোট বৈধতা পেয়েছে। এবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে আগের নির্বাচনের চেয়ে ভোটের হার বাড়লেও চট্টগ্রামে কমেছে। ২০০২ সালের ২৫শে এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট পড়ে। ২০১০ সালের ১৭ই জুন চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচনে পড়ে ৫৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট।

No comments

Powered by Blogger.