কৃষি ব্যাংকের ওপর আমি খুবই অসন্তুষ্ট -সাক্ষাৎকার: অর্থমন্ত্রী by ফখরুল ইসলাম

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্বীকার করে নিলেন যে ব্যাংক খাতে কিছু দুর্বল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর এখন তিনি সবচেয়ে অসন্তুষ্ট কৃষি ব্যাংকের ওপর।
অর্থমন্ত্রী ২০ এপ্রিল ওয়াশিংটনের রোনাল্ড রিগ্যান বিমানবন্দরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি ব্যাংক খাত ছাড়াও আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের দর্শন, মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার এবং পরিকল্পনা কমিশনসহ অর্থনীতির সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম
প্রথম আলো: ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কি আস্থাশীল?
আবুল মাল আবদুল মুহিত: না, না, না। ব্যাংক খাত নিয়ে আমি ততটা চিন্তিত না। দু-চারটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। সোনালী ব্যাংকে একটা লুট হয়েছে, জোচ্চুরি হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে সোনালী ব্যাংক ঠিকও হয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংকটা একটা সমস্যায় পড়েছে। অবশ্য ব্যাংক খাতে কিছু দুর্বল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমনিতে অন্য কোনো ব্যাংকে তেমন একটা অসুবিধা নেই। হ্যাঁ, আরেকটা ব্যাংক আছে। কৃষি ব্যাংক। আমার আমলেই এটা হয়েছে। আমি খুবই অসন্তুষ্ট এই ব্যাংকটার প্রতি। কৃষককে কৃষি ব্যাংক যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি দিয়েছে কৃষি-বাণিজ্যে। আমি এখন কৃষি ব্যাংককে ধরেছি। তদারক চলছে। বিগত পাঁচ বছরে তারা বাণিজ্য িক বিনিয়োগ এত বেশি করেছে যে এটা মানা যায় না। কৃষি ব্যাংককে অবশ্যই প্রধানত কৃষিঋণে যেতে হবে। তবে একটা ভালো খবর হলো, বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন কৃষিঋণ দিচ্ছে।
প্রথম আলো: বেসিক ব্যাংক যে এত বড় সমস্যায় পড়ল, এর নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন বা রয়েছেন, তাঁদের কাউকেই কিন্তু শাস্তি দিতে পারলেন না।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: না, না, কে বলেছে? এখনো শেষ হয়নি।
প্রথম আলো: হোতা তো ধরাছোঁয়ার বাইরেই।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: না, না, শেষ হয়নি।
প্রথম আলো: এবার তাহলে বাজেট প্রসঙ্গে আসি। এমন একসময়ে আপনি আগামী অর্থবছরের বাজেট করতে যাচ্ছেন, যখন চলতি অর্থবছরে অন্তত তিন মাসের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন হয়েছে। তাতে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এগুলো সামাল দিতে না পারায় আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি না?
আবুল মাল আবদুল মুহিত: না, না, না। এগুলোর প্রভাব নগণ্য। খালেদা জিয়ার আন্দোলনের কারণে বলতে পারি ক্ষতি হয়েছে একটাই, আর সেটা হচ্ছে, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কিছুটা কমে গেছে। অন্য কোনো দিক থেকে কোনো সমস্যা বা অসুবিধা হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনব্যবস্থা তো ভালোভাবেই চলছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ অর্জিত হয়েছে আমাদের সময়ে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আমলে। এটাই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
প্রথম আলো: চলতি অর্থবছর শেষে কত হতে পারে প্রবৃদ্ধির হার?
আবুল মাল আবদুল মুহিত: আমরা তো আশা করেছিলাম ৭ দশমিক ১ শতাংশ অর্জিত হবে। এখন নিশ্চিত না যে এটা হতে পারবে কি না। কিন্তু ৭ শতাংশের কাছাকাছি হবে।
প্রথম আলো: ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কিন্তু এই হার ৮ শতাংশ হওয়ার কথা।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: তা হওয়ার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা করা হয় সব সময়ই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য। আর আগের পরিকল্পনার চেয়ে এখনকার পরিকল্পনার মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য। এখন বলা যায়, একধরনের অনুমান করা হয়। সেটা তারা ঠিকভাবেই করেছিল ৮ শতাংশ। যদি বিভিন্ন রকমের অসুবিধা না থাকত, সেটা হতেও পারত। তবে এটা ঠিক যে, আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত হবে, তখন লক্ষ্যমাত্রার হার সংশোধন করতে হবে। করা উচিত হবে। আর আগামী বাজেটের জন্য আমার ইচ্ছা হলো প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরে রাখা। সত্যি সত্যিই কত রাখতে পারব, বলতে পারব না। বাজেট তো খুব কাছে, এ মুহূর্তে বলাটাও ঠিক হবে না। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এটা হবে ৭ দশমিক ২ শতাংশের বেশি।
প্রথম আলো: যতই বলুন না কেন হরতাল-অবরোধে তেমন ক্ষতি হয়নি, আসলে তো হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত আয় ও এনবিআর-বহির্ভূত আয় সংগ্রহে প্রভাবও পড়ছে।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: আসলে চেষ্টা করলে হয়। উভয় ধরনের আয় সংগ্রহেই সরকারের চেষ্টা রয়েছে। আগেরবারও তেমন অসুবিধা হয়নি, এবারও হবে না বলে আশা করি। আমি যখন ২০০৯ সালে মন্ত্রী হলাম, তখনই আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাজেট নিয়ে গভীর কিছু করতে হবে। সরকারি বাজেটটা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ছিল সবচেয়ে কম। কম মানে জিডিপির অর্থে কম। এত কম ছিল যে এটা ছিল একধরনের অসম্মানের ব্যাপার। তাই প্রথম বছর থেকেই আমি ঠিক করেছি যে বাজেটের আকার বাড়াতে হবে। আর এ জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদের সঞ্চালন বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধির জন্য এখন অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ যা আছে, তার বাইরে বৈদেশিক বিনিয়োগের অংশ বড়জোর ২ শতাংশ হতে পারে। সুতরাং অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালনেই আমরা বেশি নজর দিচ্ছি। এনবিআরও এ ব্যাপারে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সতর্ক।
প্রথম আলো: আমাদের উন্নয়ন বাজেটের আকার সমীহ করার মতো। স্বাধীনতার পর পর পরিকল্পনা কমিশন যতটা শক্তিশালী ছিল, বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ ছিলেন কমিশনের সদস্য, কিন্তু এখন এই দুরবস্থা কেন? সরকারই বা কেন পরিকল্পনা কমিশনকে গুরুত্বহীন করে রেখেছে?
আবুল মাল আবদুল মুহিত: কমিশন দুর্বল হয়ে গেছে। কারণ, কমিশন তার গুরুত্ব হারিয়েছে। আমরা এখন তিন বছর মেয়াদি বাজেট করি। কমিশন এখন শুধু অনুমান (ফোরকাস্ট) করে। পাঁচ বছর মেয়াদি করে, এক বছর মেয়াদি করে। এই যে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা, সেটাও তারা করেছে। যদিও আমার বিশ্বাস ও ধারণা, ২০১৯ সালের মধ্যেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে যাব। তবে সার্বিকভাবে যদি বলি পরিকল্পনা একটু উচ্চাভিলাষী হওয়াই ভালো। সে দিক থেকে আমাদের কমিশন ঠিক কাজই করছে।
প্রথম আলো: আগামী অর্থবছরের বাজেটের দর্শন কী? মোটাদাগে কী কী বিষয় বিবেচনায় রাখবেন?
আবুল মাল আবদুল মুহিত: এখনো বলার মতো সময় আসেনি। কাজ চলছে। বাজেট নিয়ে দর্শনের কথা কবে যেন বলেছিলাম। জ্বালানি ও যোগাযোগের পরিবর্তে আগামী বাজেটে বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি খাতে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হবে। বরাদ্দ খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব হবে না। কারণ, যে প্রকল্প ও কর্মসূচিগুলো চলছে, সেগুলো তো চালু রাখতে হবে।
প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের এবারের বসন্তকালীন বৈঠক সম্পর্কে কোনো মূল্যায়ন করবেন?
আবুল মাল আবদুল মুহিত: বসন্তকালীন বৈঠকে অনেক আলোচনাই হয়, এবারও হয়েছে। মোটামুটি ফলপ্রসূ। আইএমএফের সঙ্গে কোনো সমস্যা নেই। আর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে মূলত ৫০ কোটি ডলার ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট নিয়ে। আমি আশা করছি, এটা পাব। আর বিশ্বব্যাংকের অন্য কর্মসূচি তো চলছেই। পদ্মা সেতুর ওই ব্যাপারটার পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আর কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: এত ব্যস্ততার মধ্যেও সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.