‘ও’-টার্ন by মাহবুব তালুকদার

সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলাকালে
তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের
ছবি দেখান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা l বাসস
চাচা বললেন, মিডিয়ার কাণ্ডটা দেখেছ? ওরা এখন সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
আজকাল মিডিয়া তো সরকারবান্ধব। সরকারবান্ধব বলেই এই সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ার লোকজনকে ডেকে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন। আমি বললাম, যে টক শো সম্পর্কে তার ক্ষোভ ছিল, সেই টক শোওয়ালা, এমনকি সঞ্চালকদেরও তিনি তাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অবশ্য টক শোতে এখন সরকার সমর্থকদের মুখ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। কিন্তু নতুন করে আবার কী ঘটল?
মিডিয়া কাওরান বাজারে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলাকারীদের ছবি ছেপে দিয়েছে। অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে এটা।
তাতে কী হলো? হামলাকারীরা কেউ আওয়ামী লীগের লোক নয়। আওয়ামী লীগ এমন দাবি করেছে।
সে কথা শতকরা একশ ভাগ সত্য। হামলাকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কেউ ছিল না।
তাহলে আর অসুবিধা কী? আমাদের প্রিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ওখানে যারা হামলা করেছে তারা সবাই কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী। বিএনপির হরতাল-অবরোধের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তারা খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা করেছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কথা একবর্ণও মিথ্যা নয়।
তাহলে তো হয়েই গেল। এ নিয়ে মিডিয়ার বিরুদ্ধে আপনার আর অভিযোগ কী?
আরে ভাই! মিডিয়া ভেতরের সব গোমর ফাঁস করে দিয়েছে।
সেটা কী রকম?
কাওরান বাজারে হামলাকারীরা আওয়ামী লীগের কেউ ছিল না, সেটা খুবই সত্য। তবে তারা ছিল ছাত্রলীগের সদস্য। তাদের নামধাম খুঁজে দু-দিন পরে পত্রিকায় ছবি ছাপার কী দরকার ছিল? ছাত্রলীগের মিজান, রোমান, তুহিন, জাকির, আল আমীন, মোহন, সাগর- এদের ছবি ছাপার কোনোই প্রয়োজন ছিল না।
তবে যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এরা সবাই কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী?
হতে পারে। হয়তো ছাত্রলীগের এদের সবারই কাওরান বাজারে দোকানপাট আছে। তিনি হয়তো ভেতরের খবর রাখেন। মন্ত্রী হয়ে তিনি তো আর মিথ্যা কথা বলতে পারেন না।
চাচা! পত্রিকায় দেখলাম বাংলামটরে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার সময় খালেদা জিয়ার একজন নিরাপত্তাকর্মীকে মাটিতে ফেলে পাড়ানো হচ্ছে। আরেকটা ছবিতে পুলিশের সঙ্গে এক হামলাকারীর একত্রে ছবি ছাপা হয়েছে, যার প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে পিস্তল উঁকি দিচ্ছে। পত্রিকায় তারও নাম ছাপা হয়েছে। তার নাম সালেহ আহমদ ওরফে হৃদয়। কিন্তু এসব ঘটনা কেন?
আমি তো সে কথাই বলতে চাচ্ছি। চাচা জানালেন, এসব ছবি পত্রিকায় ছাপার কী দরকার ছিল? তুমি যাই বলো, মিডিয়ার ব্যাপারে আমি খুব হতাশ। টক শোর লোকজন পাল্টানোতে না হয় সফলকাম হওয়া কঠিন ছিল না। পত্রিকার সাংবাদিক পাল্টানো যায় কী করে বলো তো?
আমি বললাম, সরকারের উচিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে কয়েকটা পত্রিকা বের করা। তারা যাতে একচেটিয়াভাবে সরকারপক্ষকে সমর্থন করে তার ব্যবস্থা নেয়া। আর কিছু নিজেদের লোককে দিয়ে সব পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লেখাতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
ইত্যবসরে চাচি ঘরে এলেন। বললেন, আজকের বিষয়বস্তু কী?
আমি বললাম, চাচা মিডিয়া সম্পর্কে খুবই ক্ষুব্ধ।
কেন? মিডিয়া কী দোষ করেছে?
চাচা ক্ষুব্ধস্বরেই বললেন, মিডিয়ার কাণ্ডটা দেখ। খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারের খবর প্রথম পাতায় বড় করে ছাপছে। তার গাড়িবহরে হামলার ছবিও বড় করে ছাপা হচ্ছে। কোথায় নির্বাচনের খবর ছাপবে, তা না করে খালেদা জিয়ার গাড়ি ভাঙার খবর ছাপার দরকারটা কী?
চাচি বললেন, সেদিন কাওরান বাজারের ঘটনার পর বিভিন্ন দেশের ১৭ জন কূটনীতিক ওইসব গাড়ি দেখতে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে গেছেন। এ খবরটা দেখেছ?
হ্যাঁ। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়। চাচা বললেন।
আমি বললাম, আমাদের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু খালেদা জিয়াকে ঘরের ভেতরে বসে থাকতে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, সেটা তার জন্য মঙ্গলজনক হবে।
তিনি সব সময়ই খালেদা জিয়াকে সৎ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। চাচা বললেন, দুঃখের বিষয় হলো খালেদা জিয়া তার কোনো পরামর্শই কানে তোলেন না।
ইনু তো খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ছাড়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। চাচি জানালেন।
সেটাও অত্যন্ত সৎ পরামর্শ। চাচা উদ্দীপ্তস্বরে বললেন, শুধু খালেদা নয়, বিএনপির এখন রাজনীতিতে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। তারা দেশে কেবল অশান্তি সৃষ্টি করছে। বিএনপি না থাকলে দেশটা শান্তির মরুদ্যান হতো। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অন্যায়ভাবে অংশগ্রহণ না করলে, নির্বাচন খুবই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হতে পারতো।
কিন্তু দেশে তো একটা শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। চাচির বক্তব্য।
কে বলল বিরোধী দল নেই? জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা দলের সমর্থন পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তাদের দল কতটা শক্তিশালী তা বোঝা যাচ্ছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রচারণা থেকে।
তাকে তো নির্বাচনী প্রচারণা থেকে বিরত থাকতে বলেছে ইসি।
ইসির কথা তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। এরশাদ সাহেব ইসির নিষেধাজ্ঞা মেনে নিলে তোমরাই বলতে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি অনুগত আচরণ করছে। শক্তিশালী বিরোধী দল চাও, আবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের শক্তি পরীক্ষা করতে দেবে না। এটা ভারি অন্যায়।
কথার মাঝখানে চাচি ভেতরে উঠে গেলেন। আমি ও বাসায় চলে এলাম। পরদিন ছিল শুক্রবার। পাড়ার মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে আমি এক অভিনব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। মসজিদে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একজন প্রার্থী আকস্মিকভাবে মাইক টেনে নিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। তিনি তার মার্কা উল্লেখ করে মুসল্লিদের কাছে দোয়া চান। মসজিদে মন্দিরে গির্জায় নির্বাচনী প্রচার চালানোয় নিষেধাজ্ঞা আছে বলে জানতাম। কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদ করলেন না। আমি আরও বিস্মিত হলাম যখন মোনাজাতের সময় ইমাম সাহেব হাত তুলে অনেকের মার্কা উল্লেখ করে তাদের কামিয়াবি চেয়ে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তাদের সবাইকে নির্বাচনে কামিয়াব করে দাও।’
চাচাকে কথাটা জানাতে চাচা বললেন, মসজিদে যিনি মুসল্লিদের কাছে দোয়া চেয়েছেন, তাকে আমি চিনি। তিনি মুসল্লিদের কাছে ভোট চাননি, দোয়া চেয়েছেন। সুতরাং নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করেননি।
কিন্তু মসজিদের ইমাম সাহেব যে মার্কা উল্লেখ করে সবার কামিয়াবি চাইলেন, এটা কেমন কথা?
তিনি যদি আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীদের কামিয়াবি চেয়ে থাকেন তাহলে ঠিক আছে, কিন্তু একই সঙ্গে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের কামিয়াবির জন্য মোনাজাত করে থাকলে তা ঠিক নেই।
এটা আপনার কেমন কথা হলো?
আমি ঠিকই বলেছি। ইমাম সাহেব একই সঙ্গে উভয় দলের সাফল্য কামনা করে মোনাজাত করতে পারেন না। সেটা অ্যাবসার্ড। একই পদে দুদলের দুজন মেয়র প্রার্থী জিতবে কীভাবে?
আমি বললাম, চাচা! পত্রিকায় দেখলাম বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সরাসরি ভোট চেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকন। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মিজানুর রহমান মোনাজাতে সাঈদ খোকনের জন্য দোয়া চান। এটা কী ঠিক হলো?
কেন ঠিক হবে না?
ইমাম সাহেব তো অন্য কোনো দলের প্রার্থীর জন্য দোয়া চাননি।
তোমার ঘাড় থেকে বিএনপি’র ভূত কিছুতেই নামছে না। তুমি কি চাও ইমাম সাহেব বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর জন্য দোয়া চাইবেন? কখনোই তা হতে পারে না। যারা সন্ত্রাসী ও নাশকতা সৃষ্টিকারী তাদের জন্য ইমাম সাহেব কখনো মোনাজাত করতে পারেন না। তার মোনাজাত শান্তির জন্য, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও নগরবাসীর মঙ্গলের জন্য।
চাচা! নির্বাচন কমিশন বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করেছে।
কমিশন ঠিক কাজটিই করেছে। খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বেরোতে দেয়া ঠিক হয়নি। বালির ট্রাকগুলো এখন কোথায় গেল? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না।
তারা কি দোষ করল?
খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারে আদালতের আদেশ পালন করলেই সব ল্যাঠা চুকে যেত। নির্বাচনের আগে তা করা উচিত ছিল। তাকে ইচ্ছামত রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন না, সেখানে তিনি দোকানে দোকানে গিয়ে ভোট চাইবেন কেন?
আইনে তো এ বিষয়ে কোনো বাধা নেই।
নির্বাচনী আইন সংশোধন একান্ত প্রয়োজন। তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকলে কেউ নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নিতে পারবেন না, এরকম একটা আইন দরকার।
কথার এ পর্যায়ে চাচি আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। নাশতা ও চা নিয়ে এসে আমাদের সামনে রাখলেন। বললেন, নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ভোটারদের উদ্বিগ্নতা ততই বাড়ছে।
উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বিএনপি কারসাজি করে যতই নির্বাচন ভণ্ডুল করার ব্যবস্থা করুক না কেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার জবাব দিতে প্রস্তুত। চাচা বললেন।
এ কথার অর্থ কী?
বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার কোনো পোলিং এজেন্টই দিতে পারবে না।
কেন?
প্রার্থীরা আত্মগোপনে থেকে জনসমক্ষে না এলেও নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু পোলিং এজেন্টকে তো ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে। সে তো আত্মগোপনে থাকতে পারবে না।
ভোটকেন্দ্রে যেতে তাদের অসুবিধা কী?
চাচা বললেন, পোলিং এজেন্টদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। ওদের প্রায় সবার নামে নাশকতার অভিযোগ রয়েছে। বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনেককে যেমন আটক করা হয়েছে, পোলিং এজেন্টদেরও তেমন ছাড় দেয়া হবে না। অবশ্য বিএনপি আওয়ামী লীগ থেকে পোলিং এজেন্ট হায়ার করতে পারে।
সেটা কিভাবে সম্ভব?
আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্টরাই বিএনপির পোলিং এজেন্ট হিসেবেও থাকতে পারে। ডবল রোল আর কি!
আমি বললাম, চাচা! নির্বাচন কমিশন দেখছি সেনাবাহিনী মোতায়েন সম্পর্কে ‘ইউটার্ন’ নিয়েছে। এটা কেন করা হলো?
ওটা ইউটার্ন নয়, ‘ও’-টার্ন। চাচা জানালেন, ‘ও’-টার্ন হচ্ছে আগে যে স্থানে ছিল চক্রাকারে ঘুরে এসে সেখানেই আছে। ‘ও’ মানে হচ্ছে জিরো, মানে গোল্লা। এটা ‘ইউ’-এর মতো একটা ভাওয়েল। ‘ও’ সম্পর্কে বিশদ কিছু জানতে চাইলে ডিকশনারি দেখে নিও। তোমরা নির্বাচন কমিশনকে যতটা বোকা ভেবেছিলে তারা ততটা বোকা নয়। হু হু!
চাচি বললেন, এটা তো একটা ফাঁকিঝুঁকির ব্যাপার হলো। অনেকে বলছেন সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটা হচ্ছে আইওয়াশ।
চাচা রহস্যজনক হাসি হাসলেন। বললেন, আইওয়াশ খারাপ কিছু নয়। চোখে ময়লা পড়লে আইওয়াশ তো করতেই হবে। তবে নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েন সম্পর্কে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। আওয়ামী প্রার্থীরা সেনা মোতায়েন চাচ্ছিলেন না, বিএনপি প্রার্থীরা সেনা মোতায়েনের পক্ষে ছিলেন। নির্বাচন কমিশন এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে।
এর অর্থ কী?
এর অর্থ হচ্ছে নির্বাচনে সেনাবাহিনী আছে, আবার নেইও। বিএনপির জন্য বার্তা হচ্ছে, নির্বাচনে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েন আছে। তাদের ডাকা হলে তারা চলে আসবে। আর আওয়ামী লীগের কাছে বার্তা হচ্ছে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী ভোটকেন্দ্রে বা রাস্তায় নেই। তারা সেনানিবাসেই থাকবে, এখন যেমন আছে। সুতরাং চিন্তার কোনো কারণ নেই।
তোমার এ কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলাম না। চাচি বললেন।
বন্যরা বনে সুন্দর, সৈন্যরা সেনানিবাসে। চাচা মৃদু হাসলেন।

No comments

Powered by Blogger.