মার্কিন ব্লগারকে বাংলাদেশে কেন কুপিয়ে হত্যা করা হলো! by ইশান থারুর

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও নাস্তিক অভিজিৎ রায়। বৃহস্পতিবার রাতে অজ্ঞাত আততায়ীরা তাকে ঘিরে ধরে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে ঢাকার রাজপথে। তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে আছেন। তিনি এখন জীবনের সঙ্গে লড়াই করছেন। সামাজিক মিডিয়া খুললেই তাতে ঘটনার অব্যবহিত পরের ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাবেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, রক্তের ভেতর পড়ে আছেন অভিজিৎ। এর পাশে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্ত্রী। বার্তা সংস্থা এপি’র মতে, আগে থেকেই পরিচিত ইসলামপন্থি জঙ্গি গ্রুপ আনসার বাংলা ৭ এ ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। তারা টুইটারে বলেছে, ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধের কারণে টার্গেট করা হয় অভিজিৎ রায়কে। তিনি বসবাস করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ঢাকায় গ্রন্থমেলা উপলক্ষে এক সপ্তাহ আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি একজন প্রকৌশলী। জনপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগ চালু করেছিলেন। মানবতাবাদী ও সহনশীলতার জন্য তিনি অর্জন করেন সুনাম। তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাভাবনায় বিশ্বাস করেন। তাই হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে সে সংক্রান্ত কোন গোঁড়ামি ছিল না। তার বন্ধুরা বলেছেন, ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করায় মৌলবাদীরা তাকে অনেকবার হত্যার হুমকি দিয়েছে। অভিজিৎ তার ফেসবুকে লিখেছেন- আমি মুক্তচিন্তা ভীষণ পছন্দ করি। আমি নাস্তিক্যবাদী, দর্শন, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা ও মানুষের অধিকার পছন্দ করি। তার ব্লগ মুক্তমনাতে ৪২ বছর বয়সী অভিজিৎ মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি স্কুলে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। প্যারিসে বিদ্রূপ ম্যাগাজিন চার্লি এবদো অফিসে হামলা হয়েছে। এমন অবস্থায় টুইটারে ধর্মকে ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করেন অভিজিৎ রায়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমনিতেই খুব জটিল। তার মধ্যে এমন মন্তব্য খুবই বিপজ্জনক। বিশ্বের সবচেয়ে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এখানে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম। ২০১৩ সালে ধর্মনিরপেক্ষ আরেক ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দারকে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ সপ্তাহে অভিজিতের মৃত্যুতে  মুক্ত মত প্রকাশের ক্ষেত্রে একই রকম অবস্থা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত এক লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে অর্জন করে স্বাধীনতা। এখানে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার এক রীতি। বাংলাদেশে ধর্মের অবমাননা নিয়ে কোন আইন নেই। নেই কোন সরকারি শরিয়াভিত্তিক আদালত।
এ দেশে ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দমনপীড়ন চালাচ্ছেন। এ নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা আছে। যাদের বিরুদ্ধে এমন দমননীতি চালানো হচ্ছে তার মধ্যে আছেন সুপরিচিত কিছু রাজনীতিক। তারা চার দশক আগে স্বাধীনতা যুুদ্ধের সময় এর বিরোধিতা করেছিল। এই দমননীতির প্রতি ২০১৩ সালে ব্যাপক গণতন্ত্রপন্থির সমর্থন প্রকাশ পায়। তারা মৌলবাদ বিরোধী বিক্ষোভ করে। অভিজিৎ রায়ের মতো মুক্ত চিন্তার মানুষদের সহযোগিতা করেননি শেখ হাসিনা। অভিযোগ আছে, তিনি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছেন, যেখানে ভিন্নমতাবলম্বী ও মুক্ত মত প্রকাশের ধারাকে খর্ব করা হচ্ছে। দেশের প্রধান ইসলামপন্থি দল সহ তার প্রধান বিরোধী দলকে জাতীয় সংসদের বাইরে রাখা হয়েছে। এতে প্রান্তিক পর্যায়ে যেয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। এতে করে জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্রবাদ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ফলশূন্য রাজনৈতিক বিষাক্ত সংস্কৃতি বিদ্যমান। বিচারবহির্ভূত সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ও রাজপথের বিক্ষোভের ইতিহাস পাল্টে দেয়া হয়েছে এখানে। ওইসব ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনকে অচল করে দিয়েছে। ইসলাম নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অভিজিতের খুনিরা তাকে হয়তো ঘৃণার চোখে দেখে থাকতে পারে। কিন্তু তারা যে কাজ করেছে তা সুদূরপ্রসারি, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। লন্ডনভিত্তিক ভারতীয় সাংবাদিক সলিল ত্রিপাঠি লিখেছেন-বাংলাদেশ এমন একটি দেশ হয়ে উঠছে, যেখানে খুনিরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। তারা খুন করছে দায়মুক্তভাবে। এখানে লেখকদের বাধ্য করা হচ্ছে তারা কি বলে তা শুনতে ও তাদের চিন্তাভাবনাকে মনের গহিনে অবরুদ্ধ রাখতে।
ইশান থারুর বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের সাবেক সিনিয়র সম্পাদক। তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ে লিখছেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে।
(ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.