নারী ভাষাসংগ্রামীদের না বলা কথা by তানজিনা হক বিয়াস

বাহান্ন সালে যখন ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে, সেই সময়টাও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের জন্যও অনুকূল ছিল না। প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে জরিমানা করা হতো। তা সত্ত্বেও ছাত্রীরা ছাত্রদের সঙ্গে একই উদ্দেশ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ জনের মতো ছাত্রী ছিলেন, ৩০ জন ছাত্রী থাকতেন হোস্টেলে। তখনও রোকেয়া হলের নামকরণ হইনি, হোস্টেলটির নাম ছিল 'ওমেন স্টুডেন্ট রেসিডেন্স'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রীরাসহ অন্য ছাত্রীরাও ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব পালন করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২১ ফেব্রুয়ারির হরতালকে সফল করার জন্য দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি চলে। এ প্রস্তুতিতে ছাত্রীরা ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন বকশীবাজার কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ), মুসলিম গার্লস স্কুল, কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মেয়েদের আন্দোলনের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ছিল প্রচুর অর্থের প্রয়োজন এবং সে প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন ছাত্রীরাই। তারা চাঁদা তুলতে কলোনিতে, পাড়ায় পাড়ায় যেতেন। কী আশ্চর্যও ! সেদিন ঘরের সাধারণ নারীরাও ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কখনও নিজের আঁচল থেকে আবার কখনও ঘর থেকে পয়সা এনে ছাত্রীদের হাতে তুলে দিতেন।
২১ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনের সেই আগুনঝরা দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কলাভবনের আমতলায় ছাত্রসভায় সিদ্ধান্ত হয়, ছেলেরা বের হবে ১০ জনের ছোট দলে এবং মেয়েরাও বের হবে ৪ জনের ছোট দলে। যতদূর জানা যায়, মেয়েদের দলের প্রথমটিতে ছিলেন ড. শাফিয়া খাতুন, ড. সুফিয়া আহমেদ, শামসুন নাহার (যিনি বোরখা পরতেন) ও রওশন আরা বাচ্চু। এভাবে অনেক ছাত্রীই দলে দলে বের হয়ে আসেন এবং তারা অনেকেই আহত হন। ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সেদিন ৫২ জনের মতো ছাত্রী সেই আন্দোলনে যোগ দেন।
সেই নারী ভাষাসংগ্রামীদের কয়জনের কথা আমরা জানি। তাদের একজন জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছিলাম। জানলাম, আইনজ্ঞ বাবা ইব্রাহিম আহমেদের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা সুফিয়া আহমেদকে অনুপ্রাণিত করে জাতীয়তাবাদের আদর্শে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের ছাত্রী ছিলেন তিনি। দেশমাতৃকার প্রয়োজনে হয়েছিলেন 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' আন্দোলনে অংশীদার। ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধকরণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে রাজপথে নামেন এবং পুলিশের নির্যাতনে আহত হন। তিনি ২০০২ সালে একুশে পদক পান। তার নামে ঢাকা শহরে একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে।
সুফিয়া আহমেদের কাছেই জানলাম, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রথম যে ছাত্রী দলটি বেরিয়ে আসে, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের জিএস ভাষাসংগ্রামী শাফিয়া খাতুন। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের হামলার পর ২২ ফেব্রুয়ারি তার সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের এক প্রতিবাদ ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জানলাম, আরও দুই ভাষাসংগ্রামী শামসুন নাহার বেগম ও রওশন আরা বাচ্চুর কথা।
আরও যেসব নারী ভাষাসংগ্রামী পঞ্চাশের দশকের রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রদের পাশাপাশি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। গড়ে তুলেছিলেন নারী প্রগতির মাইলফলক। তবুও এই গৌরবগাথা আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে উপেক্ষিত, তাদের অবদানের ইতিহাসে বিস্মৃতির ধুলোবালি জমে গেছে। আজ আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীদের এই অবদানকে স্মরণীয় এবং বরণীয় করে রাখা।

No comments

Powered by Blogger.