ভিন্নমত পোষণকারী ও রাজনৈতিক নেতারা নিরাপত্তাহীন -বৃটিশ হোম অফিসের প্রতিবেদন

বাংলাদেশে সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতারা নিরাপত্তাহীন। স্বাধীন মত প্রকাশের স্থান সঙ্কুচিত হয়েছে। বিরোধী দলপন্থি ব্যক্তিদের টক শোতে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্পাদকরা রয়েছেন প্রচণ্ড চাপে। সরকারের সমালোচনা করা হয় এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ না করতে এই চাপ দেয়া হচ্ছে। সরকারের সমালোচনা করায় অনেক সাংবাদিককে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। আইসিটি এ্যাক্ট ও সম্প্রচার নীতিমালা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। সরকার নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ কয়েক হাজার মামলা তুলে নিলেও অন্য দলের কারও কোন মামলা প্রত্যাহার করেনি। সরকার সমর্থকদের পেট্রোল বোমা সহ পুলিশ ধরলেও তাদের ছেড়ে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের  হোম অফিস বাংলাদেশ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। ২৬ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় গত সোমবার। এর শিরোনাম ‘কান্ট্রি ইনফরমেশন অ্যান্ড গাইডেন্স, বাংলাদেশ: অপজিশন টু দ্য গভর্নমেন্ট’। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা দ্বারা যারা প্রকৃতপক্ষেই বিচারের সম্মুখীন তাদের সুরক্ষা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশের পুলিশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিরোধী রাজনীতিক, নারীর সুরক্ষা ও সহিংসতা দমনে ব্যর্থ। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এক্ষেত্রে তাদেরকে দেয়া হয়েছে  দায়মুক্তি। তারা স্বীকারোক্তি আদায়ে নির্যাতন করে। এছাড়া বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও তারা জড়িত। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার নিজ দলের নেতাকর্মীদের মোট ৭১৭৭টি মামলা প্রত্যাহার করেছে গত ৫ বছরে। এর মধ্যে রয়েছে কমপক্ষে ১০টি হত্যা মামলা। এ ক্ষেত্রে অন্য দলের কোন নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয় নি। বলা হয়, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার নেপথ্যে আছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা, সরকার ও বিরোধী দলের নেতাকর্মী, ছাত্রসংগঠনগুলো। জানুয়ারির শেষ নাগাদ এতে বিএনপির কমপক্ষে ৭০০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৭ জন। দেশের উত্তর অঞ্চলে বিরোধী দল সমর্থন করেন এমন ব্যক্তিদের বাড়িঘর ও দোকানপাঠ ভাঙচুর করা হয়েছে। দমনপীড়নের ফলে নারী ও শিশুসহ শত শত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যখন যে দলই ক্ষমতায় যায়, সেই দলের ছাত্রসংগঠনের অস্ত্রধারীরা মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় লঙ্ঘনকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। খুন, হত্যা, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে গত বছর ছাত্রলীগ বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ছয় মাসে ছাত্রলীগ ২৫০ বার নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। অন্য সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে ১৫০ বারের বেশি। অস্ত্রধারী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার বড় কারণ। বাংলাদেশের কোন নাগরিক যুক্তরাজ্যে মানবিক বা রাজনৈতিক বিবেচনায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চাইলে তা কিভাবে দেখা হবে- এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কি কি করণীয় তা নির্ধারণ করতে ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে গত বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের বাংলাদেশের অবস্থা। এতে বলা হয়েছে, ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। জাতীয় সংসদে কোন আসন নেই এখন তাদের। তা সত্ত্বেও তারা এখনও প্রধান বিরোধী পক্ষ। এ বছরের ৫ই জানুয়ারি ছিল ওই নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি। এ উপলক্ষে বিএনপি সমাবেশ আহ্বান করে। কিন্তু ঢাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয় থেকে বের হতে দেয়া হয় নি। এতে সৃষ্ট ঘটনায় নোয়াখালীতে দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে। সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অনেক মানুষ। বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের লোকজন পেট্রলবোমাসহ ধরা পড়েছে। কিন্তু পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় নি। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৩-১৪ সময়ের প্রায় পুরোটা ও এ বছরের শুরুতে হয়রান, খেয়াল খুশিমতো গ্রেপ্তার, আটক, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ফাঁসির রায় দিয়েছে বিরোধীদলীয় বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীরা বলছেন, এ বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাদের অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবহার করছে সরকার। এতে রাজনৈতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে তাদের মানবাধিকার বিষয়ক কান্ট্রি রিপোর্টে বলেছে, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা। দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের কাছে ওই নির্বাচন ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু। একই সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের জন্য নাগরিকদের অধিকার দিয়েছে সংবিধান। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ, এনএসআই ও একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে নিয়োজিত রাখা হয়েছে সরকারের সমালোচকদের দিকে নজর রাখতে। একই সঙ্গে বিরোধী রাজনীতিকদের দিকে সরকার নিয়মিতভাবে নজরদারি করে থাকে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, ওই সংসদের বেশির ভাগ সময় সংসদে অনুপস্থিত ছিল। ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস রিপোর্ট করে যে, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে তৎকালীন ১৮ দলীয় বিরোধী জোট। ওই নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনের প্রার্থী নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে। ওই নির্বাচনের দিন নিহত হন ২১ জন। শতাধিক স্কুলে স্থাপিত ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ‘অধিকার’ গত বছর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস করা হয়েছে। মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুুক্তি আইন। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে সরকার অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার। এর মাধ্যমে অনেক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে জেলে রাখা হয়েছে। দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি ও ইসলামী টিভির সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সভা-সমাবেশে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যেসব মানুষ বিকল্প চিন্তায় বিশ্বাস করে তাদের ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়ে চাপে রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে জাতীয় সংসদকে। এর ফলে এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা সহ এনজিওগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ ফরেন ডোনেশনস রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুমোদন দিয়েছে। এ আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতার লঙ্ঘন করবে। এ আইন নিয়ন্ত্রণ করবে মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে, যা বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ঘোষণার পরিপন্থি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াট তার ২০১৪ সালের বার্ষিক রিপোর্টে বলেছে, সমালোচকদের দমনপীড়ন করার লক্ষ্যে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ধারা এর আগের বছরও ছিল। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে বলেছে, রাজনৈতিক প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও অস্থিরতার সময় সমাবেশের স্বাধীনতা সীমিত করতে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ‘অধিকার’ এক রিপোর্টে বলেছে, ক্ষমতাসীন দল একই দিনে তাদের কর্মসূচি ঘোষণায় সহিংসতার আশঙ্কায় অনেকবার জারি করেছে ১৪৪ ধারা। এতে অনেকবার বিরোধীদের সভা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু যখন শুধু বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার জন্য আইন ব্যবহার করা হয় তখন তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। সরকার বিরোধীদের সমাবেশ বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের পাঠিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। এতে শুধু সমাবেশ করার স্বাধীনতাই লঙ্ঘিতই হয় না, একই সঙ্গে এতে আইন প্রয়োগকারীদের ক্ষমতার অপব্যবহারও হয়। পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সংসদে কোন প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও, বিএনপিই দেশের সত্যিকার বিরোধী দল। জাতীয় পার্টি ৩৪ আসন নিয়ে বর্তমানে সংসদে প্রধান বিরোধী দল। তবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সরকার মেনে না নেয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করার কারণেই জাতীয় পার্টি আজকের অবস্থানে। ঢাকা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট যদিও ২০ দলীয়, তবে এর মধ্যে এমন কিছু দল আছে, যারা নামেমাত্র দল। এদের কয়েকটি দল বিএনপি’র সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আরেকটি জোট গঠন করেছে। তবে সংবাদ সম্মেলন করা ছাড়া প্রতিষ্ঠার পর ওই জোটের তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কর্মকাণ্ড নেই। একই পত্রিকার আরেকটি প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, নির্বাচনের পর থেকে ২০১৪ সালের শেষ কয়েক মাস বিএনপির কর্মকাণ্ড অভ্যন্তরীণ সভা ও সংবাদ সম্মেলনেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিএনপির একমাত্র দৃশ্যত কর্মকাণ্ড ছিল, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মাসে এক-দুবার ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে সভা করা। ২০১৩ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস শীর্ষক প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মাঝেমাঝে বিরোধী দলের সদস্যদের গ্রেপ্তার ও বিচারের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয়। তবে কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারণেই কোন ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয় থেকে নিরাপত্তা বাহিনী বের হতে না দেয়া ও ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, নির্বাচনের বর্ষপূর্তির আগে বিএনপির ২ জ্যেষ্ঠ নেতাসহ ৪০০ সমর্থককে আটক করেছে সরকার। এছাড়া ৬ই ফেব্রুয়ারি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে আটক করা হয়েছে। তার আগের দিন আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে চার বিএনপিকর্মী। ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা তুলনামূলকভাবে খুব বেশি। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ ২০১৩ সালে বিভিন্ন সংঘর্ষে প্রায় ৫০০টি মৃত্যু ও ২৪০০০ মানুষের আহত হওয়ার বিষয়টি বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেছে। সে সময় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, মামলা ও হয়রানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ফরেইন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস জানিয়েছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে মারাত্মক আকারে সহিংসতা হয়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ২০১৩ সালে ৫০০ মানুষ বিভিন্ন সংঘর্ষে নিহত হয়েছে। নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে ২১৫ জন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, বিরোধীদলীয় কর্মীরাও ব্যাপক সহিংস কর্মকাণ্ড করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার পাশবিক অভিযান চালিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কিভাবে বিরোধী কর্মীদের ওপর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ও গুম করেছে, সংস্থাটি তা লিপিবদ্ধ করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীকে বৈষম্যমূলকভাবে ব্যবহার, বিরোধী সমর্থকদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি উঠে এসেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, নির্বাচনের সময় বিভিন্ন সংঘর্ষে অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়েছে পুলিশের সঙ্গে বিরোধী কর্মীদের সংঘর্ষে। এর বাইরেও নিরপেক্ষ উৎস থেকে যাচাই করা না হওয়ায় বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যুক্ত করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে নিহতদের পরিবার ভয়ে সহায়তা করতে রাজি হয়নি। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে যথাক্রমে ২৮ ও ৬ ব্যক্তি নিহত এবং ২৯৮০ ও ১৫৯২ জন আহতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে অধিকার। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১০৮ ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, এদের বেশির ভাগই বিরোধীকর্মী। এ সময় সাত ব্যক্তিকে র‌্যাব ও পুলিশ নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এছাড়া জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যালয়ের উদ্বেগ প্রকাশের বিষয়টিও উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে। সেখানে জাতিসংঘ বলেছিল, ২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এক ডজনেরও বেশি বিরোধীকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ২১শে জানুয়ারি প্রকাশিত বিবিসির প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তখন পর্যন্ত ৭ হাজারেরও বেশি কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, পেট্রলবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় জড়িতদের সবাইকে পুলিশ আটক করে না। বাসে বোমা নিক্ষেপের অনেক ঘটনা পুলিশের উপস্থিতিতে ঘটেছে। অনেক সময় স্থানীয় জনতা শাসক দলের সদস্য বিভিন্ন বোমাবাজদের ধরে পুলিশে তুলে দিলেও, পরে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিয়েছে। উত্তরাঞ্চলে যৌথবাহিনীর অভিযানে মানুষ ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এছাড়া বিরোধী সমর্থকদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর সশস্ত্র ও সহিংস কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা
‘অধিকার’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যাপক সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলাগুলো ২০১৩ সাল জুড়ে প্রত্যাহার করতেই থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ মানবাধিকার গ্রুপগুলোর। গত বছর সেপ্টেম্বরে ডয়েচে ভেলে তার রিপোর্টে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সম্পর্কে বলে, খালেদা জিয়া ও তার তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে দুটি দাতব্য সংস্থা থেকে অর্ধ মিলিয়ন ডলারের বেশি আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। প্রসিকিউটরদের মতে, এতে তাকে দোষী প্রমাণ করা গেলে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর যাবজ্জীবন জেল হতে পারে। গত ৫ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা নির্বাচিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই ৬৯ বছর বয়সী ওই নেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। তবে খালেদা জিয়া ও তার পক্ষ দাবি করছেন, এ অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার আপিল আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
যুদ্ধাপরাধের বিচার
দ্য ফ্রিডম হাউজ ২০১৪ রিপোর্টে বলেছে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ২০১০ সালে গঠন করে আওয়ামী লীগ সরকার। এতে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতার শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়। তার কোন কোনটার রায় নিয়ে শাহবাগের আন্দোলনের কথাও তুলে ধরা হয়। এর ফলে একজন নেতার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পরে মৃত্যুদণ্ডে রূপ নেয়। তা কার্যকরও করা হয়েছে। এই আদালতের মানদণ্ড আন্তর্জাতিক মানের করার দাবি বিভিন্ন আইনজীবী, মানবাধিকার গ্রুপের। কিন্তু তা অনুসরণ করা হয় নি। অভিযুক্তরা আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ পান নি। তাদের জামিনের অধিকারও দেয়া হয় নি। এতে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের উদ্বেগ  দেখা দেয়। উদ্বেগ রয়েছে সাক্ষী ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের নিরাপত্তা নিয়ে।
সাংবাদিকতা
ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ২০১৪- রিপোর্টে বাংলাদেশ নিয়ে বলা হয়েছে, যৌক্তিক বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে সংবিধান। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহ ও অপরাধ বিষয়ক আইনে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা সংক্রান্ত বিধিতে মিডিয়াকে বিরত রাখা যেতে পারে। কিন্তু তা মাঝে মাঝেই সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও বিচারে দাঁড় করাতে ব্যবহার করা হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহ বিষয়ক আইন ব্যাপক পরিসরে ব্যবহার করা যায়। তবে ২০১১ সালের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি করা হয়েছে তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতার অধীনে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে সাংবাদিকদের। এর অধীনে বিচার ছাড়াই ৯০ দিন আটক রাখা অনুমোদিত। অথবা তাদেরকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা যেতে পারে। গত কয়েক বছরে বিরোধী দল সমর্থিত পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ আইনগত ও বিধিবদ্ধ হুমকিতে পড়েছে কয়েক বছর। এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বড় অংশীদার মাহমুদুর রহমানকে আটক করা হয়েছে ২০১৩ সালের এপ্রিলে। তার পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের কারণে ধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ করা হয়েছে। এ অভিযোগের তদন্তকালে তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। ২০১০-১১ সালে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করা ও ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তিনি ১০ মাস জেল খেটেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৩ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেশ কিছু সাংবাদিক ও মানবাধিকার বিষয়ক এনজিওর দেয়া তথ্যমতে- সরকারের শাস্তির ভয়ে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করেছেন। যদিও প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা সাধারণ একটি বিষয়, তবু মিডিয়া- বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়া সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। এর পরিণামে মিডিয়া সেলফ সেন্সরশিপ প্রয়োগ করে। পূর্ববর্তী সরকারের মতো, এ সরকারও রাজনৈতিক নেতা ও সমর্থকদের জন্য ব্রডকাস্ট লাইসেন্স ইস্যু করেছে। সাংবাদিকরা পুলিশের হাতে হয়েছেন শারীরিক হামলা, হয়রান। তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেছে পুলিশ। অধিকারের মতে, ওই বছর জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ১৪৪ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, দু’ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা হামলা করেছে ৩৯ জনের ওপর। রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন অপরাধীর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন ২৩৪ জন। গত ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। এতে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, বার্গম্যানকে অভিযুক্ত করার মাধ্যমে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি একটি শীতল বার্তা দেয়া হয়েছে। তাহলো- আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সমালোচনা সহ্য করবে না। গত মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, সম্পাদক ও নির্বাহীরা সরকারের পক্ষে যায় না এমন রিপোর্ট কভার করার জন্য হয়রানি হতে হয়েছে। যৌনতা বিষয়ক একটি প্রোগ্রাম প্রচারের অভিযোগে একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যানকে গত ৬ই জানুয়ারি আটক করা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সম্পাদকদের ওপর সরকারের সমালোচনা যাতে না করা হয় সে জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। যারা বিরোধী দলপন্থি তাদেরকে টক শো’তে অংশ নেয়া থেকে বাধা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে অনলাইনে যারা সক্রিয় তাদের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। গত মার্চে চট্টগ্রামের দুই টিনেজার তাদের ফেসবুক একাউন্টে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানে এমন পোস্ট ছাড়ার কারণে সহিংস আক্রমণের শিকার হয়। পুলিশ হস্তক্ষেপ করার আগে রাস্তায় প্রহার হরা হয় তাদেরকে। পরে তাদেরকেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুুক্তি আইনের আওতায় আটক করা হয়। জামিন বাতিল করা হয়।
মানবাধিকার বিষয়ক কর্মী
‘অধিকার’-এর ২০১৪ সালের জানুয়ারি-জুন রিপোর্টে বলা হয়, যেকোন  প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তি যদি সরকার বা সরকারের কোন প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে বা মতামত প্রকাশ করে তাহলে সে বিষয়ে কর্ণপাত করে না সরকার। উল্টো সরকার চরম আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ওইসব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বা ব্যক্তির সঙ্গে যেকোন উপায়েই হোক জঙ্গি যোগসূত্র খুঁজে বেড়ায় সরকার। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অন্য কোনভাবেও হয়রানি করা হয়। এক্ষেত্রে মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের মূল টার্গেটে রয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.