অপচয়ের এত্ত সম্পদ!

বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের সারিতে নেই। মধ্য আয়ের দেশও নয়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিতদের তালিকাতেও নেই। ১৬ কোটি লোকের দেশটির অবস্থান স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায়। একটি সুন্দর স্বপ্ন আছে অবশ্য_ ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। তবে তখনও মধ্যমদের মধ্যে উত্তম অবস্থানে নয়, বরং কোনোক্রমে কায়ক্লেশে স্থান করে নেওয়াই হবে লক্ষ্য। এমন একটি দেশের সম্পদের যেন বিন্দুমাত্র অপচয় না হয়, যেখানে যা কিছু আছে তার সবটা যেন উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজে লাগানো সম্ভব হয় সেটা নিশ্চিত করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হওয়া উচিত। যারা রাজনীতি করেন, দেশের কর্ণধার রূপে যারা দাবি করেন, তাদের কাছে এ বিষয়ে প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা কেবল নীতিনির্ধারণ করবেন না, জনগণকে পথ দেখাবেন। তারা সরকারি দল হিসেবে কাজ করুন কিংবা অবস্থান থাকুক বিরোধীদলে, দেশের স্বার্থের চেয়ে তো বড় কিছু হতে পারে না। কিন্তু বাস্তব অবস্থা সেটা বলে না। বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, পাঁচ জানুয়ারি থেকে চলা ২০ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে ৫২ দিনে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আমাদের অপচয় করার মতো এত্ত সম্পদ! এ অর্থে অন্তত ৫টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায়। এক বছরের বাজেটের অর্ধেক মিটে। এ সময়ে শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ও আশপাশের পরিবেশ পেট্রোল বোমার হামলার শিকার অনেক অনেক নারী-পুরুষ-শিশুর আহাজারি-আর্তনাদে দিনের পর দিন ভারি থাকছে। তাদের চিকিৎসার ব্যয় আছে। পুনর্বাসন কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে উৎকণ্ঠা নানা মহলে। প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক পরীক্ষা কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। পাঠে মনোযোগ দিতে পারছে না ছাত্রছাত্রীরা। ব্যবসায়ীরা পালা করে তাদের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরছেন গণমাধ্যমে। একটি স্বল্প আয়ের দেশের পক্ষে এমন ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব? এটা ঠিক যে, আন্দোলনের পালে জোর হাওয়া নেই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নেতাদের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা অনেকটা নিয়ম রক্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অজ্ঞাত স্থান থেকে বিবৃতি-বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয় কর্মসূচি। সেটা ব্যাপক প্রচার পায়। কর্মসূচির সপক্ষে জনমত তৈরির কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। যদি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে হরতাল-অবরোধ আহ্বানের কর্মসূচি প্রচার না করে তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেটা অনুমানের বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, 'হরতাল-অবরোধ আহ্বানের গণতান্ত্রিক অধিকার' গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়। জনগণ তাতে সক্রিয় সাড়া দিলেও এক ধরনের উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্যোক্তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কবে এ অবস্থার শেষ হবে, কেউ বলতে পারে না। এখন ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে সেটা মূলত দৃশ্যমান। এর বাইরেও আছে অদৃশ্য ক্ষতি। আরও আছে ক্ষতির প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতি। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদানের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী। ছাত্রছাত্রীরা সময়মতো পরীক্ষা দিতে পারছে না। তাদের শিক্ষা জীবন দীর্ঘায়িত হবে। যে সময়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করার কথা, তাতে বিলম্ব ঘটবে। তাদের শ্রম-মেধা আরও কিছুটা সময় অলস পড়ে থাকবে। যারা বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের সারিতে নিয়ে যেতে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখছেন তারা এ পরিস্থিতিতে হতাশ বোধ করবেন। নতুন প্রজন্ম প্রিয় স্বদেশভূমির ওপর আস্থা হারাবে। যাদের সুযোগ রয়েছে তারা চাইবে এমন অনিশ্চয়তায় ভরা দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচতে। তাতে দেশের ক্ষতি হয় হোক, কিন্তু নিজের ভাগ্য তো ফেরানো যাবে। যারা টানা কর্মসূচি দিয়ে চলেছেন তারা বলছেন না কীভাবে এসব ক্ষতির পূরণ করা সম্ভব হবে। তারা কেবল বলছেন, ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলে 'দেশ ও দেশবাসীর যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের অবসান' ঘটবে। কিন্তু তাতে আমজনতার ভরসা আছে বলে মনে হয় না। যারা ক্ষমতায় আছেন তারাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। বিরোধীরা তাদের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেছে, তাতে সফল হতে পারছে না। কিন্তু স্বাভাবিক ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনতে এখনও যে তাদের অনেক কিছু করার বাকি। সে জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণটাই-বা কোথায় দাঁড়াবে?

No comments

Powered by Blogger.