গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতে পারে না by ডক্টর কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বীরবিক্রম

৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের ফলে দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় ৯৩-৯৫ ভাগ জনগণ এই নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত ছিল। সরকার পরিচালনায় জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। জনগণ এখন সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরকার বিরোধী দলের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে সমগ্র পৃথিবীর কাছে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটকে সন্ত্রাসী জোট বা দল হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে বিএনপির জন্ম হয়েছিল। বিএনপি কখনো অসাংবিধানিক-অনিয়মতান্ত্রিক বা জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত ছিল না, বর্তমানেও নেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম ১৯৭৫ সালের পরে এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে করে জনগণের মতায়ন নিশ্চিত হয়, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুরূপভাবে ১৯৯১ সালের পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির আইন পাস করা হয়। সুতরাং বিএনপির জন্মলগ্ন থেকে এই পদক্ষেপগুলোর সুষ্ঠু বিশ্লেষণ করলে এটি সহজেই অনুমেয় বিএনপি বা ২০ দলীয় ঐক্যজোট সদাসর্বদা জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল এবং এখনো এই নীতিতে অটল আছে।
আমি দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৭৬ সালে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অনেক সদস্য ভারতে আশ্রয় নেন। তারা তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। সরাসরি অস্ত্র হাতে নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে বি’বাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত একধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। সীমান্ত এলাকার জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজেই বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তৎকালীন বিজেপি (ভারত) সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সাহায্যে এই ধরনের হামলাগুলো বন্ধের ব্যবস্থা নেন। ধীরে ধীরে তারা (আওয়ামী লীগ নেতারা) দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং এটা আমাদের জানা ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা বা প্রতিশোধ নেননি। বরং সুনাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান।
সরকার বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে দেশের জনগণের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করে বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছে, সরকার গঠন করছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল দেশকে স্বৈরশাসকের হাত থেকে মুক্ত করা। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় বর্তমানে সরকার এই নীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাদের একমাত্র এজেন্ডা হচ্ছে বিরোধী দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করা, সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই গুলি করা, জোরজবরদস্তি করে মতার অপব্যবহার করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
বারবার বলা হচ্ছে ভিশন ২০২১ ও ২০৪১ সাল। এতে করে তাদের মন-মানসিকতা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কেউ বা আর কোনো দলকে কখনো ক্ষমতায় আসতে দেয়া হবে না। এ ধরনের মন-মানসিকতা এবং মতা কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা থেকে আমাদের সবাইকে বিরত থাকতে হবে।
আমরা কথায় কথায় বলি দেশ সবার কিন্তু আমাদের কর্মকাণ্ডে আমরা মনে করি দেশ আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আমি যা বলি তা সবাইকে মেনে চলতে হবে। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কোনো মতামত দেয়ার অধিকার থাকবে না। জনগণ পুতুলের মতো আমাদের হাতের ইশারায় চলবে।
মুসলমান হিসেবে আল্লাহর ওপরে আমাদের বিশ্বাস কতটুকু আছে তা এখন আমাদের চিন্তাভাবনার বিষয়। আমাদের সবার মধ্যে একধরনের দাম্ভিকতা এবং অহঙ্কার কাজ করছে, যার কারণে দেশে আজ নৈরাজ্য, দলীয়করণ, অশান্তি এবং সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে।
বর্তমানে দেশে কারো জান এবং মালের কোনো নিরাপত্তা নেই। আমাদের অদূরদর্শিতা এবং লোভের কারণে দেশের জনগণ হতাশাগ্রস্ত, তারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা কখনো সুখকর এবং কারো জন্য কাম্য নয়। জোর করে কখনো কেউ পৃথিবীতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি তবে জনগণের ভোগান্তি হয়তো দীর্ঘায়িত হতে পারে। বর্তমানে দেশের রাজনীতি সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর ভর করে চলছে, যা ধর্মীয়ভাবেও মহাপাপ। শুধু নামাজ আর কালেমা পড়লেই মুসলমান হয় না। আমাদের সবাইকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা:-এর নির্দেশিত পথে চলতে হবে এবং জীবনধারণ করতে হবে। এতেই সবার মুক্তি।
সরকারবিরোধী আন্দোলন করার অর্থ জঙ্গিবাদ হতে পারে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতে পারে না। দেশে যখন আন্দোলন সংগ্রাম চলে তখন কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী তাদের নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত হয়। বিরোধী দলকে ধ্বংস করে কখনো গণতন্ত্র সুসংহত কিংবা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যে যখনই সরকারে থাকে তার উচিত হবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়া।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ আগুনে পুড়ে মরছে, গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে। দেখামাত্র গুলির ভয়ে মানুষ আতঙ্কে আছে। কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করছে এবং বিরোধী দলকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। সর্বতোভাবে বিরোধী দলগুলোর রাজনীতি ধ্বংসের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের এই দুরবস্থা, দুঃশাসন এবং একদলীয় শাসনের জন্য দায়ী ভারতের কংগ্রেস সরকার। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণারে লিবিদ্ধ হয়ে থাকবে। তারা আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। কিন্তু কংগ্রেসের সমর্থনের কারণে বাংলাদেশে আজ একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছে। এখন বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ভারতবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করছে। প্রায় ৯০-৯৫ ভাগ বাংলাদেশী জনগণ মনে করে কংগ্রেস সরকারের ভুল অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের জনগণের এই দুরবস্থা। আশা করি ভারতের ইতিহাসের সর্বকালের জনপ্রিয় সরকার এবং জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশের জনগণের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশের জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করার বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকবেন।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি

No comments

Powered by Blogger.