সিলেটে শিশু আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড, অপহরণ ও হত্যার বর্ণনা দুজনের জবানবন্দিতে

নিহত শিশু আবু সাঈদ
সিলেটে স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে (৯) অপহরণ ও হত্যার বর্ণনা উঠে এল পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান ও ওলামা লীগের নেতা এন ইসলাম তালুকদার ওরফে রাকীবের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে।
আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দিতে রাকীব বলেছেন, তাঁদের কাছে স্কুলছাত্র আবু সাঈদ ছিল ‘একটা খানি’ (খাবার)। ‘একটা খানি আছে...’ বলেই অপরহণকারীদের জোটবদ্ধ করা হয়। এ কাজ করেছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘সোর্স’ গেদা মিয়া। পুলিশের ধারণা, এই ‘খানি’ খেতে না পারার কারণেই অপহরণকারীরা শিশুটিকে হত্যা করে।
আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান গত রোববার মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার কারণ ও বিবরণ দিয়েছিলেন। কিন্তু সোমবার ওলামা লীগের নেতা রাকীবের দেওয়া জবানবন্দিতে এই ‘খানির’ কথা প্রকাশ পায়। সিলেটের রায়নগরের বাসিন্দা মতিন মিয়ার ছেলে আবু সাঈদ গত বুধবার অপহৃত হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় তার পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। দুদিন পর শনিবার পার্শ্ববর্তী কুমারপাড়ার ঝেরঝেরিপাড়ায় মহানগর পুলিশের বিমানবন্দর থানার কনস্টেবল এবাদুর রহমানের বাসা থেকে সাঈদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই রাতেই এবাদুর, সিলেট জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক রাকীব ও ‘সোর্স’ গেদা মিয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরদিন এবাদুর আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিলে ওই তিনজনসহ ওলামা লীগের আরও একজন নেতা ও অজ্ঞাতনামা আরও একজনকে আসামি করে মামলা করা হয়। আসামি ওলামা লীগের আরেক নেতা হলেন রাকীবের সঙ্গী মহিবুল ইসলাম ওরফে মাসুম। তিনি জেলা ওলামা লীগের প্রচার সম্পাদক।
জবানবন্দিতে এবাদুর বলেছিলেন, ‘বাচ্চাটি (সাঈদ) আমাকে চিনেও ফেলে। টাকাও পাইনি। সবাই সিদ্ধান্ত নিই মেরে ফেলার। আমি পা ধরে রাখি, গলা টিপে ধরে ওরা। লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করি। জানাজানি হওয়ার ভয়ে এক দিন অপেক্ষা করি। পরদিন ধরা পড়ি।’
এবাদুর রহমান,এন ইসলাম তালুকদার,গেদা মিয়া
পুলিশ জানায়, এবাদুর সংক্ষেপে ঘটনার বর্ণনা দিলেও রাকীব বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। রাকীবের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর হলেও সপরিবারে সিলেট শহরতলির শাহপরান এলাকায় বসবাস করতেন।
জবানবন্দিতে রাকীব বলেন, ‘গেদা আমাকে একটা খানি আছে বলে জানায়। কী খানি, জিজ্ঞেস করলে সে বলে আসলে বলবে। পরদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে আমি, গেদা ও অন্য আরেকজন লোক (নাম নেই, বয়স ৩০, লম্বাকৃতির) একত্র হই। গেদা আমাদেরকে একটি বাচ্চার ছবি দেখিয়ে বলে, এই বাচ্চাটিকে অপহরণ করতে হবে। লম্বা লোকটি বলে অসুবিধা নাই হয়ে যাবে। পরদিন বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রায়নগর রাজবাড়ির পাশে সেলুনের সামনে বাচ্চাটিকে অপহরণ করি।’
গেদার সঙ্গে বাচ্চাটির পূর্বপরিচয় ছিল উল্লেখ করে রাকীব জবানবন্দিতে বলেন, ‘গেদার সাথে ছবির বাচ্চার পরিবারের সখ্যতা ছিল। ছবির বাচ্চাটি ওই সময় সেলুনের সামনে আসে। মাসুম (জেলা ওলামা লীগের প্রচার সম্পাদক) ও আমি একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। গেদা বাচ্চাটির সাথে কথা বলে। একটু পর গেদা বলে কাজ হয়ে গিয়েছে। এরপর একটি মোটরসাইকেলে প্রথমে গেদা, মাঝখানে বাচ্চাটি এবং শেষে মাসুম ওঠে। তারা মোটরসাইকেলটি নিয়ে গেদার বাড়ির কাছে চলে যায়। আমাকে রিকশা নিয়ে পেছনে আসতে বলে। সেখানে নিয়ে গেদা বাসার কাছে একটি টিনশেড বাড়িতে বাচ্চাটিকে রাখে। এরপর আমি ও মাসুম একটি ক্যানটিনে খেতে যাই। গেদা কিছুক্ষণ পর আসে। গেদা এবাদকে (কনস্টেবল এবাদুর) ফোন করে বলে বন্ধু নিয়ে এসেছি আমি। এবাদ বাচ্চাকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলে।’
মুক্তিপণের টাকা না দেওয়া ও অপহরণকারীদের চিনে ফেলায় বাচ্চাটিকে খুন করা হয়েছে উল্লেখ করে রাকীব আরও বলেন, ‘গেদার কাছে বিভিন্ন ফোন আসে এলাকা থেকে একটি ছেলে হারানো গিয়েছে বলে। গেদা বাচ্চা উদ্ধার করে দেবে বলে কিছু টাকাও নেয়। এর মধ্যে গেদা ফোনে বাচ্চার আত্মীয় থেকে পাঁচ লাখ টাকা চায় এবং জৈন্তাপুরে টাকা দিতে বলে। সন্ধ্যার দিকে আমরা চলে আসার পর বাচ্চা গেদার তত্ত্বাবধানে ছিল। পরদিন গেদা আরেকজনকে সাথে নিয়ে জৈন্তাপুর টাকার জন্য যায়, আমি রায়নগর সেই সেলুনের সামনে অপেক্ষা করতে থাকি।’
রাকীব বলেন, ‘গেদা জৈন্তা যাওয়ার পর আমাকে ফোন করে বলে অসুবিধা হয়ে গিয়েছে, ওরা পুলিশ নিয়ে এসেছে। গেদা ও আমি এবাদের বাসায় যাই। এবাদের বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় গেদা ও এবাদ বাচ্চাটিকে মেরে ফেলার কথা বলে। এ কথা শুনে আমি নিচে নেমে যাই। কিছুক্ষণ পর গেদা নিচে নেমে এসে কাম খারাপ হয়ে গিয়েছে বলে বাচ্চাটিকে মেরে ফেলার বিষয়টি আমাকে জানায়।’ শনিবার রাতের বেলা গেদা কোতোয়ালি থানায় ফোন করে রাকীবকে নিয়ে আসেন। সেখানে গেদা, এবাদুরের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন রাকীব।
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মো. রহমত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তদন্ত ও আসামিদের জবানবন্দি অনুযায়ী গেদা মিয়াই অপহরণের কাজটি সংঘটিত করেন। এ কারণে গেদাকে গত সোমবার তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মাসুম ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে ধরতে পুলিশ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

No comments

Powered by Blogger.