পুলিশের আটক-বাণিজ্য, স্বজনদের কান্না

গ্রেপ্তার আর হয়রানির আতঙ্কে দিন কাটছে মানুষের। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেক নিরপরাধ মানুষও। কোন কারণ ছাড়াই ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অনেককে। আটকের পর অর্থ আদায় করে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে হরহামেশা। আবার কখনও পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে চালান দেয়া হচ্ছে কোর্টে। রাজধানীর থানাগুলোর এমন চিত্র এখন নিত্যদিনের। রাতে থানায় থানায় দেখা যায় উদ্বিগ্ন স্বজনদের অপেক্ষা, কান্না। যদিও থানা পুলিশের আটক-বাণিজ্য ও হয়রানির কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘থানায় নিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি বা আটকের নামে বাণিজ্য করা হয় না। এ রকম কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।’ সোমবার রাতে রাজধানীর কয়েকটি থানায় রাতভর অবস্থান করে পাওয়া গেছে সাধারণ মানুষের হয়রানির বেশ কয়েকটি ঘটনা।
পল্লবী থানা: রাত গভীর হলেই ব্যস্ত হয়ে উঠে ঢাকা মেট্রোপলিটনের পল্লবী থানা। নিস্তব্ধ নীরব থানায় ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। পুলিশের অভিযানে আটককৃতদের রাখা হয় থানাহাজতে। ভোরের আলো ফোটার আগেই চৌরাস্তার মোড়ে বাড়তে থাকে আটককৃতদের স্বজনদের ভিড়। পল্লবী থানা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে গতকাল থানা এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তাদের আদালতে হাজির করার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চমকে ওঠার মতোই তথ্য পাওয়া গেছে আটককৃতদের স্বজন ও তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। আটককৃতদের মধ্যে রয়েছেন শহীদুল ইসলাম ও রাজু আহমেদ নামে দুই ব্যক্তি। ভোরে শহীদুলকে নাশতা দিতে দেড় বছরের শিশুসন্তানসহ থানায় যান তার স্ত্রী জুলি ও বৃদ্ধা মা। জুলি জানান, শনিবার রাত ১০টায় বাসা থেকে আটক করা হয় শহীদুল ইসলামকে। সঙ্গে তার বন্ধু রাজু আহমেদকেও আটক করে পুলিশ। শনিবার রাতে আটক করলেও তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছে গতকাল দুপুরে। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৬০ ঘণ্টা। জুলি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। টাকা-স্বর্ণ সব নিয়ে গেছে পুলিশ। এখন একটা মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাসেলের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয় বলে জানান তিনি। জুলি বলেন, ‘দুই দিনে থানায় রেখে যেই মারা মারছে। সেইটা চোখে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। গত দুই দিন ধরে থানায় ঘুরতেছি ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু শুধু টাকা চায় আর মামলার ভয় দেখায় পুলিশ। গত সোমবারে স্বামী শহীদুলকে ছাড়াতে পল্লবী থানা পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত সিডি শামীমকে ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন জুলি। তবু ছাড়াতে পারেননি। মিরপুরের এক নম্বর এভিনিউয়ের ত-ব্লকের ৩৩৫ নম্বর বাসায় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে থাকেন শহীদুল ইসলাম। তার পিতার নাম সেলিম বেপারি।’
একইভাবে শহীদুলের সঙ্গে আটক তার বন্ধু রাজুর বোন পুতুল জানান, রাজু একজন গাড়িচালক। মিরপুর ডিওএইসএস এলাকার এক ব্যক্তির প্রাইভেট গাড়ির চালক তিনি। বন্ধুত্বের সম্পর্কের কারণেই ওই রাতে শহীদুলের বাসায় গেলে রাজুকেও আটক করে পুলিশ। থানার সামনে কথা হয় পুতুলের সঙ্গে। রাজুকে ছাড়াতে টাকা দিয়েছেন বলে পুতুল দাবি করেন। তবু তার ভাইকে ছাড়েনি পুলিশ। পুতুল বলেন, ‘ভাইকে ছাড়বে বলছে। সোমবার রাত ১১টায় ৪ হাজার টাকা দিছি। প্রথম বলছে ১০ হাজার টাকা লাগবে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ থানা পুলিশের যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। একটা মানুষ গাড়িতে ওঠাতে পারলেই ৫ হাজার টাকা।
গতকাল ভোরে শহীদুল ও রাজুকে দেখতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন তাদের স্বজনরা। থানার গেটে তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন পুলিশ কনস্টেবল মোবারক ও আনসার সদস্য হারুন। টাকা দিয়েই শহীদুল ও রাজুর সঙ্গে দেখা হয় স্বজনদের। এ সময় তাদের সকালের নাশতা পৌঁছে দেন তারা। মিরপুর-১২-এর সি-ব্লকের তিন নম্বর লাইনের ১৭ নম্বর বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন রাজু আহমেদ।
এদিকে, টাকা লুট বা উৎকোচ হিসেবে গ্রহণের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে এসআই রাসেল বলেন, আওয়ামী লীগের মহানগরের নেতা নগর ইসমাইলের পল্লবীর বাসা থেকে মোবাইল ফোন ও স্বর্ণ চুরি হয়েছে। ওই মামলায় শহীদুল ও রাজুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বাসা থেকে একজোড়া স্বর্ণের দুল আনা হয়েছিল চোরাইকৃত স্বর্ণ কি-না তা যাচাই করার জন্য। যাচাই করে এটি চোরাই না হওয়ায় ফেরত দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। এসআই রাসেল জানান, গতকাল তাদের দুজনকে আদালতে সোপর্দ করে একদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
এদিকে শহীদুলের স্ত্রী জুলি বলেন, কিছুদিন আগে দোকানের জন্য আড়াই হাজার টাকায় একটি পুরনো মোবাইল ফোন কিনেন শহীদুল। এটি যে চোরাই তা জানা ছিল না তার।
পল্লবী থানার পাশের দোকান থেকে স্বামীর জন্য কলা কিনতে কিনতে কাঁদছিলেন কোহিনূর বেগম। তার স্বামী জাহাঙ্গীর হোসেনকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশের অভিযোগ, তিনি বিএনপির রাজনীতি করেন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে গোপালগঞ্জের বাসিন্দা কোহিনূর বেগম বলেন, আমার স্বামী কোন দিন কোন দলের মিটিং-মিছিলে যাননি। আমি তো গত নির্বাচনে ভোট দিছি আওয়ামী লীগকে অথচ আজ আমার এ পরিণতি।
কোহিনূর বেগমের সঙ্গে গিয়েছিলেন আটক জাহাঙ্গীর হোসেনের ভাই আলমগীর হোসেন। তিনি জানান, তার ভাই কাঁচামালের ব্যবসা করেন। পরিবারের সঙ্গে থাকেন মিরপুর-১১-এর স্বর্ণপট্টি এলাকায়। সোমবার বিকাল ৪টায় রিকশাযোগে দোকানে যাওয়ার পথে তাকে আটক করে পুলিশ।
প্রায় একই রকম অভিযোগ আটককৃত ইসমাইল হোসেনের স্বজনদের। পুলিশ জানিয়েছে, ইসমাইল হোসেন রাজনৈতিক নাশকতায় জড়িত। হরতালের সমর্থনে গাড়ি ভাঙচুর করছেন তিনি। তার হাতে খালেদা জিয়ার ছবিসংবলিত ব্যনার ও পেট্রলবোমা পাওয়া গেছে। তাকে সোমবার সকাল ১০টায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে ইসমাইলের স্বজনরা জানিয়েছেন, ইসমাইল রাজনীতি করেন না। তিনি একজন পোশাকশ্রমিক। তার ভাইঝি শাহীনূর মানবজমিনকে বলেন, রাতে পুলিশ মূলত কালশী এলাকায় অন্য আসামিকে ধরতে যায়। সেখানে ওই আসামিকে না পেয়ে পাশের বাসা থেকে চাচাকে (ইসমাইল হোসেন) ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায় থানায়। আমার চাচা কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী কিংবা নেতা নন। শাহীনূর অভিযোগ করেন, ইসমাইলকে রোববার রাত সাড়ে ৯টায় গ্রেপ্তার করলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে তাকে সোমবার সকালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলায় গতকাল ইসমাইলের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় থানার সামনে কথা হয় ইসমাইলের স্ত্রী রুনা ও ভাইঝি শাহীনূরের সঙ্গে। থানার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন নূর হোসেনের স্ত্রী মর্জিনা বেগম। নূর হোসেন রাজনীতি করেন না। বুঝেনও না। তার বন্ধু তাহেরের ভাষায়, নূর হোসেন খুব সহজ-সরল ছেলে। রাজনীতি কি জিনিস ভাল বুঝে না। তিনি জানান, নূর হোসেন মিরপুর ডিওএইচএসের এক ব্যক্তির প্রাইভেট কার চালান। সোমবার বেলা ২টায় তাকে আটক করে প্রথমে গাড়িতে তুলে বিভিন্ন স্থানে ঘোরায়। এ সময় তার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। টাকা দিতে পারলে তখনই ছেড়ে দিতো। টাকা না পেয়ে নাশকতার মামলায় ঢুকিয়ে দিছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। নূর হোসেনের স্ত্রী মর্জিনা বেগম জানান, সোমবার ৩টার পর থেকে তার ফোন বন্ধ। মিরপুর সিরামিকের পাশে বাসা থেকে বের হন মালিকের বাসা মিরপুর ডিওএইচএসের উদ্দেশে। তার ফোন বন্ধ পেয়ে মালিক তাকে ফোন দিয়েছিলেন। পরে মালিক খুঁজতে খুঁজতে তার বাসায় আসেন। সারাদিন খোঁজার পর সন্ধ্যায় তারা জানতে পারেন নূর হোসেনকে পুলিশ আটক করেছে। মর্জিনা বলেন, এমন একটা মানুষ ডিউটি করে সোজা বাসায় ঢোকে। রাজনীতি, নাশকতা তো দূরের কথা পান-সিগারেটও খায় না এই মানুষ। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত মামলায় তার স্বামীকে আসামি করা হয়েছে জেনে থানার সামনেই চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে নূর হোসেনে স্ত্রী মর্জিনা বলেন, ছোট দুটি বাচ্চা। একটা স্কুলে। আরেকটা কোলে। বাচ্চাদের এখন কে দেখবে, এখন আমরা বাঁচবো কেমনে?
পল্টন থানা: ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা। মশার কয়েলের প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন আরিফ (২৫)। কিছুক্ষণ পরপর রাজধানীর পল্টন মডেল থানা ফটকে পায়চারী করছেন। তার সঙ্গে এসেছেন আরও চার নিকটাত্মীয়। সবার চেহারায় উৎকণ্ঠার ছাপ। তাদের একজন অনবরত মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। পরিচিত প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্নজনের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছেন না। আরিফের বড় ভাই শরীফ (৩০) থানাহাজতে আটক। সোমবার সকালে রাজধানীর নয়া পল্টনের মা স্টোরের কর্ণধার মো. শরীফকে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে পল্টন মডেল থানায় দেখা করতে বলেন ওই থানার এক দারোগা। ঘণ্টাখানেক পর সাহস নিয়ে তিনি থানায় যান। তার পরই ঘটে বিপত্তি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে হাজতে ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ। এ সময় কারণ জানতে চাইলে থানার ওসি মোর্শেদ আলম তাকে জানান, আপনার দোকানের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি আমাদের তদন্ত করতে হবে। তদন্তের স্বার্থে আপনাকে থানায় থাকতে হবে। শরীফের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানতে তার গ্রামের বাড়িতে চাঁদপুর সদর থানার মাধ্যমে খোঁজ নেয় পুলিশ। কিন্তু তার কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পায়নি পুলিশ। এমনকি রাজধানীর কোন থানায় তার বিরুদ্ধে একটি জিডি কিংবা মামলাও নেই। তার পরও থানাহাজত থেকে তাকে ছাড়েনি পুলিশ। থানা থেকে বলা হচ্ছে, শরীফকে কোর্টে চালান দেয়া হবে। এদিকে রাতেই থানা ফটকে কয়েকজন দালাল শরীফকে ছাড়াতে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেয় তার ভাইকে। তবে তাদের প্রস্তাবে রাজি হননি তিনি। থানার সামনেই কথা হয় আরিফের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে জানান, নয়া পল্টনস্থ আনন্দ ভবনের গলিতে আমার ভাইয়ের একটি কনফেকশনারির দোকান (মা স্টোর) রয়েছে। রোববার ওই এলাকায় একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পরদিন সকালে দোকান খোলার পরপরই পল্টন মডেল থানার এক দারোগা আমার ভাইকে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে আসেন এবং থানায় দেখা করতে বলেন। ঘণ্টাখানেক পর সরল মনে আমার ভাইও থানায় যান। কিন্তু ওসি তাকে থানাহাজতে ঢোকানোর নির্দেশ দেন। আরিফ বলেন, আমার ভাই যেহেতু ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন, তাই সৎ সাহস নিয়ে থানায় যান। তিনি যদি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতেন তাহলে থানায় যেতেন না। ওই ঘটনার পর তিনি পালিয়ে যেতেন। কিন্তু পুলিশ তাকে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। থানার ওসির কাছে আমার ভাই আটকের কারণ জানতে চাইলে ওসি বলেন, দোকানের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় তদন্ত চলছে। এ ব্যাপারে আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। তদন্তের স্বার্থে আরিফকে থানায় থাকতে হবে। ওই ঘটনা শোনার পরপরই আমরা থানার সামনে আসি। সকাল ১০টা থেকে রাত পর্যন্ত এখানে অবস্থান করছি। মাঝে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে দুপুরের ও রাতের খাবার দিয়ে এসেছি। তিনি বলেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির এপিএস ভাইকে ছেড়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। এ ছাড়া পুলিশের উচ্চপদস্থ কয়েক কর্মকর্তাও পল্টন থানার ওসিকে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তিনি কারও কথা শুনেননি। ছেলের আটকের খবর শোনার পর বৃদ্ধ মা বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছেন জানিয়ে আরিফ বলেন, মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার আবুল হোটেলের পেছনে একটি ভাড়া বাসায় মা-ভাবীসহ পুরো পরিবার নিয়ে থাকি। সকাল থেকে আমাদের বাসার সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রয়েছে। আমার মা বারবারই মূর্ছা যাচ্ছেন। ভাবি কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে গেছেন। ভাইয়ের দুই বছরের একটি ছেলে বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে। আত্মীয়স্বজন সবাই টেনশনে আছেন। পেশায় মাইক্রোবাসচালক আরিফ বলেন, আমার বাবা দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকেন। আমার ভাই কনফেকশনারি দোকানে ব্যবসা করেন। আমি একটি কোম্পানির গাড়ি চালাই। আমাদের পরিবারের কেউই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। এমনকি কোনদিন কোন দলের মিছিলেও যাইনি। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর সদরে। ভাইয়ের সম্পর্কে খোঁজখবর চাঁদপুর সদর থানায় ফোন দেয়া হয় পল্টন থানা থেকে। কিন্তু ওই থানা থেকে আমার ভাই সম্পর্কে ভাল রিপোর্ট দিয়েছে। তারা কোন ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি। এর পরও আমার ভাইকে তারা ছাড়েনি। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর দুই লোক আমাকে টাকার বিনিময়ে ভাইকে ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন। একজন ১৫ হাজার টাকা ও আরেকজন ২০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। বিশ্বাস না হওয়ায় তাদের টাকা দেইনি। আরিফকে গতকাল সকালে কোর্টে হাজির করার কথা থাকলেও করা হয়নি। এমনকি গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে ছাড়েনি পুলিশ। পল্টন থানার ওসি মোর্শেদ আলম মানবজমিনকে বলেন, এক এসআই তিনজন লোককে সন্দেহজনকভাবে ধরেছেন। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, আমার থানায় কোন পুলিশ কর্মকর্তা আটক-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত নয়। যদি কেউ জড়িত প্রমাণিত হয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন ছাড়া দেয়া হবে না। এ বিষয়ে সরাসরি মতিঝিল জোনের পুলিশের ডিসি অবগত রয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। শরিফের আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে।
লালবাগ থানা: মধ্যরাত। রাজধানীর লালবাগ থানার সামনে কয়েকজনের জটলা। সমবয়সী তিন কিশোর সোহাগ, রনি ও শুভ দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনই বন্ধু। কিছুক্ষণ আগেই নবাবগঞ্জের ঢাল থেকে লালবাগ থানার টহল পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে আসে। পুলিশের অভিযোগ, শুভর পকেটে এক পোঁটলা গাঁজা ছিল। সোহাগ জানায়, শুভর কাছে সে কিছু টাকা পেতো। ওই টাকা ফেরত দেয়ার জন্য শুভ তাকে রাত ২টার দিকে ফোন করে ডেকে আনে। এ সময় শুভর সঙ্গে ছিল তাদের আরেক বন্ধু রনি। রনির বাড়ি সাভারে। সে মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসে। সোহাগ ও শুভর বাড়ি কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। কামরাঙ্গীরচর এলাকায় তারেক সাউন্ড সিস্টেম নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সোহাগ। তিন বন্ধু একসঙ্গে হওয়ার পর সোমবার রাত ৩টায় নবাবগঞ্জ ঢাল এলাকা থেকে তাদের আটক করে পুলিশ। এরপর সাড়ে তিনটার দিকে তাদের থানায় নিয়ে আসা হয়। পুলিশের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-১১-০৭৬২) থেকে নামিয়ে শুভকে সোজা থানার ভেতরে নিয়ে যান পুলিশ কর্মকর্তারা। অপর দুজন সোহাগ ও রনিকে গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়। থানার সামনে সোহাগ জানায়, তাদের বন্ধুর কাছে যে গাঁজা ছিল তার তারা দুজন জানতো না। সোহাগ ও রনি আরও জানায়, এই প্রথমবার তারা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। থানায়ও এটাই তাদের প্রথমবার। তবে তাদের দুজনের কাছে কিছু না পাওয়া গেলেও কেন তাদের ধরে নিয়ে এসেছে তা তারা জানে না। একটু পরেই থানার ভেতর থেকে ডাক আসে তাদের দুজনেরও। পরে থানা থেকে বের হয়ে জানায়, তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছে পুলিশ। পুলিশ বলেছে, শুভর বিরুদ্ধে মামলা হবে। শুভর কাছে গাঁজা পাওয়া গেছে এই মর্মে সাক্ষী দিলে তাদের দুজনকে ছেড়ে দেয়া হবে। তারা সাক্ষী দিতে সম্মতও হয়েছে। কিন্তু তার পরও তাদের ছাড়া হয়নি। রাতভর থানার সামনেই অবস্থান করতে হয় তাদের। তবে এর মধ্যেই দফায় দফায় থানার ভেতর থেকে ডাক পড়ে তাদের।
এদিকে ওই টহলে অংশ নেয়া পুলিশ কনস্টেবল মুক্তার জানান, আমরা তাদের ধরতাম না। কিন্তু পুলিশ দেখেই তারা পালানোর চেষ্টা করেছিল। এ সময় সন্দেহবশত তাদের আটক করা হয়। তিনি আরও জানান, যার পকেটে গাঁজা পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সকালে কোর্টে চালান করে দেয়া হবে। বাকিদের ছেড়ে দেয়া হবে। পরে অবশ্য সকাল সাড়ে ৬টার দিকে সোহাগ ও রনিকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। আর শুভকে কোর্টে চালান দেয়। সোহাগ অভিযোগ করে বলে, পুলিশ তাদের রাতেই ছেড়ে দিতো কিন্তু সোর্স ফয়সাল তাদের আসতে দিচ্ছিল না। সে বারবার তাদের বলছিল ১৫০০ টাকা দিলেই ছেড়ে দেয়া হবে।
প্রতিবেদন তৈরি করেছেন- নুরুজ্জামান লাবু, মাহমুদ মানজুর, রোকনুজ্জামান পিয়াস, কাজী সুমন, রুদ্র মিজান, নূর মোহাম্মদ ও আল আমিন।

No comments

Powered by Blogger.