নিখোঁজের তিন দিন আগে আটক হন গাড়িচালক

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদকে গ্রেপ্তারের জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই চেষ্টা করছিল পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এ জন্য একাধিকবার তাঁর গুলশানের বাড়িতে পুলিশ গেছে, তল্লাশিও চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন নিখোঁজ এই বিএনপি নেতার স্ত্রী হাসিনা আহমদ। তিনি বলেছেন, সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন আগে তাঁর দুই গাড়িচালক ও ব্যক্তিগত কর্মীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাসাবাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়।
সালাহ উদ্দিন আহমদের ঘটনায় দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে গতকাল বুধবার দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংগঠনটি সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ হওয়াকে গুম বলে অভিহিত করেছে।
হাসিনা আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত কিছুর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়া অন্য কে তাঁকে (সালাহ উদ্দিন) ধরে নিয়ে যেতে পারে, তার জবাব তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর পক্ষ থেকেই আসা উচিত। তারা তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। এর মধ্যেই একদল তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। অথচ এখন সবাই বলছে, তারা কেউই সালাহ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেনি। তাহলে তিনি কোথায় গেলেন। এর মধ্যেই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় লোকজন বলা শুরু করেছেন, তিনি কোথাও লুকিয়ে আছেন, আর আমরা নাটক করছি।’ তিনি বলেন, বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য-বিবৃতি পাঠানোর কাজ শুরুর পর থেকেই সালাহ উদ্দিনকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল পুলিশ। একাধিকবার গুলশান ২ নম্বরে তাঁর বাসায় পুলিশ হানা দিয়েছে। সালাহ উদ্দিনকে ধরে নেওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ডিবির একটি দল গুলশানের বাসার বিভিন্ন ঘর দেখেছে, তল্লাশি করেছে। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের লোক এসে বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে সালাহ উদ্দিনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি বলেন, ‘সব সময়ই যে একটা নজরদারি চলেছে, তা আমরা বুঝতে পারতাম।’
হাসিনা আহমদ বলেন, এর মধ্যেই ৭ মার্চ সালাহ উদ্দিনের দুই গাড়িচালক শফিক ও খোকনকে গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। একই দিনে বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সালাহ উদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারী ওসমান গণিকে। ৯ মার্চ তাঁর ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীর বাড়িতেও অভিযান চালানো হয়েছে। ওই ব্যবসায়ীর কার্যালয়ের দুই কর্মীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, সালাহ উদ্দিন আহমদের দুই গাড়িচালক ও ব্যক্তিগত সহকারীকে ডিবি গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁরা এখন কারাগারে রয়েছেন।
বিভিন্ন জায়গায় সালাহ উদ্দিনের খোঁজ করেও কোনো তথ্য পাননি বলে জানান হাসিনা আহমদ। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। হাসিনা আহমদ বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) খুবই উদ্বিগ্ন। কিন্তু কারও কাছেই কোনো তথ্য নেই। তাঁকে কোথায় নেওয়া হলো, তিনি এখন কী অবস্থায় আছেন, এসব বিষয়ে কেউ ন্যূনতম তথ্যও দিতে পারছেন না। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে আছে। চারটা ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমি কী করব, কী জবাব দেব ওদের, জানি না। বাড়িতে ১০ দিন ধরে রান্না হয় না। প্রতিবেশীরা খাবার-দাবার রান্না করে দিচ্ছেন।’
এইচআরডব্লিউর বিবৃতি: এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের গুমের ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতার অতীত নজির আছে। সালাহ উদ্দিন আহমদের গুমের ঘটনায় একটি গ্রহণযোগ্য এবং নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। আর এই তদন্ত দ্রুত হওয়া দরকার। ৮ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা অনেক দেরি হয়ে যাবে।’
বিবৃতিতে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিয়ে বলা হয়, ১০ মার্চ সালাহ উদ্দিনকে শেষবার দেখা যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে একদল লোক তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তবে সরকার এ ঘটনায় জড়িত থাকার বা এ সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকার কথা অস্বীকার করছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, পুলিশের কাছে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করার এবং আদালতে সালাহ উদ্দিনের স্ত্রীর রিট আবেদনের পরও তাঁকে আদালতের সামনে হাজির করা হয়নি। ১৬ মার্চ পুলিশের মহাপরিদর্শক আদালতকে জানান, তাঁর বাহিনীর হাতে সালাহ উদ্দিন নেই। এ বিষয়ে পুলিশ যথেষ্ট তদন্ত করেছে, এমনটা আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়নি। সালাহ উদ্দিনের বিষয়ে শুনানি ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি রাখেন আদালত।
বিবৃতিতে অ্যাডামস বলেন, ‘গুমের অনেক ঘটনার প্রমাণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকার এসব গুমের কোনো তদন্ত করেনি। সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এসব গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে কখনো ধরা হয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তবে অপরাধ করেও ক্ষমা পাওয়ার যে সংস্কৃতি আগে চলছিল, তা এখনো রয়ে গেছে।
বিবৃতিতে অ্যাডামস বলেন, ‘সালাহ উদ্দিনের গুমের ঘটনা একটি বিস্তৃত প্রবণতার অংশ। দুর্ভাগ্যক্রমে এ বিষয়ে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে সরকারের অস্বীকৃতি এবং তদন্তের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ায় অনীহা প্রকাশও সেই একই ধরনের প্রবণতার অংশ।’

No comments

Powered by Blogger.