প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য -প্রতিশোধের রাজনীতি নয় by ডক্টর কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বীরবিক্রম

মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, ভোগের রাজনীতি বা জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে টিকে থাকা নয়। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা এবং গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা; কিন্তু আমরা অতীত নিয়েই ব্যস্ত। ৪২ বছর আগে বা অতীতে কে কত বড় নেতা ছিল, এ দেশে কার কত বড় অবদান, কোন রাজনৈতিক দল কখন কী বলেছে, তা নিয়ে নিত্যদিনের ঝগড়াঝাটিতে আমরা ব্যস্ত। নেতিবাচক রাজনীতিতে আজ আমরা অভ্যস্ত। এতে করে আদৌ কি আমরা দেশ এবং জাতি হিসেবে উপকৃত হচ্ছি? বরং দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমাদের ভাবমূর্তি দেশ-বিদেশে আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আসলে দেশ পরিচালনা করার মতো আমাদের মধ্যে সে ধরনের ত্যাগ, সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং মনমানসিকতা রয়েছে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কথা আগে ভেবে দেখা প্রয়োজন। আসলে তারা কি আমাদের দেশের চলমান রাজনীতি পছন্দ করে, না ঘৃণা করে? আমার দৃঢ়বিশ্বাস তরুণ প্রজন্ম হঠকারী রাজনীতি চায় না। কেউ রাজত্ব কায়েম করুক সেটাও তারা চায় না। তারা চায়, রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে তাদের নতুন নতুন চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটুক। দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকুক। মানুষ স্বস্তিতে এবং নিরাপদে নিজ নিজ পেশায় মনোযোগ দিয়ে কাজ করার সুযোগ পাক। কারো প্রতি যেন অবিচার বা অন্যায় না হয় তা নিশ্চিত করা হয়। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কাজ শেষ, সময় শেষ। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একটি নাম ‘আল-কাহহারু’, সুতরাং আল্লাহর গজব থেকে আমরা কেউ রক্ষা পাবো না। কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে। অন্যায় করে কখনো কেউ পার পায়নি। আগামীতেও পাবে না। এটাই আল্লাহর বিধান। আসুন প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ পরিহার করি। একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে, দেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাই।
এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় হবে, দেশের ও দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং জরুরি ভিত্তিতে সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেয়া।  বারবার সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে, হয়রানি করাই যেন রাজনীতির মূল লক্ষ্যে আজ পরিণত হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। বহু দিন ধরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থাগুলোতে সরকার তার দলীয় প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সংস্থাগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন স্বাভাবিক রীতিনীতিতে পরিণত হয়েছে। সাংবিধানিক সংস্থাগুলো এবং সরকারি কর্মচারীদের যদি আমরা রাজনীতির বাইরে রাখতে না পারি, তাহলে দেশে কখনো শান্তি ও সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে না। জনগণও সুষ্ঠু নির্বাচন, সুবিচার, সুশাসন এবং ন্যায়বিচার থেকে হবে বঞ্চিত। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বাভাবিকভাবে একধরনের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও কর্মচারীদের হাতে হবে জিম্মি, যা বর্তমানে বিদ্যমান।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘মানুষই সৃষ্টির সেরা’। তবে বহু বছর ধরে রাজনীতিবিদদের আচার, আচরণ ও অশালীন ভাষার প্রয়োগ দেখলে মনে হয়, ক্রমশ আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব লোভ পাচ্ছে। কেউ কাউকে সমীহ বা সম্মান দেখিয়ে কথা বলার বা বক্তব্য দেয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। লাগামহীনভাবে একে অপরের অযথা সমালোচনা করে যাচ্ছি। অবশ্যই, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজন গঠনমূলক সমালোচনা, প্রতিহিংসামূলক নয়। ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত। আমাদের ওপর থেকে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। অথচ রাজনীতিবিদেরাই সমাজ বিনির্মাণের কারিগর। উন্নয়ন সাধনের প্রতীক। তবে কেন আমরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি? মানুষ চায় সমাজে শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সুশিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক উন্নতি, এক মুঠো ভাত এবং শান্তিতে ঘুমানো। বিগত ৪২ বছর ধরে আমরা কি তা নিশ্চিত করতে পেরেছি? এর মূল কারণ আমাদের মধ্যে একধরনের অহঙ্কার, অহমিকা এবং রাজত্ব কায়েম করার মনোভাব কাজ করছে।
জনগণ কষ্টে আছে, অশান্তিতে আছে। কারণ সরকার পরিচালনায় তাদের কোনো অংশীদারিত্ব নেই। মানুষের কষ্ট লাঘবের সব পথ বন্ধ। অনির্বাচিত ব্যক্তিরা দেশ পরিচালনা করছে। ফলে তাদের কর্মকাণ্ডে কোনো জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নেই। কর্তা খুশি থাকলে সব ঠিক, চেয়ার ঠিক থাকলে সব ভালো। জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থন না থাকলেও অসুবিধা নেই। আসুন আমরা দেশ ও জনগণের কথা বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি। যথাশিগগির সম্ভব সুষ্ঠু, অবাধ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পন্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করি। লোভ লালসা ত্যাগ করে, জনগণের মঙ্গল ও সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করি। দিন যত অতিবাহিত হবে, সমস্যা আরো জটিল ও প্রকট আকার ধারণ করবে। অন্ধকার গুহা থেকে বের হওয়া তখন সম্ভব না-ও হতে পারে। ক্ষমতার মোহ থেকে আমাদের সবাইকে বের হতে হবে।
আগামীতে সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর মানুষ নতুন কি পাবে, তা পরিষ্কারভাবে বলতে হবে। হাতবদলের পালার ইতি টানতে হবে। ইতিবাচক সমাজ গড়ার শপথ নিতে হবে। সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি, যেন এই দেশ থেকে চিরদিনের জন্য স্বৈরতন্ত্র বিতাড়িত হয়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তরুণ প্রজন্মের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে হবে। তরুণ সমাজ দেশ ত্যাগেও তখন নিরুৎসাহিত হবে। জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠলে মাঠে সভা সমাবেশ ও রাস্তায় মিছিল থাকবে না। হরতাল ও অবরোধ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে বেশি দূর আগানো সম্ভব নয়। তাই সব সময় আলোচনার রাস্তা খোলা রাখতে হবে। সমঝোতায় আসতে হবে। তবেই দেশ সঠিক ও সুন্দরভাবে চলবে। জনগণ শান্তিতে বাস করতে পারবে।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি)।

No comments

Powered by Blogger.