মোদি: মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ by হাসান ফেরদৌস

মোদিকে বাহবা জানিয়ে কলাম লিখতে হবে, তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে নিউইয়র্কে তাঁকে দেখে কিঞ্চিৎ উষ্মার সঙ্গেই কবুল করছি, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে মুগ্ধ করেছেন। মোট ৮৮ জন সফরসঙ্গী নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেবিনেট সদস্য ছিলেন একমাত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক বিতর্কে ভাষণ তো ছিলই, এর বাইরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক, কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক, কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসে ভাষণ, এ দেশের প্রথম সারির ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়, ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে অনুষ্ঠান। আরও ছিল সেন্ট্রাল পার্কে কনসার্টে একঝলক উপস্থিতি। এর বাইরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক তো ছিলই। মোদি একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা মাথায় রেখে এই সফরে এসেছিলেন। ঠিক ২০০ পারিষদ ও হাফ ডজন মন্ত্রী নিয়ে আনন্দ সফর নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাঁর একটি ‘মেসেজ’ ছিল যে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে তিনি এসেছেন, সে ভিন্ন এক ভারত। এক অতি পুরোনো সভ্যতার তিনি প্রতিনিধি, কিন্তু সেই পুরোনোর ওপর গড়ে উঠেছে এক নতুন সংস্কৃতি, যার ভিত্তিতে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি, শিক্ষা ও বিজ্ঞান। জাতিসংঘে মোদি হিন্দিতে ভাষণ দেন। সম্ভবত অটল বিহারি বাজপেয়ির পর তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় সরকারপ্রধান, যিনি রাষ্ট্রসভায় হিন্দিতে ভাষণ দিলেন। ওবামাসহ অধিকাংশ রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে আলাপচারিতার সময় হিন্দিতেই কথা বলেছেন। এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে পাঁচ থেকে দশ মিনিট তাঁর সৌজন্য কথোপকথন হয়, তাতেও মোদি হিন্দিতেই কথা বলেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজের হিন্দিজ্ঞানে মোদিকে বিস্মিত করেন বটে, কিন্তু নিজ ভাষায় অটল থেকে মোদি কিন্তু ‘ভাষাকন্যার’ কাছ থেকে নিজের জন্য বাড়তি নম্বর আদায় করে নিলেন।

ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ২০ হাজার ভারতীয়র সামনে মোদি এক ঘণ্টা ভাষণ দেন কোনো কাগজ ছাড়া। বিজেপি নেতা, কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই অনুষ্ঠানটি ছিল সব ভারতীয়র জন্য উন্মুক্ত। তাদের সবাই যে বিজেপি-সমর্থক, অথবা মোদির রাজনীতির প্রতি সদর্থক মনোভাব পোষণ করেন, তা-ও নয়। কিন্তু এই এক দিন, আমার মনে হয়েছে প্রায় সব ভারতীয় তাদের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক সংবর্ধনা জানিয়েছে। অল্পবিস্তর প্রতিবাদী লোক যে ছিল না, তা নয়; কিন্তু মোদির ‘রাজসম্মানে’ তা কোনো বিঘ্নের কারণ হয়নি। মোদিও তাদের বিমুখ করেননি। এমনিতে ভারতীয়রা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলে, নিজের দেশ ও তার রাজনীতিকদের বংশোদ্ধার ছাড়া অন্য কথা মুখে জোটে না। কিন্তু সেদিন—এবং তার পর—যত ভারতীয়র সঙ্গে আমার দেখা ও কথা হয়েছে, তারা প্রায় সবাই ভারতীয় হিসেবে গভীর শ্লাঘা বোধ করেছে। নিজের দেশ ও নেতা নিয়ে এর আগে ভারতীয়দের এমন প্রীত দেখিনি। এমন আশাবাদের বার্তাও শোনা যায়নি।
কী নিয়ে বললেন মোদি? তিনি জানালেন এক নতুন ভারতের কথা, যিনি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে পূর্ণ আস্থাবান। অন্য সবার চেয়ে ভারত ভিন্ন কারণ তার রয়েছে গণতন্ত্র, তরুণ জনশক্তি সোয়া কোটি মানুষের এক বিশাল বাজার। একসময় ভারত বলতে বোঝাত সাপুড়ে, আজ সে পরিচিত কম্পিউটারের ‘মাউস’-এর জন্য। মঙ্গল গ্রহে নভোযান পাঠাচ্ছে সে। প্রবাসী ভারতীয়দের বললেন, ‘দেশে থাকো কি বিদেশে, ভারতে বিনিয়োগ করো।’ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানালেন, ভারত এখন বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যে প্রস্তুত। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার কোনো চেষ্টা করলেন না। স্বীকার করলেন, ভারত এখনো গরিব, সে দেশের অধিকাংশ মানুষের এখনো শৌচাগার নেই৷ অহেতুক ফালতু আইনের মারপ্যাঁচে সেখানে ব্যবসায়ী যেমন, তেমনি সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। এখনো দুর্নীতি সর্বত্র। সরাসরি বললেন, ‘এসব আমি বদলাতে চাই। প্রতিদিন যদি একটি করে ফালতু আইন বাতিল করতে পারি, তাহলে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হবে না।’
মোদি এই সফরে হোয়াইট হাউসের কাছ থেকে কী সম্মান পেয়েছেন, আমি তার ফিরিস্তি দেব না। শুধু এটুকু বলি, প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজে টুরিস্ট গাইড হয়ে মোদিকে মার্টিন লুথার কিং মেমোরিয়াল ঘুরে দেখিয়েছেন। এমন ঘটনা দ্বিতীয় ঘটেছে কি না, আমার জানা নেই। ওবামা ও মোদি যৌথভাবে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন, সেটিও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রথম। মোদি আমাকে আশান্বিত করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে ভীতও হয়েছি। মোদি শুধু ভারতীয় হিসেবে নন, একজন হিন্দু ভারতীয় হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। নিজের ধর্মপরিচয় জামার হাতলে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখার আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে নয় দিনজুড়ে যে নবরাত্রি উৎসব, তার অংশ হিসেবে তিনি এই পুরো সময় উপোস থাকবেন। অতি আচারমুখী ও রক্ষণশীল হিন্দু ছাড়া আর কেউ নবরাত্রিজুড়ে উপোস থাকেন, সে কথা শুনিনি। আচারসম্মত হিন্দু হিসেবে মোদি সে কাজ করতেই পারেন, কিন্তু নিজের ধর্মীয় পরিচয় তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন, সেটা কাম্য নয়। তিনি উপোস আছেন, সে কথা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসে তাঁর সম্মানে রাষ্ট্রীয় ভোজ, সবাই মুরগি-মুসাল্লাম চিবোচ্ছে, মোদি লেবু-জল দিয়ে আহার সারছেন। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ভারতীয়দের কিঞ্চিৎ উপহাসের সঙ্গে বলেছেন, তাদের গলায় জোর নেই কেন, উপোস তো রয়েছেন তিনি। বস্তুত সে ভাষণ শুরুই করেন ‘ভারত মাতা কি জয়’, এই স্লোগানে। জনসংঘ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএস দীর্ঘদিন থেকে এই স্লোগান ব্যবহার করে আসছে। একইভাবে তারা ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানটিও ব্যবহার করে হিন্দু চেতনার সঞ্চারে। ভারতীয় মুসলমানদের কাছে উভয় স্লোগানই সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন বহন করে, সে জন্য দিল্লি জামে মসজিদের ইমাম আহমেদ বুখারি তাঁদের ‘ইসলামবিরোধী’ বলে তাঁর নিন্দা করেছিলেন। মোদি সে কথা জানেন, জেনেশুনেই সেই স্লোগান দিচ্ছেন, কারণ তিনি সবার আগে নিজের হিন্দু পরিচয়টি তুলে ধরতে চান।
এখানেই আমার ভয়। স্বাধীনতার পর প্রথম ভারতীয় নেতারা খুব সচেতনভাবে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক—সেক্যুলার—পরিচয় তুলে ধরতে আগ্রহী ছিলেন। অধিকাংশ ভারতীয়—তা দেশেই হোক বা বিদেশে—নিজেকে কখনো বুক ফুলিয়ে হিন্দু বলে পরিচয় দেয়নি। মোদি সেই ঐতিহ্য পাল্টাতে চান। বিষয়টা যাতে একদম গোড়া থেকেই ভারতীয়দের মাথায় ঢোকে, সে জন্য মোদি সরকার দেশের স্কুলের পাঠ্যপুস্তক নতুন করে লেখার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ কাজের দায়িত্ব পড়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী শিক্ষক দীননাথ বাতরার ওপর। এই সেই লোক, যাঁর আপত্তির কারণে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েন্ডি ডনিজারের হিন্দুধর্মবিষয়ক গ্রন্থ ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়। বাতরা বিশ্বাস করেন, ভারতের সেক্যুলার রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে দেশে হিন্দু ঐতিহ্য অবহেলিত হয়েছে। তিনি এর পরিবর্তন চান। গুজরাটে পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্ব পেয়ে বাতরা সাহেব ছাত্রদের ‘অখণ্ড ভারত’-এর স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। এই অখণ্ড ভারতের যে মানচিত্রটি তিনি রচনা করেন, তাতে কেবল আজকের ভারত নয়, উপমহাদেশের অন্য সব দেশ—পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও অন্তর্ভুক্ত। বাতরা এখন শুধু গুজরাট নয়, পুরো ভারতের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনায় নেতৃত্ব পাচ্ছেন। ব্যাপারটা এতটাই উদ্বেগজনক যে নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো পত্রিকাকে সম্পাদকীয় লিখে প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে। টাইমস-এর কথায়, মোদি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটি ভালো কথা। ‘কিন্তু ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতার স্থান যদি দখল করে নেয় (হিন্দুত্ববাদী) ভাবাদর্শ,’ তাহলে তেমন শিক্ষা ভারতের প্রতিবেশীদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হবে।
মোদি যে ধর্মকে—তাঁর হিন্দুত্ববাদকে—রাজনৈতিক তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চান, গত মাসে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে তার এন্তার প্রমাণ মিলেছে। এই নির্বাচনে প্রধান প্রচারক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন স্বামী রামদেভ, যাঁর মুখ্য স্লোগান ছিল ‘হিন্দুধর্ম বাঁচাও’। মুসলমানদের ‘লাভ জিহাদ’ চক্করে পড়ে ভারতীয় মেয়েরা ধর্মান্তরিত হচ্ছে। এদের রক্ষা করতে হবে। বলাই বাহুল্য, রামদেবের উর্বর মস্তিষ্কোদ্ভূত এই প্রচারণার কারণেই উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি রীতিমতো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির বয়স ছয় মাসও নয়। যে নতুন ভারতের স্বপ্ন তিনি দেখাচ্ছেন, অধিকাংশ ভারতীয়ই তাতে অনুপ্রাণিত বোধ করছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের উত্থান যদি সে স্বপ্নের অন্তর্গত হয়, তাহলে আশান্বিত হওয়ার বদলে ভীত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.