শান্তিই কামনা -মালালা ইউসুফজাই

শান্তির দূতের মতোই কথা বললেন মালালা ইউসুফজাই। চির প্রতিদ্বন্দ্বী দু’দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তি স্থাপনে উচ্চপর্যায়ের এক আহ্বান জানালেন তিনি। ডিসেম্বরে অসলোতে যখন তার হাতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেয়া হবে সেই অনুষ্ঠানে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির উপস্থিতি কামনা করলেন। তার এ আহ্বানের মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা। কারণ, তারা যদি ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তাহলে তা দেখা হবে ভিন্ন চোখে। যেমন কূটনৈতিক আবহ তৈরি হয়েছিল নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরীফের উপস্থিতি নিয়ে, ঠিক সেই একই রকম বা তারও চেয়ে বেশি তাৎপর্য থাকবে সেই উপস্থিতি। উল্লেখ্য, এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন যৌথভাবে ভারতের ৬০ বছর বয়সী কৈলাশ সত্যার্থী ও পাকিস্তানের ১৭ বছর বয়সী মালালা ইউসুফজাই। তারা একজন নারী শিক্ষার অগ্রদূত। অন্যজন শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে এবং শিশুদের অধিকারের পক্ষে আন্দোলনকারী। জম্মু-কাশ্মীরের মধ্যে ৯ দিন ধরে দু’দেশের সেনাদের মধ্যে লড়াইয়ে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। এমন উত্তেজনাকর মুহূর্তে নোবেল কমিটি শান্তি পুরস্কারের জন্য দু’দেশ থেকে বেছে নেয় এ দুই খ্যাতিমানকে। ওদিকে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর পরই পাকিস্তানের তালেবানরা নতুন করে হুমকি দিয়েছে মালালাকে। তারা বলেছে, ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ধারালো ও চকটকে ছুরি প্রস্তত রাখা হয়েছে। পাকিস্তানি তালেবানের শক্তিশালী একটি অংশ এ হুমকি দিয়েছে। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আগস্টে নতুন শাখা গঠন করে তালেবানদের একটি গ্রুপ। এর নাম দেয়া হযেছে জামায়াতুল আহরার। তারা গতকাল টুইটারে এক পোস্টে মালালাকে ওই হুমকি দেয়। এর মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান টুইটে বলেন, মালালার মতো ক্যারেকটারের জানা উচিত, আমরা অবিশ্বাসীদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হবো না। ইসলামের শত্রুদের জন্য ধারালো ও চকচকে ছুরি প্রস্তুত করেছি আমরা। অস্ত্র ও সশস্ত্র সংঘাতের বিরুদ্ধে মালালা অনেক বেশি কথা বলেছে। সে কি জানে না, তাকে যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো তার প্রতিষ্ঠাতা বিস্ফোরকের আবিস্কারক। মালালা ইউসুফজাইকে তালেবানরা ২০১২ সালে গুলি করার পর তার বিশ্বজোড়া পরিচিতি হলেও কৈলাশ সত্যার্থীর তেমন প্রচার ছিল না। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তারা এখন বিশ্বনেতাদের অভিনন্দন বার্তায় ভাসছেন। অভিনন্দন পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মালালাকে নাগরিকত্ব দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে কানাডা। মালালাকে দেশের গর্ব আখ্যা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। সারা বিশ্ব যখন মালালার স্তুতিতে ব্যস্ত তখন তার সম্পর্কে কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার বললেন- মালালা ইউসুফজাই শুধু ১৭ বছরের সাধারণ কোন কিশোরীর নাম নয়। মেয়ে শিশু ও নারীশিক্ষা আন্দোলনের সাহসী অগ্রপথিক মালালা সবচেয়ে কম বয়সে সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত এক কিশোরীর নাম। সারা বিশ্ব যখন কানাডার পক্ষ থেকে অকুতোভয় এ কিশোরীকে নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলো। কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২২শে অক্টোবর অটোয়া সফর করবেন মালালা। সেখানেই তাকে সম্মানজনক এ নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এর আগে এ ঘটনা ঘটেছে ৫ বার। মালালা ষষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে সম্মানজনকভাবে কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়ার বিরল সম্মানের অধিকারী হচ্ছেন। ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে বসবাস মালালার। শুক্রবার যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয় তখন মালালা ছিলেন তার রসায়ন ক্লাসে। এ খবর শোনার পরও তিনি ক্লাস থেকে বের হননি। স্কুল থেকে বের হননি। স্কুল ছুটির পর সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তিনি অসলোতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরীফ ও নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি কামনা করেন। তার পুরস্কার উৎসর্গ করেন নিঃগৃহীত, বঞ্চিত, নিষ্পেষিত শিশুদের প্রতি, যাদের কথা কেউ শোনে না। নরওয়ের রাজধানী অসলোয় আগামী ডিসেম্বরে নোবেল পুরস্কার বিতরণ করা হবে। মালালা জানান, আমি নিজে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে আমাদের সঙ্গে যোগদানের অনুরোধ জানিয়েছি। কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। পাক-ভারত সীমান্তে চলমান উত্তেজনার মধ্যে কৈলাশ ও মালালা দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক গড়তে একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছেন। মালালা বলেন, আমরা একসঙ্গে কাজ করবো এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করবো। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষমূলক অবস্থাকে ‘সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক’ বলে মন্তব্য করেন এ কিশোরী। মালালা আরও বলেন, আমরা ভাল সম্পর্ক চাই। আমি প্রকৃতপক্ষেই শান্তিতে বিশ্বাসী। মেয়ে শিশুদের পড়াশোনার অধিকারের পক্ষে কথা বলার কারণে তার স্বদেশ পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যাকায় ২০১২ সালে তালেবানরা তার মাথায় গুলি করে। জীবনের সঙ্গে কঠিন লড়াই করে তিনি বেঁচে যান। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বৃটেনে। সেখানে তার মাথায় অপারেশন করা হয়। সেই থেকে বৃটেনে তার বসবাস।
সঙ্গে রয়েছেন পরিবারের অন্যরা। এমন একজন কিশোরী শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর সারাবিশ্বে সংবাদ শিরোনাম হবে এটাই স্বাভাবিক। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুগের পর যুগ ধরে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তাতে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে। এর ইতি ঘটাতে চান মালালা-কৈলাশ। এমন মুহূর্তটির সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে অভিনন্দন জানিয়েছেন কৈলাশ সত্যার্থীকে। মালালা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর পাকিস্তানজুড়ে চলছে উৎসব। পাকিস্তানিরা নেচে, গেয়ে, কেক কেটে আনন্দ উদযাপন করছে। মালালার সঙ্গে পড়াশোনা করেছে আয়েশা খালিদ। সে বলেছে, শুধু মালালা এ পুরস্কার জেতেননি। এ পুরস্কার জিতেছে পাকিস্তানের সব মেয়ে। মালালা আমাদের চোখের আলো, আমাদের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি। মালালা প্রমাণ করেছেন কেউ বোমা মেরে স্কুল উড়িয়ে দিয়েই শিক্ষাকে থামিয়ে দিতে পারে না। শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে বারাক ওবামা বলেছেন- মিশেল ওবামা, আমার এবং সব আমেরিকানের পক্ষ থেকে আমি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই ও কৈলাশ সত্যার্থীকে অভিনন্দন জানাতে চাই। যারা সব মানুষের মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চায় এই পুরস্কার ঘোষণা তাদের বিজয়।

No comments

Powered by Blogger.