আলোচনায় অপারেশন সাতছড়ি by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

অপারেশন সাতছড়ির পর আলোচনায় উঠে এসেছে সিলেটের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পাহাড়-অরণ্যেঘেরা দুর্গম জনপদ। সিলেটের  পাহাড়-অরণ্যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আনাগোনা আগেও অনেক খবর সৃষ্টি করেছে। তবে চমকে দিয়েছে হবিগঞ্জের সাতছড়ির অস্ত্রাগার উদ্ধার ঘটনা। এমন সংবাদে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সীমান্তবর্তী অনেক গহিন এলাকায়। সিলেট বিভাগের তিন দিকে ঘিরে আছে ভারতের তিনটি রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়। এর মধ্যে আসাম ও ত্রিপুরায় স্বাধীনতার দাবিতে তৎপর রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) আতঙ্কে রেখেছে আসামের জনসাধারণকে আর অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ) আতঙ্কে রেখেছে ত্রিপুরার বাসিন্দাদের। তবে ভারত সরকারের অনমনীয় ও কঠোর মনোভাবের কারণে সুবিধা করতে না পেরে পাহাড়ে-অরণ্যে লুকিয়ে থেকে কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে তারা। সীমানা পেরিয়ে চলে আসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও। গহিন এলাকায় গড়ে তোলে নিরাপদ আস্তানা। সাতছড়ির অরণ্য আসাম-ত্রিপুরা দুই রাজ্যের সীমানার কাছেই। এ অরণ্য তাই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠে। তবে এর ভেতরে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যে এমন শক্ত অবস্থান গড়ে উঠেছে তা টের পাওয়া যায়নি সাতছড়ির অস্ত্রাগার উদ্ধারের আগ পর্যন্ত। এমনকি দেশের কোন নিরাপত্তা সংস্থা বা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এর তথ্য ছিল না। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারের দাবি, ভারতীয় গোয়েন্দারা এ অস্ত্রাগারের সন্ধান দিয়েছেন বাংলাদেশকে। আনন্দবাজারের ভাষ্য, ‘আলফা’র (উলফা) সহযোগী জঙ্গি সংগঠন এটিটিএফ (অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স) নেতা রঞ্জিত দেববর্মা ধরা পড়ার পরে তাকে জেরা করেই ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সাতছড়ির জঙ্গলে অস্ত্রভা-ারের খবর পান গোয়েন্দারা। তারপর বারেবারেই বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়। কয়েকবার অভিযান চালিয়েও পুলিশ কিছু পায়নি। সমপ্রতি ফের ভারতীয় গোয়েন্দারা সাতছড়িতে অস্ত্রের হদিস দিয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পাঠান। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, আলফা’র বহিষ্কৃত নেতা পরেশ বড়ুয়া চীন থেকে মিয়ানমারের পথে যে অস্ত্র পাঠান, তা এই সাতছড়ির জঙ্গলে জমা করে রাখা হয়। সুযোগমতো তা ভারতে জঙ্গিদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বার তল্লাশির দায়িত্ব দেয় র‌্যাবকে। স্থানীয় চুনারুঘাট থানার ওসি স্বীকার করেছেন, অভিযানের বিষয়ে এবার পুলিশকেও আড়ালে রাখা হয়।’
সাতছড়ির মতো সিলেটের আর কোন গহিন অরণ্যে কি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এমন আস্তানা নেই-এমন প্রশ্ন অনেকের মনে দেখা দিয়েছে। সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী দুর্গম স্থানে আগে থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আনাগোনার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। উলফা নেতাদের আনাগোনার সংবাদে বারবারই সংবাদ শিরোনাম হয়েছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা। ২০০৫ সালের ২৭শে মে উপজেলার মাধবপুরের মেন্দিটিলায় র‌্যাব ও বিডিআরের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ত্রিপুরার ৬ বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত হয়। পরে মৃতদেহের কোন দাবিদার না থাকায় মৌলভীবাজার পৌর এলাকার একটি গোরস্থানে কবর দেয়া হয়। মাধবপুরের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগান এলাকা, ছনগাঁও, নয়াপতন, মাজেরগাঁও, কেওয়ালিঘাট, কোনাগাঁওয়ের মতো দুর্গম পল্লীতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আনাগোনার খবর স্থানীয়দের মাঝে একটি ওপেন সিক্রেট। আতঙ্কের চোখ দিয়েই স্থানীয়রা এসব এলাকাকে দেখে থাকেন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর খবর রটেছিল গহিন অরণ্যে এসব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়েই আছেন তিনি। এমনকি র‌্যাবও তার সন্ধানে এ এলাকায় অভিযান চালিয়েছিল।

আসাম সীমান্তবর্তী সিলেটের জৈন্তাপুরের খাসিয়া পাহাড়ে উলফা নেতাকর্মীদের আনাগোনার সংবাদও অনেকবার আলোচনায় এসেছে। স্থানীয় এক প্রভাবশালী খাসিয়া নেত্রীর সঙ্গে উলফা কানেকশনের অভিযোগও বেশ পুরনো। শুধু গহিন এলাকা নয় সিলেট নগরকেন্দ্রিক উলফা সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও উঠেছিল আগে। ২০০৫ সালে ভারতের সীমান্ত রক্ষাবাহিনী বিএসএফ দাবি করেছিল ঢাকার বাইরে সিলেটে উলফা’র পরিচালনাধীন দু’টো হোটেল রয়েছে। সে সময় প্রচার হয়েছিল নগরীর জিন্দাবাজার ও শহরতলীর আখালিয়া এলাকায় উলফা’র হোটেল দু’টো পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন দুলাল রায় ওরফে সাইদুল এবং অনিল কুমার দে ওরফে সোহেল। এমনকি সিলেটের একটি ব্যাংকে উলফা’র হিসাব রয়েছে বলেও সে সময় অভিযোগ উঠেছিল।
আপাতত অভিযান সমাপ্ত
নুরুল আমিন, চুনারুঘাট থেকে জানান, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ির গভীর জঙ্গলে ৪ দিনের অস্ত্র অভিযান আপাতত সমাপ্ত করেছে র‌্যাব। ওই অভিযানে কামান বিধ্বংসী রকেট লঞ্চার ১টি, রকেট ২২২টি , মেশিন গান ৪টি, মেশিনগানের অতিরিক্ত ব্যারেল ৫টি, ৭.২০ মিলিমিটার গুলি ১১ হাজার ৬৬৭ রাউন্ড, ১২.০৭ পয়েন্টের গুলি ১ হাজার ৩২০ রাউন্ড, ২৪৮টি রকেট চার্জার, এমজি এমিনেশন বক্স ১৩টি, ওয়েল ক্যান ৪০৪ টিসহ বিপুল পরিমাণ গোলা-বারুদ উদ্ধার করা হয়। ওই জঙ্গলে আরও অস্ত্র থাকতে পারে বলে ধারণা করছে র‌্যাব। র‌্যাব হেডকোয়ার্টার  ও র‌্যাব-৯ এর আড়াই শতাধিক জওয়ান এ অভিযান পরিচালনা করে। তবে এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। র‌্যাবের মিডিয়া উইং কমান্ডের প্রধান কর্ণেল হাবিবুর রহমান গতকাল এক ব্রিফিংয়ে বলেন, সাতছড়িতে তাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে আরও কয়েক দিন। তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব সদস্যরা গত রবিবার রাত ১টার দিকে র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক সানা শাহীনুর রহমানের নেতৃত্বে সাতছড়ি বনবিটের অভ্যন্তরে এবং টিপরা পল্লীতে অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে টিপরা পল্লীতে দু‘টি এবং পল্লীর অদূরে গভীর জঙ্গলে একটি টিলায় ৫টি ব্যাংকারের সন্ধান পায় তারা। গতকাল টিপরা পল্লীতে আরও একটি গোপন আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই আস্তানাটি সন্ত্রাসী সংগঠনের আহত সদস্যদের চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০ থেকে ২৫ ফুট গভীর এসব ব্যাংকার আরসিসি ঢালাই করা। ৫টি ব্যাংকারের মধ্যে একটি ব্যাংকার খনন করে  গোলাবারুদ পাওয়া যায়। বাকিগুলো ছিল পরিত্যক্ত। ওই  গোলা-বারুদ ভারতীয় নিষিদ্ধ ঘোষিত কোন সংগঠনের কিনা এমন প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে হাবিব বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে তা জানানো হবে। এদিকে র‌্যাবের এ অভিযান অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে চালানোর কারণে সোমবার বিষয়টি জানাজানি হয়নি। র‌্যাবের উপস্থিতির পর রোববার রাতেই টিপরা পল্লী থেকে দেব বর্মা সম্প্রদায়ের লোকজন আত্মগোপন করে। বিপুুল সংখ্যক র‌্যাব সদস্যের আনাগোনায় মঙ্গলবার সকালে বিষয়টি জানাজানি হয়। র‌্যাবের এ অভিযান সম্পর্কে পুলিশ বা বিজিবি জওয়ানরা কিছুই জানেন না। র‌্যাবের অভিযান দেখার জন্য সাংবাদিকের বহর নিয়ে মঙ্গলবার সকালে হেলিকপ্টারে করে সাতছড়ি ছুটে আসেন র‌্যাবের সহকারী ডাইরেক্টর জেনারেল কর্নেল জিয়াউল হাসান, মিডিয়া উইং কমান্ডের প্রধান কর্নেল হাবিবুর রহমান, ব্যাটালিয়ান কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ছুটে যান স্থানীয় মিডিয়া কর্মীরাও।
বাংলাদেশে জংলা পাহাড়ে অস্ত্রের ভা-ার পরেশের
ওদিকে আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, বাংলাদেশের হবিগঞ্জে সাতছড়ির দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গল। হাত বাড়ালেই ভারত সীমান্ত। তার ওপারে যে সবুজ অরণ্য তা পড়ে ত্রিপুরা রাজ্যে। এই জঙ্গলের মধ্যেই জঙ্গিদের অস্ত্রভা-ার রয়েছে বলে খবর দিয়েছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। তার পরে রাতভর অভিযান চালিয়ে জঙ্গলে সাতটি লুকোনো বাংকারের হদিস পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সেই বাংকারে মিলেছে ১৮৪টি শক্তিশালী রকেট লঞ্চার, বেশকিছু ট্যাঙ্কবিধ্বংসী গোলা, ১৫৩টি রকেট চার্জার, শ’দুয়েক মর্টারের গোলা ও বিস্ফোরক। আরও দু’দিন তল্লাশি-অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান। আলফা’র সহযোগী জঙ্গি সংগঠন এটিটিএফ (অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স) নেতা রঞ্জিত দেববর্মা ধরা পড়ার পরে তাকে জেরা করেই ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সাতছড়ির জঙ্গলে অস্ত্রভা-ারের খবর পান গোয়েন্দারা। তারপর বারে বারেই বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়। কয়েক বার অভিযান চালিয়েও পুলিশ কিছু পায়নি। সমপ্রতি ফের ভারতীয় গোয়েন্দারা সাতছড়িতে অস্ত্রের হদিস দিয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পাঠান। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, আলফা’র বহিষ্কৃত নেতা পরেশ বড়ুয়া চীন থেকে মিয়ানমারের পথে যে অস্ত্র পাঠান, তা এই সাতছড়ির জঙ্গলে জমা করে রাখা হয়। সুযোগ মতো তা ভারতে জঙ্গিদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবার তল্লাশির দায়িত্ব দেয় র‌্যাবকে। স্থানীয় চুনারুঘাট থানার ওসি স্বীকার করেছেন, অভিযানের বিষয়ে এবার পুলিশকেও আড়ালে রাখা হয়। রাতভর অভিযানে র‌্যাবও প্রথমে বিশেষ কিছু পায় নি। একটি টিলার ওপর কয়েকটি কুয়ো দেখেন তল্লাশিকারীরা। ভোরের দিকে র‌্যাবের এক সদস্য দড়ির মই বেয়ে ধরে তার মধ্যে নামতেই লুকানো বাংকারের বিষয়টি জানা যায়। খবর পেয়ে ঢাকা থেকে পদস্থ কর্তারা  হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। সকাল ১১টায় অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরুর পরে একে একে সাতটি কুয়োর মধ্যে সাতটি বাংকার মেলে। সেগুলোতেই পাওয়া যায় থরে থরে সাজানো অস্ত্রশস্ত্র। র‌্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, মেয়াদ ফুরোনো বেশকিছু বিস্ফোরক মেলায় মনে করা হচ্ছে, অনেক দিন ধরেই সেগুলো জমা করে রাখা আছে। নজরদারি বাড়ায় জঙ্গিরা সেগুলো পাচার করে উঠতে পারেনি। র‌্যাবের মুখপাত্র হাবিব জানান, মজুত অস্ত্রের এক তৃতীয়াংশ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও বাঙ্কারের সন্ধানে আগামী দু’দিনও চুনারুঘাট উপজেলার এই জঙ্গলে অভিযান চলবে। তবে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য পেয়ে তারা এই অভিযান চালিয়েছেন, এই তথ্য মানতে চান নি হাবিব। তিনি বলেন, বিভিন্ন সূত্রেই অস্ত্র থাকার খবর মিলছিল। তার ভিত্তিতেই অভিযান চালানো হয়। আলফা’র অধিকাংশ নেতাকেই ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে ঢাকা। চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় পরেশ বড়ুয়াকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। পরেশ বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতে অস্ত্র চোরাচালান চালিয়ে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে। তারা মনে করছেন, সাতছড়ির অস্ত্রভা-ার ধরা পড়ার পরে এই পথে পরেশের অস্ত্র চালানও বন্ধ হবে। সূত্র আনন্দবাজার পত্রিকা

1 comment:

  1. জামাত ও স্বাধিনতাবিরোধীরাই দায়ী

    ReplyDelete

Powered by Blogger.