শিক্ষার জন্য অর্থ

অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক—সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন শিক্ষাবিস্তারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। পৃথিবীর সব জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির ইতিহাস থেকে এই সত্য ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশেও শিক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করা হয় না, কিন্তু এ জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, জাতীয় বাজেটে তার সামান্যই বরাদ্দ করা হয়৷ যদিও বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকে, তবু এখন পর্যন্ত তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এই প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপনের প্রাক্কালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর যে তাগিদ দিয়েছেন, তা যথাযথ৷ গত রোববার রাজধানীতে ‘সবার জন্য শিক্ষা, গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট ২০১৩-১৪’ প্রকাশের অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, শিক্ষা খাতে অর্থবরাদ্দ হওয়া উচিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) কমপক্ষে ৬ শতাংশ৷ আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বিগত বছরগুলোতে সামান্য বাড়ানো হয়েছে বটে, কিন্তু তা কখনো জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশের ওপরে ওঠেনি। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের তুলনায় তেমন উন্নত না হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের বরাদ্দ লক্ষণীয়ভাবে বেশি। ভারত ও নেপালে ৪ শতাংশের বেশি, আর ভুটানে আরও বেশি, ৫ দশমিক ২ শতাংশ৷ পাকিস্তান গত অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে ১৭ শতাংশ এবং তারা এখন জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় করছে শিক্ষা খাতে। শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয়ের সুফল কতটা উৎসাহব্যঞ্জক হতে পারে, এশীয় দেশগুলোর মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায়-ধ্বংসপ্রাপ্ত জাপান যুদ্ধের অব্যবহিত পরের বছরগুলোতে শিক্ষার জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছিল বলেই তারা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে বিশ্বের অন্যতম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে পেরেছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে মালয়েশিয়ার অগ্রগতিও লক্ষণীয়, তারা শিক্ষার জন্য জিডিপির ৮ শতাংশের বেশি অর্থ ব্যয় করে৷ ব্রাজিল, চিলিসহ যেসব দেশ দ্রুত অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে, তাদের সবারই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৪ শতাংশের ওপরে। আমাদের অত্যন্ত জনবহুল এই দেশে শিক্ষাবঞ্চিত, অদক্ষ বিপুল জনগোষ্ঠী জাতীয় বোঝার মতো। এই বোঝাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থবরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন অনেক—জিডিপির ৬ শতাংশও হয়তো যথেষ্ট হবে না। কিন্তু আমাদের সামর্থ্য স্পষ্টতই সীমিত। তবু শিক্ষা খাতে অর্থবরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তা যদি এক বছরে ৬ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব নাও হয়, ক্রমান্বয়ে তা বাড়ানোর প্রয়াস আমাদের নিতেই হবে৷ রাষ্ট্রীয় অর্থের বিপুল অংশের অপচয় ঘটে এমন অনেক খাত আমাদের আছে৷ রাজনৈতিক কারণে অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের পেছনে অর্থব্যয় ও দুর্নীতি-পুকুরচুরির কথা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া আরও যেসব অনুৎপাদনশীল, কম গুরুত্বপূর্ণ খাত রয়েছে, সেগুলো সংকুচিত করা হলে শিক্ষার জন্য অর্থের সংস্থান অবশ্যই বাড়ানো সম্ভব এবং তা-ই করা উচিত৷

No comments

Powered by Blogger.