ঢাকা–টোকিও: লেনদেনের হিসাব-নিকাশ by মনজুরুল হক

চার দিনের জাপান সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও সফল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশের দিক থেকে সফরের প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এই সফরকে নতুন মাত্রার সাফল্য নিয়ে আসা এক সফর হিসেবে অবশ্যই আখ্যায়িত করতে হয়। জাপানের পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া অভ্যর্থনা আতিথেয়তা ছিল নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। দুই নেতার মধ্যে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়তর করার বেশ কিছু প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শান্তিরক্ষায় দুই দেশের দৃঢ় অঙ্গীকার নতুন করে তুলে ধরা হয় এবং বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়াতে করণীয় দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়।

শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের বাইরে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান সম্প্রসারণ ও নাগরিক পর্যায়ের যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাপান যে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা বাংলাদেশের এযাবৎকালে পাওয়া একক বৈদেশিক সাহায্য থোকের মধ্যে সর্ববৃহৎ। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিনিময় দলিলে উল্লেখ থাকা এক হাজার ২০০ কোটি ইয়েন ঋণ-সাহায্যের বাইরে চলতি বছর থেকে শুরু করে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে জাপান ছয় হাজার কোটি ইয়েন বা প্রায় ৬০ কোটি ডলার সাহায্য বাংলাদেশকে দেবে৷ এর পুরোটাই আসবে ঋণ-সাহায্য হিসেবে, অর্থাৎ বাংলাদেশকে এই অর্থ একসময় ফিরিয়ে দিতে হবে। তবে জাপানের ঋণ-সাহায্যের অংশবিশেষ দেশটি একসময় গ্র্যান্ট বা অনুদান সাহায্যে রূপান্তরিত করে নেয়, যার অর্থ হলো, গ্রহীতা দেশকে সেটা আর ফেরত দিতে হয় না। এ ক্ষেত্রেও যে তেমনটা হবে না, তা বলার কোনো কারণ নেই। বৈদেশিক উন্নয়ন সাহায্যের যে তিনটি ভিন্ন অংশ রয়েছে তা হলো অনুদান, ঋণ ও কারিগরি সহায়তা।
জাপানের নতুন ঋণ-সাহায্যের সিংহভাগ খরচ করা হবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানি পুঁজির প্রবেশপথ সম্প্রসারণে বঙ্গোপসাগরীয় বলয়ের শিল্প প্রবৃদ্ধি অঞ্চলের নতুন যে ধারণা শীর্ষ বৈঠকের মধ্যে দিয়ে প্রচারিত হয়, সেটার বাস্তবায়নে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন জাপান বাংলাদেশের দিকে এতটা উদার সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে জাপানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অগ্রগতি, পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি এবং সার্বিকভাবে নতুন ভূরাজনৈতিক বিভাজনের দিকে নজর দেওয়া দরকার। জাপানের অর্থনীতিতে নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি পূর্ব এশিয়ায় হঠাৎ করে উদ্ভূত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির আলোকে বিকল্প বাজার ও উৎপাদন ভিত্তির খোঁজ করা জাপানের জন্য আবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে ভূখণ্ডগত বিরোধ নিয়ে টানাপোড়েন সৃষ্টির মুখে এবং দেশের ভেতরে ক্রমেই উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠতে থাকা জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর অব্যাহত চাপের সামনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে বাগাড়ম্বরপূর্ণ যেসব বক্তব্য তুলে ধরতে দেখা যায়, চীনের তাতে অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে৷ আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধিতে উসকানি দেওয়ার জন্য জাপানের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি চীনকে দায়ী করছেন এবং সুযোগ বুঝে চীনের হাত কামড়ে দিতেও তিনি যে পিছপা হবেন না, তার প্রমাণ তিনি তুলে ধরেছেন কদিন আগে সিঙ্গাপুরে শাংগ্রিলা সংলাপে রাখা ভাষণে।
চীন-জাপানের রাজনৈতিক সম্পর্কে বৈরী হাওয়ার মুখে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে এখন পর্যন্ত এর ক্ষতিকর প্রভাব সেভাবে লক্ষ করা যায়নি। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এই টানাপোড়েন অব্যাহত থাকলে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে যে খুব বেশিদিন প্রভাবমুক্ত রাখা যাবে না, জাপানের নীতিনির্ধারকেরা সে বিষয়ে সচেতন। ফলে জাপানি পুঁজির বিকল্প একাধিক যে গন্তব্যের কথা তাঁরা এখন ভাবছেন, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি আমাদের জন্য অবশ্যই সুখবর। তবে জাপানি পুঁজির গন্তব্যকে সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়িত করে তুলতে হলে বাংলাদেশের এখনো বেশ বড় এক পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে এবং সেই গন্তব্যে পৌঁছানো সহজ করে দেওয়া হচ্ছে জাপানের প্রাথমিক লক্ষ্য। যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে অবকাঠামো, এবং বিশেষ করে জ্বালানি ও গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে, সে রকম এক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য সামনে রেখেই এতটা উদার সাহায্যের হাত জাপানের সম্প্রসারিত করা। তবে এর একটা রাজনৈতিক দিকও অবশ্যই আছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার বাসনা অনেক দিন থেকেই জাপান পোষণ করে আসছে। তবে এখন পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের আলোকে সে পথ অনেকটাই যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। ফলে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য থেকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বদরবারে উপস্থিত থাকাকে জাপানের নীতিনির্ধারকেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করছেন। চলতি বছর শরৎকালে নির্ধারিত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচনে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দুটি দেশ হচ্ছে জাপান ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রার্থী হিসেবে থেকে গেলে জাপান নির্বাচনে জয়লাভ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে না৷ চীনের সঙ্গে বিরোধময় সম্পর্কের বাইরেও তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ এবং সেই সঙ্গে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ও ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে ভোট টেনে নেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সহজ হতে পারে বলে জাপানে অনেকের ধারণা। আর তাই বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা থেকে সরে গেলে জাপানের নিরাপত্তা পরিষদে প্রবেশ খুব সহজ হয়ে উঠবে। সেদিক থেকে উদার সাহায্য প্রদান করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে সে রকম প্রতিশ্রুতি আদায় হচ্ছে জাপানের লক্ষ্য। নিরাপত্তা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা বাংলাদেশের সামনে তাই বলা যায় অনেকটা যেন অযাচিত এক দুয়ার খুলে দিয়েছে।
অন্যদিকে, জাপানের কোনো কোনো মহল বাংলাদেশের এই ভোট কেনার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। জাপানের বৈদেশিক উন্নয়ন সাহায্যবিষয়ক এক গবেষক বলেছেন, বিশাল অঙ্কের যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা জাপান প্রত্যাশা করছে, সেই অর্থ বাংলাদেশের জনগণের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নয়নে খরচ হওয়ার সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না বলে সরকারের সেই পদক্ষেপে তিনি সন্তুষ্ট নন। তাঁর মতে, যৌথ ঘোষণার প্রায় সবটা জুড়েই আছে আমলাতান্ত্রিক এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক খাতের মধ্যকার যোগাযোগ সম্প্রসারণের বাসনা, যা থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে লাভবান হবে জাপানের বিনিয়োগ খাত এবং বাংলাদেশের মধ্যস্বত্বভোগীরা। একই সঙ্গে আবার পরমাণু বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে জাপানের সহযোগিতার বিষয়টিও যৌথ ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পরমাণু জ্বালানি নিয়ে জাপানজুড়ে উদ্বেগের এই সময়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের জ্বালানি বাজারে বিতর্কিত সেই জ্বালানি প্রযুক্তি নিয়ে জাপানের উপস্থিত হওয়াকে তিনি বিপজ্জনক বলেও মনে করেন। তবে সে রকম মতপার্থক্য সত্ত্বেও সফরের সার্বিক ফলাফলে বাংলাদেশের অতৃপ্তি বোধ করার কোনো কারণ নেই। নাগরিক পর্যায়ে জাপানের সঙ্গে যোগাযোগের চমৎকার একটি মাধ্যম যে এখন হয়ে উঠেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য সম্মানিত জাপানি নাগরিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা, জাপান সফরের একেবারে সূচনায় তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ সেই প্রমাণ রাখছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনও ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, দুই দেশের মৈত্রীর সম্পর্ক আরও জোরদার করায় নিজের আন্তরিকতার প্রকাশ প্রধানমন্ত্রী যেখানে তুলে ধরতে পেরেছেন।
তবে পুরো সফরসূচির সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ অধ্যায়টি ছিল নাগরিক সংবর্ধনার নামে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মঞ্চজুড়ে অবস্থান গ্রহণ। নামে সেই আয়োজনকে নাগরিক সংবর্ধনা বলা হলেও এমনকি সরকারের মনোনীত প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূতের জন্যও মঞ্চে রাখা হয়নি কোনো আসন। ফলে সেই নাগরিক সংবর্ধনা হয়ে উঠেছে বিশুদ্ধ অর্থেই আওয়ামী সংবর্ধনা। প্রবাসে রাজনৈতিক দলের এ রকম বাড়ন্ত উপস্থিতি শুধু দুটি দেশের বেলাতেই চোখে পড়ে। সেই দেশ দুটি হচ্ছে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান। অন্য কোনো দেশের বেলায় এ রকম কিছু দেখা যায় না, এমনকি ভারতের বেলায়ও নয়। তাই আমরা যা দেখছি তা হলো, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা অর্জন করলেও এই একটি দিক থেকে আমরা এখনো পাকিস্তানের বস্তাপচা নীতির অনুসারী রয়ে গেছি। ফলে অন্য সব রাষ্ট্রের কাছে পরিত্যক্ত, প্রবাসে নিজস্ব রাজনৈতিক দল ধরে রাখার এই বাসনা নিজেদের জন্য কতটা স্বাস্থ্যকর, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এখন গুরুত্বের সঙ্গে সেই চিন্তাভাবনা করে দেখা দরকার।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷

No comments

Powered by Blogger.