বার্তা উপেক্ষিত, বার্তাবাহক কাঠগড়ায়

কয়েক দিন আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নামক সংস্থাটিকে অভিযুক্ত করলেন। তিনি বললেন, টিআইবি বিদেশ থেকে আনা টাকা গবেষণায় কতটা ব্যয় করছে, তার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সময় হলে সংস্থাটির মুখোশ উন্মোচন করা হবে বলেও একটি সভায় তিনি ঘোষণা করেন। এ বক্তব্যটি নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। এটা স্বীকৃত যে টিআইবি বিদেশি অনুদানপুষ্ট একটি সংস্থা। আর এ অনুদান আসে সরকারের সম্মতি নিয়ে।
তা ছাড়া সংস্থাটির আয়-ব্যয়ের ওপর যেকোনো সময় অনুসন্ধান চালানোর ক্ষমতা দুদকের রয়েছে। এ জন্য কোনো ‘উপযুক্ত সময়ের’ অপেক্ষায় থাকার আবশ্যকতা অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। আশার কথা, টিআইবিও এ ধরনের যেকোনো তদন্ত অনুষ্ঠানের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য টিআইবিসহ দেশের সুশীল সমাজ সব সময় সোচ্চার ছিল। উন্নয়ন-সহযোগীরা বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তির সঙ্গে স্বাধীন দুদক গঠনকে শর্তাধীন করেছিল একপর্যায়ে। সময়াবদ্ধ করেছিল তাদের শর্তের প্রতিপালন। বর্তমান রূপে দুদক প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত অল্প দিন আগের কথা। দুদক গঠনের পরও একে শক্তিশালী করতে সেই উন্নয়ন-সহযোগী আর দেশের সুশীল সমাজ বরাবর সক্রিয় অবদান রেখে চলছে। দুদকের ক্ষমতা খর্বের যেকোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছে তারা। তবে দুদকের ব্যর্থতা কিংবা সীমাবদ্ধতা নিয়ে টিআইবি কিংবা সুশীল সমাজ কিছু কথা বললে তা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে যায় না; বরং সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে দুদকের জন্য সহায়ক হয়। দুদক অতীতে কখনো সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছিল না। এটা বাস্তব। আর এখনো তা নেই। এটাকেও অসত্য বলার সুযোগ দেখা যায় না। তদন্তাধীন এ বিষয়ে দায়িত্বশীল মহলের আগাম মন্তব্য তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করেন। দুদক বিষয়টি অস্বীকার করলেও বাস্তবতা তাই। আলোচ্য বিতর্কের সূচনা দুদককে একটি প্রায় অকার্যকর সংস্থা হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণা প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে।
প্রতিবেদনে যে মতামত এসেছে, তা অপ্রিয়; সন্দেহ নেই। তবে অসত্য কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে গিয়ে অসহিষ্ণু সমালোচনার কোনো আবশ্যকতা আছে বলে মনে হয় না। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই ঘটে চলেছে দুদক ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে। নবম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ নিয়ে টিআইবির এরূপ একটি প্রতিবেদন আলোচনার ঝড় তুলেছিল গত মার্চের মাঝামাঝি। তারা সেই বিশ্লেষণসূচক প্রতিবেদনটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করেছিল। বিতর্ক হয়েছিল সংসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে সাংসদেরা আইন প্রণয়নে খুব কম সময় ব্যয় করেছেন। তথ্যে উল্লেখ করা হয়, এ সংসদ এক হাজার ৩৩২ ঘণ্টা অধিবেশনে মিলিত হয়। এর মধ্যে ২৭১টি আইন পাস করতে সময় ব্যয় করেছে ৫৪ ঘণ্টা। বলা হয়, ৩৫০ জন আইনপ্রণেতার মধ্যে মাত্র ৫৭ জন এতৎসংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেন। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি আইন পাস করতে গড়ে ১২ মিনিট সময় লেগেছে। এ বিষয়ে জানা যায়, যুক্তরাজ্য ও ভারতে আইন পাস করতে তাদের আইনসভার মোট কর্মঘণ্টার অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয়। টিআইবির প্রতিবেদনের উল্লেখ রয়েছে, সেই সংসদের অধিবেশনগুলোতে কোরাম–সংকটে ২২২ ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়েছে। অপব্যয় হয়েছে ১০৪ কোটি টাকা। এতে আরও জানা যায়, বর্তমান সংসদে ‘প্রকৃত প্রস্তাবে’ কোনো বিরোধী দল নেই। এ অবস্থায় সরকারকে দায়বদ্ধ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনুপস্থিত।
প্রতিবেদনটি প্রকাশকালে টিআইবি বর্তমান সংসদকে সাময়িক বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা আশা করছে দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের। টিআইবির প্রতিবেদনটিতে নবম সংসদের শুধু নেতিবাচক চিত্রই আসেনি। এসেছে অষ্টম সংসদের তুলনায় ইতিবাচক কিছু চিত্র। যেমন, অষ্টম সংসদে কোরাম–সংকটে সময় নষ্ট হয়েছিল ২২৭ ঘণ্টা। সেই সংসদে সদস্যদের উপস্থিতির হার ছিল ৫৫ শতাংশ। নবম সংসদে তা ৬৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তেমনি বিরোধী দলের নেতারা অষ্টম ও নবম সংসদে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে ৪৫ ও ১০ দিন। তদুপরি প্রথমবারের মতো নবম সংসদে প্রথম অধিবেশনে সব সংসদীয় কমিটি গঠন করা উৎসাহজনক বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রতিবেদনটি নির্ভরযোগ্য তথ্যবহুল। বিভ্রান্তির সুযোগ খুব কম। আর মতামতের ভিন্নতা তো থাকতেই পারে। এ-জাতীয় তথ্য প্রকাশের পর আশা করা যায়, স্বাভাবিক দায়িত্বশীল মহল বিচ্যুতি দূর করতে যত্নবান হবে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া বরাবরের মতোই উল্টো দেখা গেল। একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বললেন, প্রতিবেদনটি পক্ষপাতদুষ্ট। কেউ টিআইবির এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুললেন। এ ক্ষেত্রেও সংস্থাটির অর্থায়নের উৎস এবং তা জিঙ্গবাদ পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যয় করা হয় কি না, সে বিষয়েও তদন্তের দাবি ওঠে। আরও দািব ওঠে সুশীল সমাজের সদস্যদের আয়ের উৎস খুঁজে দেখার। টিআইবি-সংক্রান্ত অভিযোগের জবাব তারাই দিয়েছে। আর সুশীল সমাজ সদস্যদের আয়-ব্যয়ের হিসাবও দুদক দেখতে পারে যেকোনো সময়। বর্তমান সংসদে বিরোধী দল প্রকৃত অর্থে নেই বলে টিআইবির মন্তব্যে সংসদ ও এর বাইরে প্রতিবাদ হয়েছে। আমাদের বর্তমান সংসদের বিরোধী দল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নতুন কোন সূত্রে গ্রহণযোগ্য, আর কতটা জনসমর্থিত, তার কিছুটা প্রমাণ এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে নিয়ে এল।
আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। সংসদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দািবটিও অভিনব নয়। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে এটা করা হয়েছে বলে মনে হয়। সংসদে আলোচনার পরদিনই ১৪-দলীয় জোটের সভা শেষে এর আহ্বায়ক একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, টিআইবি ও সুজন দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। তিনি এও বলেন যে দেশে অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার অভিলাষে সংস্থা দুটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দািব জানাচ্ছে। এদের আয় ও ক্ষমতার উৎস তল্লািশ করা দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন। শেষোক্ত দাবিটির বিরোধিতার কোনো অবকাশ নেই। সরকার তা করতেই পারে। তবে সংস্থা দুটি দেশকে অস্থিতিশীল করতে কিংবা অসাংবিধানিক সরকার আনতে কখনো সচেষ্ট ছিল, এ বক্তব্যের সমর্থনে কোনো তথ্য আছে কি না? ২০০৭-এ সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও টিআইবি আর সুজনের প্রচেষ্টার ফল নয়। কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদের বিরতিহীন সহিংস কোন্দলে সৃষ্ট অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ একটি সরকার আসা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল বলেই অনেকে মনে করেন। টিআইবি, সুজনসহ এ ধরনের সংস্থার প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। ক্ষমতায় থাকলে এক নীতি আর না থাকলে ভিন্ন, এ বৈপরীত্য আমাদের গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে কণ্টকিত করছে। দুর্নীতির সূচক নিয়ে বিগত সরকারের সময়ে টিআইবির প্রতিবেদনগুলো বর্তমান সরকাির দল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে অবলীলায়। আর এখনকার প্রতিবেদনে উৎসাহী আগের সরকাির দল।
তারাও ক্ষমতায় থাকাকালে এসব প্রতিবেদন নিয়ে বিপরীত আচরণই করেছিল। ১৪ দলের মুখপাত্র টিআইবির প্রতিবেদন-সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে সুজনকেও যুক্ত করেছেন। কোথাও তাদেরও কোনো বিচ্যুতি থাকলে অবশ্যই সমালোচনা করা যায়। তবে অনেকের মতে, সুজন শাসকশ্রেণির বিরাগভাজন হওয়ার প্রধান কারণ নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশ নিয়ে। তাদের প্রকাশিত তথ্যাদিতে পাঁচ বছর আগে প্রার্থীদের সম্পদের সঙ্গে বর্তমান সম্পদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হচ্ছে। আর এ ধরনের তথ্যাদি প্রার্থীদের হলফনামামূলে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া বিবরণী থেকে নেওয়া। সুজন সেগুলো সংকলন করে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ভোটারদের সচেতন করতে সহায়তা করছে। আর এ কাজটা করতে গিয়ে কারও ‘চরিত্রহনন’ হলে সে দায় তাদেরই, সুজনের নয়। এ জন্য সংস্থাটিকে দায়ী করা নৈতিক দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য। মনে হচ্ছে, বার্তাটির দিকে কেউ নজর দিতে ইচ্ছুক নন; বরং পাশ কাটিয়ে যেতে চান। দায়ী করতে থাকেন বার্তাবাহককে। সমালোচনাকে শত্রুতা হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে। অথচ সমালোচকের বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের সংশোধনের সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে সচরাচর তা ঘটে না। কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় বার্তাবাহককে। বার্তা থেকে যায় উপেক্ষিত।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.