মোদিকে নিয়ে আশা ও শঙ্কা by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

নরেন্দ্র মোদির বিস্ময়কর রাজনৈতিক উত্থান ও তঁার সরকারের বয়স এখনো এক মাস পূর্ণ হয়নি৷ কাজেই সরকারের ভালো-মন্দ, সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে কচকচানি করার প্রকৃত সময় এটা নয়৷ রাজনীতির ভাষায় এই সময়টাকে বলে ‘হানিমুন পর্ব’৷ জয়ীরা এখনো একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন৷ ঘোর কাটুক৷ মধুচন্দ্রিমা শেষ হোক৷ আরও কিছু মাস যাক৷ তারপর নাহয় কলম ধরা যাবে৷ এই সময়টায় কলমচিদেরও একটু জিরিয়ে নিতে হয়৷ সেই ভেবেই বেশ ছিলাম৷ কিন্তু কিছু কিছু বিষয় খচখচ করছে৷

নরেন্দ্র মোদি শপথ নিলেন৷ কত অল্প মন্ত্রী! নতুন সরকারের বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব খবর ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, বেশ লাগছিল সেগুলো শুনতে৷ কম মন্ত্রী, কম সরকার, বেশি প্রশাসন৷ এই তো চাই৷ কোষাগার অপচয়ের একটা বড় দিকই হলো মন্ত্রী-সান্ত্রী পালন৷ কম মন্ত্রী যদি বেশি কাজ দিতে পারেন, তাহলে বেশি মন্ত্রীর দরকারটা কোথায়? দিন দুয়েকের মধ্যেই মোদির দ্বিতীয় নিদান জানাজানি হলো৷ কোনো মন্ত্রী তাঁর নিকট-দূর কোনো আত্মীয়কেই মন্ত্রকের কোনো দায়িত্বে নিয়োগ করতে পারবেন না৷ এটাও বেশ লাগল শুনতে৷ মনে ভেসে উঠল আগের জামানার রেলমন্ত্রী পবন বনসলের কেসটা৷ নিজের ভাগনেকে তিনি মন্ত্রকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন৷ করিতকর্মা সেই ভাগনে একজনকে রেলওয়ে বোর্ড মেম্বারের একটা বিশেষ পদে বসাবে বলে কয়েক কোটি টাকার রফা করেছিল৷

ভারতের সিবিআইয়ের তদন্তের জালে ভাগনে বাবাজি ধরা পড়ল৷ বনসলের চাকরি গেল৷ তঁার আর্তিও শোনা গেল ‘আমি নির্দোষ, কিছুই জানি না গোছের’, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না! একটা দিন কাটতে না-কাটতেই প্রধানমন্ত্রীর ফের ফরমান৷ সব মন্ত্রীকে তঁার ও পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব-হলফনামা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে জমা দিতে হবে৷ এটাও বাহ্ বাহ্ ধ্বনি তুলল৷ লোকজন বলাবলি শুরু করল, প্রধানমন্ত্রী ঠিক করেছেন৷ মন্ত্রী হয়েই যঁারা সাপের পঁাচ পা দেখেন, যঁাদের আঙুল রাতারাতি ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়, তঁারা এবার ঢিট হবে৷
মোদি কী ধরনের প্রশাসন চান, কীভাবে কাজ করবেন, কেমনভাবে তঁার টিম সাজাবেন, সেসবও অতি দ্রুত তিনি দেখিয়ে দিলেন৷ কোনো দিন কেন্দ্রে কাজ করেননি৷ গুজরাটের বাইরে পা ফেলতে হয়নি৷ কাজেই গুজরাটনির্ভরতা তঁার থাকবেই৷ ভরসা করার লোকজন তাই তিনি গুজরাট ক্যাডার থেকেই নিয়ে এলেন৷ মুখ্য সচিব নিয়োগ করলেন অর্ডিন্যান্স জারি করে৷ বোঝা গেল, তঁার তাড়া আছে৷ কিছু করে দেখানোর সময় যে স্রেফ পঁাচটা বছর, এ কথাও তিনি বারবার শোনাতে লাগলেন৷ এ-জাতীয় কথাবার্তা মানুষের মধ্যে একধরনের আশা জাগায়৷ হবে কি হবে না, সে তো পরের কথা৷ আমজনতা ভাবে, না, এই মানুষটা কাজের কাজ কিছু করলেও করতে পারে৷ এটা একধরনের মনস্তত্ত্ব৷ সরকার হলো শতকরা ৮০ ভাগ আমলা ও ২০ ভাগ মন্ত্রীর সমন্বয়ের সাফল্য বা ব্যর্থতার কাহিনি৷ গুজরাট শাসনের মধ্য দিয়ে এটাই মোদির মোক্ষম উপলব্ধি৷ আমলাশাহির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে তিনি তাই সুশাসনের বাজি ধরেছেন৷ এটা তঁার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি৷ তঁার বিশ্বাস৷
সবকিছুর মতো সুশাসনের জন্যও একটা আবহ সৃষ্টির প্রয়োজন হয়৷ এই যে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হয়েছে, ব্রাজিলে তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেই তার একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছে৷ সিনেমা দেখতে গেলেও প্রেক্ষাগৃহে একটা আবহ সৃষ্টি হয়৷ অন্ধকার, মায়াবী আবহ৷ দেশ শাসনের ক্ষেত্রেও তেমন একটা আবহের সৃষ্টি করেছেন মোদি৷ সংসদে দাঁড়িয়ে যখন তিনি বলেন, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ কিংবা সব রাজ্যেরই কিছু না কিছু ভালো আছে, সেই ভালোটা আমাদের নিতে হবে অথবা কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্ক দাতা-গ্রহীতার সম্পর্কের মতো নয়, সুশাসনের সেই আবহটা তখনই তৈরি হয়ে যায়৷ যখন তিনি বলেন, তঁার সরকারটা গরিবদের জন্য, ‘স্ক্যাম ইন্ডিয়াকে’ তিনি ‘স্কিলড ইন্ডিয়ায়’ রূপান্তর করতে চান, তখন বিশ্বাস ও ভরসার একটা ফল্গুধারা সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে কুলকুল বইতে শুরু করে৷ সেই আবহটাও তখন সৃষ্টি হয়ে যায়, যেখানে মোদিকে ঘিরে শুরু হয় একটা স্বপ্ন ও কল্পনার মায়াময় জগৎ৷
সেই জগতের জাদু-গালিচায় ভাসতে ভাসতে মোদি তঁার প্রথম বিদেশ সফরের জন্য বেছে নিলেন পাহাড়ঘেরা শান্তিধাম ভুটানকে৷ শপথ গ্রহণে প্রতিবেশী দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কদের আমন্ত্রণ জানিয়ে যে আবহটা মোদি তৈরি করেছিলেন, ভুটান সফর তারই সার্থক পরিণতি৷ প্রতিবেশীদের তিনি এই ধারণা দিতে চেয়েছেন যে তারা অখুশি থাকলে ভারত সুখী থাকতে পারে না৷ গত ১০ বছরে এই ধারণা কেন যে মনমোহন সিং দৃঢ় করতে পারেননি, তা তিনিই জানেন৷ বাংলাদেশ ছাড়া প্রতিবেশী কোনো দেশে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কোনো দ্বিপক্ষীয় সফরে যাননি৷ সে ক্ষেত্রে ভুটানের পর মোদির সফরতালিকায় দ্বিতীয় প্রতিবেশী দেশ সম্ভবত বাংলাদেশ৷ আবহ ধরে রাখতে এসব তিনি করবেন৷
কিন্তু তবু কেন খচখচ করছে আশঙ্কার কাঁটা?
প্রথম কারণ প্রকৃতি৷ হানিমুন পর্ব শেষ হওয়ার আগেই মোদি-সরকারের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ বয়ে আনার ভ্রুকুটি দেখাচ্ছে প্রকৃতি৷ প্রবল অনাবৃষ্টির একটা আশঙ্কা কালো মেঘের মতো অতি দ্রুত ছেয়ে ফেলতে চলেছে ভারতের আকাশ৷ এক সপ্তাহ দেরিতে কেরালায় এবার বর্ষা এল৷ এল বটে, তবে এসেই মাধুরীর মতো যাই যাই শুরু করেছে৷ জলদঘন মেঘ ছাইব ছাইব করতে করতেই ফিকে হয়ে গেল৷ অনাবৃষ্টি বা ক্ষণস্থায়ী বর্ষা দেশের অর্থনীতিকে কোন খাতে টেনে নিয়ে যাবে, সেই আশঙ্কাতেই এখন থ মেরে আছে দেশের অর্ধেক জনতা৷ একদিকে খরাজনিত আশঙ্কা, অন্যদিকে ইরাকে হঠাৎ জটিল হয়ে ওঠা যুদ্ধ-পরিস্থিতি অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল-পিছু আচমকাই পঁাচ ডলার বাড়িয়ে দিয়েছে৷ ডলারের তুলনায় টাকার দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তেলের দাম কড়িকাঠ ছুঁলে কী করে আমজনতাকে স্বস্তি দেবে মোদি সরকার? মাত্র কদিন আগে গোয়া গিয়ে দলীয় বৈঠকে কঠিন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা আগাম শুনিয়ে এসেছেন মোদি৷ বলেছেন, আগামী দিনে ভালো থাকতে হলে এখন কিছুদিন কষ্ট করতে হবে৷ ঠিক এমন ধরনের কথা তিন বছর আগে মনমোহনও বলেছিলেন৷ কিন্তু জনতা তাঁকে রেয়াত করেনি৷ মোদির সৌভাগ্য, আগামী পঁাচটা বছর শরিকদের খামখেয়ালিপনার ওপর তঁাকে নির্ভর করতে হবে না৷ কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত সময়ও এটাই৷ কিন্তু তা যদি অসহনীয় হয়ে ওঠে, মারটা যদি প্রকৃতির দিক থেকে আসে, তাহলে বোঝার ওপর তা নিছকই শাকের অাঁটি হয়ে দঁাড়াবে৷ গত দুই বছরে জেরবার মানুষ মোদির সরকারের কাছ থেকে কোনো ‘রিলিফ’ পাবে না৷
নতুন প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতির বিকাশের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন৷ মৌসুম যদি পক্ষে না থাকে, সেই বিকাশও কিন্তু মরীচিকার মতো হয়ে দাঁড়াবে৷ মূল্যবৃদ্ধি রোখাই তখন হয়ে যাবে মোদি প্রশাসনের একমাত্র কাজ৷ বিকাশ দূরে দাঁড়িয়ে হাতছানি দেবে৷
বিকাশের প্রশ্নেই এসে পড়ে দ্বিতীয় আশঙ্কা৷ মুজফফরনগরের দাঙ্গার কথা মনে আছে? উত্তর প্রদেশের পশ্চিম প্রান্তের এই বিস্তীর্ণ এলাকায় সেই দাঙ্গার ক্ষত থেকে আজও রক্ত ঝরছে৷ দাঙ্গার পেছনে কে বা কারা ছিল, কাদের উসকানিতে এত বড় মারণযজ্ঞ ঘটে যায়, সেই গবেষণা আজও অব্যাহত৷ কিন্তু দাঙ্গার রাজনৈতিক নিট ফল? হিন্দু মেরুকরণ৷ ৮০ আসনের উত্তর প্রদেশে বিজেপি ও তার সহযোগী দল ৭৩টি আসন জিতে নিল৷ সরকার গড়ল মোদির বিজেপি৷ এই জয় প্রকট হিন্দু মানসিকতায় এতটাই হাওয়া দিয়েছে যে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, কর্ণাটক ও কেরালায় শুরু হয়েছে এক অসহনীয় পরিবেশ৷ কোথাও বৌদ্ধদের সঙ্গে সংঘাত বেধেছে কট্টর হিন্দুদের, কোথাও মুসলমানদের সঙ্গে, কোথাও বা খ্রিষ্টানদের সঙ্গেও৷ কোথাও ধর্ম নয়, প্রাধান্য পাচ্ছে স্রেফ অসহিষ্ণুতা৷ মহারাষ্ট্রে হিন্দু রাষ্ট্র সেনা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে এক মুসলমান যুবককে৷ যুবটির অপরাধ, সে ফেসবুকে মোদিকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিল৷ উত্তর প্রদেশে আম্বেদকরে মূর্তিতে রং লেপার জন্য বিজেপির লোকজনের সঙ্গে দাঙ্গা হয়ে গেছে৷ কেরালার একটি কলেজে ক্রসওয়ার্ড পাজলে মোদিকে তুলনা করা হয়েছিল হিটলার, লাদেন ও সিনিয়র জর্জ বুশের সঙ্গে৷ নয়জন ছাত্রকে সে কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এই অসহিষ্ণুতা, এই মারধর, এসব দাঙ্গাবাজ কিন্তু ক্রমেই মাথাচাড়া দিচ্ছে৷ এরাই যদি ক্রমে ক্রমে নৈতিক অভিভাবক হয়ে সমাজে লাঠি ঘোরায়, এরাই যদি হয়ে দঁাড়ায় সমাজের স্বঘোষিত অভিভাবক এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাক থাকেন, তাহলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ধার করে বলতেই হবে, ‘সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়৷’
মনটা কু গাইছে এই জন্যই৷ অশান্তির আবহে উন্নয়ন বা বিকাশ হতে পারে না৷ নিরন্তর সন্দেহ কখনো সুস্থতার লক্ষণ হতে পারে না৷ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি বারবার বলেছেন, এখন তিনি দেশের প্রতিটি মানুষের প্রধানমন্ত্রী৷ কোনো বিশেষ দলের নন৷ তিনি সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলেছেন, সবার সঙ্গে এগোনোর অঙ্গীকার করছেন৷ পরমত ও পরধর্মসহিষ্ণুতা পালনের ওপর জোর তঁাকে দিতেই হবে৷ দুঃখের বিষয়, দাঙ্গাবাজদের রুখতে বা স্বঘোষিত সমাজপতিদের রাশ টানতে এখনো তঁার মুখ থেকে একটা বাক্যও উচ্চারিত হয়নি৷ সমালোচনা তিনি যদি না নিতে পারেন, অন্যদেরও তাহলে সহিষ্ণুতা শেখাতে পারবেন না৷ সমাজ যদি অশান্ত থাকে, উন্নয়ন বা বিকাশও তাহলে আড়াল থেকে উঁকি মেরে চলে যাবে৷ ইতিহাস নরেন্দ্র মোদিকে চিহ্নিত করবে সেই নায়ক হিসেবে, যঁার কথায় ও কাজে আসমান-জমিন ফারাক৷

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.