প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে by আনিসুল হক

‘আম্মা, আম্মা,’ পাঁচ বছরের জাহাঙ্গীর তার মায়ের বুকের মধ্যে মাথা লুকিয়ে বলে, ‘ফির সেই আওয়াজ, আম্মা!’
মা বলে, ‘নিন্দ যাও, জাহান। নিন্দ যাও।’
‘আম্মা, ওরা আবার আসছে।’
‘না। ওরা চলে গেছে। ওরা আর আসবে না।’
‘তাইলে আবার আওয়াজ হয় কেন?’
‘না, বাচ্চা, মনে হয় আসমান ডাকছে। ডর কোরো না। ঘুমাও।’
মা ছেলেকে ঘুম পাড়াতে চায়। ছেলের চোখমুখ থেকে ভয় যায় না। সে বলে, ‘আগুনরে খুব ডর লাগে। আসমান পর্যন্ত উঠেছিল আগুন। লাল রঙের আগুন। কী তার তাপ! কত দূরে আমরা। তবু আমাদের গায়ের পশমও যেন পুড়ে যাচ্ছিল।’
‘হ্যাঁ আব্বাজান। আমরা অনেক দূরে। এত দূরে ওই আগুন আসতেই পারবে না। তুমি ঘুমাও।’
‘আম্মা। আগুন এত দূরে আসতে পারবে না। কিন্তু ওই মানুষগুলো যদি আসে? মানুষ তো আসতে পারবে, আম্মা।’
মায়ের বুকটা কেঁপে ওঠে। এমনিতেই ভয়ে, আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায়, দুঃখে, নিরাপত্তাহীনতায় তার মনটা এতটুকুন হয়ে আছে। চার দিন হয়ে গেল। তবু শিরিনের ভয়টা যায় না।
‘না। এত দূরে মানুষ আসবে না।’
‘আম্মা, আমার দোস্ত মাসুম পুড়ে গেছে, আম্মা। শরীরে আগুন লাগলে কি খুব জ্বালা করে, আম্মা?’
‘আব্বা, তুমি কিন্তু ঘুমাচ্ছ না। ঘুমাও।’
‘আম্মা, ওরা আমাদের পাড়ায় কেন আগুন দিল, আম্মা? আমরা বিহারি বলে?’
‘ঘুমাও, বাচ্চা!’
‘আম্মা, তোমার জন্ম কোন দেশে হয়েছিল আম্মা?’
‘এই দেশে হয়েছিল। খালেদা জিয়ার আমলে। এই তো ২৩ সাল আগে।’
‘তাইলে তোমার আম্মার জন্ম কি বিহারে হয়েছিল, আম্মা?’
‘না, বাপজান। তোমার নানিআম্মার জন্ম হইছিল এই দেশে। মুজিবরের আমলে।’
‘তোমার নানিআম্মার জন্ম কি বিহারে হইছিল, আম্মা?’
‘না আব্বা। তাঁর জন্ম হইছিল এই ঢাকাতেই। তখন এই দেশে মনে হয় শেরেবাংলা ছিল মন্ত্রী।’
‘তাইলে আমাদের বিহারি বলে কেন, আম্মা?’
‘আমার নানিআম্মার আম্মার জন্ম মনে হয় হইছিল ইন্ডিয়াতে।’
‘তাইলে আমাদের পাকিস্তানি বলে কেন, আম্মা?’
‘আব্বা, তোমার এইসব বোঝার বয়স হয় নাই, আব্বা।’
‘আমাকে নওশাদ বলছে, এইখানকার জমির জন্য নাকি যত গন্ডগোল। এই কলোনি তুলে দিয়ে নাকি এইখানে বিল্ডিং বানাবে। ১৫ তলা বিল্ডিং।’
‘তুমি ঘুমাও তো আব্বাজান।’
‘না, তুমি বলো। আমি না শুনে ঘুমাব না। তোমাকে বলতেই হবে।’
সেই সব কথা কী করে শিরিন এখন বলে তার ছেলেকে? সে নিজেই কি সব বোঝে? সে হয়তো এমন করে বলতে পারে—জাহাঙ্গীর, তোমার আব্বার দাদার জন্ম হয়েছিল ইন্ডিয়ায়। বিহারে। সেইখানে খুব রায়ট লেগে গিয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। বিহারিরা আশ্রয়ের খোঁজে চলে এসেছিল কলকাতায়। তারপর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পূর্ব বাংলায়। সে তো ইংরেজ আমলের কথা। তারপর ইংরেজরা চলে গেল। ইন্ডিয়া হয়ে গেল দুই ভাগ। ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হলো। তাকে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান। আর এখন যেটা পাকিস্তান, সেটাকে বলা হতো পশ্চিম পাকিস্তান। দুই অংশের মধ্যে এক হাজার মাইলের দূরত্ব। পাকিস্তানিরা এই দেশে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। তারা এই অঞ্চলকে শোষণ করে। এই অঞ্চলের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার মানতে চায় না। এই অঞ্চলের বাঙালিরা জেগে ওঠে বাঙালিত্বের চেতনায়। উর্দুভাষী মোহাজেররা স্বভাবতই পশ্চিম পাকিস্তানপন্থী। কিন্তু এই দেশে এমন বিহারিও তো প্রচুর ছিলেন, যাঁরা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। এই দেশে বিহারি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও আছেন। কবি নওশাদ নূরীর মতো কবিরা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে কবিতা লিখেছেন। ছয় দফা আন্দোলনের সমর্থনে, শেখ মুজিবের পক্ষে উর্দু পত্রিকা বের হতো।
শিরিন এই সব কথা শুনেছে তার বন্ধু শবনমের দাদার কাছে। তার দাদা একজন সাহিত্যিক। উর্দুতে কবিতা লেখেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। তাদের এই সব গল্প শোনাতেন তিনি।
তারপর এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। বিহারিরা পাকিস্তানিদের সমর্থন করল বেশির ভাগই। বাঙালি বিহারি রায়টও হলো অনেক জায়গায়। বাঙালিদের হাতে বিহারি মরল। বিহারির হাতে বাঙালি। বাঙালিরা একজোট হয়ে যুদ্ধ করল। কোনো কোনো উর্দুভাষী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছে বটে। তারপর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। এখানকার উর্দুভাষী মানুষের নিরাপত্তা হয়ে পড়ল তখনকার প্রশাসনের প্রধান দুশ্চিন্তার বিষয়। ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও িমরপুরে যুদ্ধ হয়েছে ডিসেম্বরের শেষেও। বিহারি অঞ্চলটা ছিল বাঙালিদের জন্য অপ্রবেশ্য। সেখানেই নিখোঁজ হন জহির রায়হান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও। সেখানে বড় যুদ্ধ হয় বিহারি আর মিত্রবাহিনীর।

পাকিস্তানকে নিজের দেশ ভেবে একদিন বিহারিরা চলে এসেছিল এই দেশে। ১৯৪৭-এর পরেই তারা বুঝে যায় এই দেশে তারা স্বাগত নয়। তাদের অন্তরে পাকিস্তান। এ দেশের মানুষের অন্তরে বাংলা। পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে যায়। এখন ভারত তাদের নেবে না। ভারত তাদের দেশ নয়। তারা নিজেদের পাকিস্তানি ভাবে। তাদের পরিচয় দাঁড়ায় আটকে পড়া পাকিস্তানি। কিন্তু পাকিস্তান তাদের নেয় না। আবার তারা আটকে পড়া পাকিস্তানি পরিচয় ছাড়েও না, প্রধানত তাদের নেতাদের প্ররোচনায়, আর কতগুলো বাস্তব সুবিধার কারণে। আটকে পড়া পাকিস্তানি পরিচয় তাদের আবাসন দিয়েছে। যদিও বড় মানবেতর সেই আবাসন। একটা ছোট্ট ঘরে বাবা-মা, দাদা-দাদি, বয়স্ক ছেলেমেয়ে। এই ঘরেই তাদের জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ-বাসর, রোগ-শোক, দাম্পত্য। রান্নাবান্না। আশার কথা, ভোটার তালিকায় তাদের নাম উঠেছে।
‘আম্মা, বলো তুমি, কী হয়েছিল? না হলে আমি ঘুমাব না।’ ছোট্ট জাহাঙ্গীর মায়ের মুখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে।
‘ঘুমাও বাবা। ওই শোনো আওয়াজ হচ্ছে। ওরা আসছে।’
‘ওরা কারা, আম্মা?
‘বাঙালিরা!’
জাহাঙ্গীর ঘুমিয়ে পড়ে।
(এই কাহিনি কাল্পনিক। এর চরিত্রগুলো কাল্পনিক। কাল্পনিক ধরে নিলেই আমাদের দিবস-রজনী আহার-নিদ্রা নির্বিঘ্ন হয়। তবে জাতি হিসেবে যদি আমরা উন্নত হতে চাই, দেশ হিসেবে যদি আলোকিত হতে চাই, বৈচিত্র্যকে ধারণ ও লালন করতে আমাদের পারতে হবে। বহু ধর্ম, বহু বর্ণ, বহু ভাষা, বহু নৃগোষ্ঠীর সমমর্যাদাপূর্ণ দেশ হয়ে উঠতে হবে আমাদের। এই দেশ শুধু বাঙালির নয়, এই দেশ শুধু মুসলমানের নয়, এই দেশ সব নাগরিকের। এবং কারও অধিকার এক বিন্দু কম বা বেশি নয়।)
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.