আইসিটি আইন -এই কালাকানুন আমরা কেন রাখব? by মশিউল আলম

‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল, বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন, অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

কোনো ব্যক্তি এমন অপরাধ করলে ‘তিনি অনধিক ১৪ বৎসর এবং ন্যূনতম সাত বৎসর এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ এ ধরনের আইন কোনো দেশে বলবৎ থাকলে সে দেশের নাগরিকেরা, বিশেষত ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে? এমন আইন যে সরকার প্রণয়ন ও বলবৎ করে, সেটা কেমন সরকার?
খালেদা জিয়ার চারদলীয় জোট সরকার ২০০৬ সালে পাস করেছিল এ রকম একটা আইন। নাম ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’। অবশ্য আইনটি প্রয়োগ করার সুযোগ তারা পায়নি। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার মতলবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের মতো ব্যবহার করতে গিয়ে অচিরেই ডেকে এনেছিল জরুরি অবস্থা। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়নি ওই আইন প্রয়োগের। তারপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার তার মেয়াদের একদম শেষ পর্যায়ে এসে খালেদা সরকারের পাস করা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি সম্পূর্ণ একক উদ্যোগে সংশোধন করে আরও ভয়ংকর রূপ দিয়েছে। গত অক্টোবরে সংশোধিত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন ২০১৩’ নামের আইনটি এখন এক বিপজ্জনক কালাকানুন, যেটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম, কারারুদ্ধ হয়েছেন একজন সম্পাদক ও দুজন মানবাধিকারকর্মী।
বিদ্যমান প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট প্রয়োগ করে কোনো জাতীয় গণমাধ্যমের সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে অনির্দিষ্টকাল ধরে কারারুদ্ধ করে রাখা, কিংবা কোনো জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের প্রকাশনায় বাধা সৃষ্টি করে তার পাঠকদের মাসের পর মাস পত্রিকা পড়া থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব ছিল না। স্কাইপ কেলেঙ্কারির দায়ে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকের গ্রেপ্তার ও তাঁর মামলাটি নিয়ে কথা বলার ওপর আদালতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাব-এর অনলাইন সংস্করণে সাতক্ষীরায় ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতি-সম্পর্কিত গুজবের সংবাদ পরিবেশনকে কেন্দ্র করে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া ও তিনজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা সম্পর্কে এটুকু তো বলা যায় যে তাঁদের অপরাধ এতই গুরুতর কি না যে ঘটনার তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগেই পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হলো? যদিও ইনকিলাব ভীষণ দায়িত্বহীন কাজ করেছে।
প্রশ্ন তোলা যায়, মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান ও পরিচালক এস এম নাসির উদ্দিনের গ্রেপ্তার, কারাভোগ ও মামলা সম্পর্কেও। এই দুজন মানবাধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়াটি দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। আদিলুর রহমানের গ্রেপ্তারের পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশীয় শাখার পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আদিলুর খানের গ্রেপ্তারের ঘটনাটিকে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে সোচ্চার সমালোচকদের একজনের কণ্ঠরোধ করার উদ্যোগ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।’ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম সম্প্রতি এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেছে, ‘মানবাধিকারকর্মীরাও জবাবদিহির আওতাধীন কিন্তু জবাবদিহি যেন রাষ্ট্র কর্তৃক হয়রানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হয়। আইন যেন মানবাধিকারকর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে এবং নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে।’
২০০৬ সালের আইনটিতে ওপরে উল্লিখিত অপরাধের সর্বোচ্চ দণ্ড ছিল দশ বছর কারাদণ্ড ও অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড। সংশোধনীর পর সর্বোচ্চ দণ্ড বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৪ বছর কারাদণ্ড; ন্যূনতম দণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে সাত বছর কারাদণ্ড। এ ছাড়া পুলিশকে সরাসরি মামলা দায়ের করার ও পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিছু অপরাধের অভিযোগ ওঠামাত্র অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যাবে এবং তাঁর জামিন পাওয়ার কোনো অধিকার থাকবে না।
সাধারণ নাগরিকদের জন্য তো বটেই, ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের জন্যও এটি একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ আইন। প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট ও প্রেস কাউন্সিল থাকার কারণে মুদ্রিত সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা যে সুরক্ষা পেয়ে থাকেন, এই আইন তাকে অর্থহীন করে দেয়। এখন প্রায় প্রতিটি মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের একটি করে অলনাইন সংস্করণ আছে। মুদ্রিত সংস্করণে কোনো মিথ্যা তথ্য, মানহানিকর বিষয়বস্তু ও ছবি প্রকাশিত হলে তার আইনি প্রতিকারের জন্য প্রথমে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করার বিধান আছে। সেখানে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে প্রেস কাউন্সিল অভিযুক্ত সংবাদমাধ্যমকে ভুল স্বীকার/সংশোধনী/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পাল্টা বক্তব্য প্রকাশের নির্দেশ দেয়, একই আচরণের পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভর্ৎসনা করে। আর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রেস কাউন্সিলে না গিয়ে ফৌজদারি বা দেওয়ানি আইনের অধীনে সরাসরি আদালতে মামলা করলে এবং সেখানে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে ফৌজদারি আইনে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং দেওয়ানি আইনে অর্থদণ্ডের বিধান আছে। অর্থদণ্ড কোটি টাকার অঙ্কেও হতে পারে, কিন্তু এ পর্যন্ত কারও এমন কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। অথচ একই তথ্য কিংবা ছবি অনলাইন সংস্করণে প্রকাশের দায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে তার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি কঠোর দণ্ডের বিধান বস্তুত পুরো সংবাদমাধ্যমকেই বিরাট ঝুঁকির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এত দিন যে স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে, এ আইনের কারণে তা ভীষণভাবে খর্বিত হবে। সরকার কোনো সংবাদমাধ্যমের ওপর ক্ষুব্ধ হলে সেই সংবাদমাধ্যমের অস্তিত্ব ও সেখানে কর্মরত সাংবাদিকদের জীবিকা সংকটের মুখে পড়ে যেতে পারে, যার দুয়েকটি দৃষ্টান্ত আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি।
বাংলাদেশের সংবিধানে তথ্য ও সংবাদক্ষেত্রের যে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন তার সঙ্গে চেতনাগতভাবেই অসংগতিপূর্ণ। এটি একটি অতি বিপজ্জনক কালাকানুন, যা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবে এ কথাও সত্য যে ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও জবাবদিহি-দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সে জন্য একটি আইন অবশ্যই থাকা উচিত, তবে আইনটি কালাকানুন হলে চলবে না; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধন করা জরুরি প্রয়োজন।
শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই পাস করেছিল একটি গণমুখী আইন, যেটি তার আগের খালেদা জিয়ার সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েও করেনি। আইনটির নাম তথ্য অধিকার আইন ২০০৯। আইনটির খসড়া প্রণয়নের প্রক্রিয়াটিও ছিল বেশ প্রশংসনীয়। আইন কমিশনের তৈরি করা একটি প্রাথমিক খসড়ার ওপর ভিত্তি করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা একটি সংশোধিত ও পরিবর্ধিত খসড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে সেই খসড়াটি ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করে নাগরিকদের মতামত, সুপারিশ ইত্যাদি আহ্বান করা হয়েছিল। তথ্যসচিব নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছিলেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অনেকে অনেক রকম সুপারিশ করেছিলেন, অনেক সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছিল। এভাবে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তথ্য অধিকার আইনের খসড়া চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল এবং সংসদে তা পাস করা হয়েছিল।
একই রকমের অংশ্রগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হোক।

মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.