নীল অপরাজিতা নান্দনিক

গল্পে অজস নাটকীয় সংলাপের মাধ্যমে পাঠকের কৌতূহল সৃষ্টির একটি কৌশল রপ্ত করেছেন কথাসাহিত্যিক মাসুদ আহমেদ। ঘটনা পরম্পরায় শেষটায় রহস্য উন্মোচিত হয় বটে; চলতি পথে অনেক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং না জানা কথার আস্বাদনে পাঠক তৃপ্ত হবেন। জনাব আহমেদের ‘বিপ্রতীপ’ এমন একটি কাহিনী। প্রয়োজন যখন আদর্শকে ছাপিয়ে যায় তখন এরকম বর্ণনায় ভাববাদীরা ব্যথিত হতে পারেন তবে বাস্তববাদীরা তৃপ্ত হবেন। তুখোড় বাম রাজনীতির নায়ক লেনিন যখন, একই আদর্শের পরিণত প্রেমিকা নায়িকা অর্পাকে ছেড়ে মরু দেশের উদ্দেশে পাড়ি জমায় আদর্শ বিচ্যুতির কথা বলে, তখন সন্দেহ হয় লেখক কোনো ঘরানার হয়ে এসব চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন কিনা। যদিও লেখকের এ অবস্থানের যুক্তিও অস্বীকার করার পথ নেই। ইংরেজদের ভারত দখল এমনকি বিশ্বজয়ের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এককালের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর ক্ষুব্ধ অবস্থান আর সে বিষয়কে বিদেশে অবস্থানকারী প্রবাসী চাচার ভিন্ন মাত্রায় চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে প্রো এবং এন্টি সাম্রাজ্যবাদের একটি অবস্থান খোলাসা করতে লেখক আগাগোড়া সচেষ্ট ছিলেন। সম্ভবত এ বিবেচনাতেই বইটির নাম হয়েছে ‘বিপ্রতীপ’। তবে তত্ত্ব এবং তথ্য উপস্থাপনের কড়া বুলিতে অর্পা লেনিনের প্রেম ফিকে হয়ে গেছে কখনও কখনও। লেখক দেখানোর চেষ্টা করেছেন জীবনে বাস্তবতাই সব। প্রেম, আবেগ, আদর্শ নিয়ে শ্রেণী চরিত্র দ্বারা নির্দিষ্ট হয়ে বেঁচে থাকাটাই সত্যি।
নায়ক লেনিন কোন প্রক্রিয়ায় ইরাক যুদ্ধে যুক্ত হলেন তার বিশদ বর্ণনা না থাকলেও কাবুলে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সেনা নিধনের দুর্মর স্পৃহা তাকে সম্মুখ যুদ্ধে ধাবিত করে। এখানে যুদ্ধের বর্ণনাটি দুর্ধর্ষ, টান টান উত্তেজনা সৃষ্টির মতো। নায়ক নিজেই বুলেটবিদ্ধ হয়ে টের পান যে তিনিও একজন সাধারণ মানুষ এবং তারও চিকিৎসার প্রয়োজন। বেঁচে থাকার জন্য তখন দেশে ফিরে জাল কাগজ তৈরি করে ইংল্যান্ডে সেই চাচার কাছে তাকে ফিরে যেতে হয়। যাকে সে চিহ্নিত করেছিল ভোগবাদী, সাম্রাজ্যবাদী বলে। অর্থাৎ লেনিন স্থিত হল শ্রেণী চরিত্রের মধ্যে। যা পুঁজিবাদের অমোঘ ক্রিয়াকৌশলের সফলতা বলে পাঠকের কাছে মনে হবে। এখানে লেখকের অবস্থান নির্মোহ। কারণ অন্যসব মত, বিশেষ করে সম্পদ সম বণ্টনের সব তত্ত্ব মিলিয়ে গিয়ে শ্রেণীবিভক্ত মানব সমাজের দৃঢ় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে ৯০-এর দশকের দিকে বিশ্ব দৃকপাত করতে পারে। হ্যাঁ, ঘুরেফিরে পুঁজিবাদ, বিজ্ঞান এবং আভিজাত্যবাদের জয়জয়কার। বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীরা উধাও। তাদের কন্যারা যুক্তরাজ্যে ব্যারিস্টারি পড়েন। নায়ক-নায়িকা, এই তন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে স্ববিরোধিতায় আক্রান্ত। এ ছবি নির্মাণে লেখক সফল- বলতেই হবে। সেই সঙ্গে আস্তিকতা, পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের আকর্ষণ, মেধার আধিপত্যের যে চিত্রকলা লেখক একেছেন তা খণ্ডন করা দুঃসাধ্য হবে।
এ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসটির খুব কাছাকাছি। বক্তব্যে এবং মানের দিক দিয়ে। বাঙালির দেশত্যাগ (Emigration)-এর বাস্তব কার্যকারণ নিয়ে মাসুদ এ বইতে যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা করেছেন। এ কথা তো সত্য যে ধনিক শ্রেণী এবং বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণীর মানুষ পাশ্চাত্যের প্রতি অনুরক্ত। সম্পদের, যোগ্যতাভিত্তিক বণ্টনের সুবিধা এবং ইহলোকে ভোগ করার এমন চমৎকার ব্যবস্থা পাশ্চাত্য ছাড়া আর কোথায় আছে? লেখক তাই অনেক আগের লেখক নিরোদ চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ বই থেকে যুৎসই উদ্ধৃতি টানেন যা তার উপস্থাপনা কৌশলকে আরও শক্তিশালী করে। বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী, সম্রাট বাহাদুর শাহ, লর্ড ক্যানিং, সিপাহী বিদ্রোহ ইত্যাদির প্রসঙ্গ টেনে লেখক বইটির বিশ্বাসযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তারপরও বলতে হয় যে লেখক তার লেখা থেকে আর একটু দূরত্ব বজায় রাখতে পারতেন।
শ্রেণী চরিত্রের কারণেই নিজ দেশের জনভিত্তি, শাসনব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নায়কের আস্থা নেই। তাই এ ক্ষেত্রে নায়কের বন্ধু ডাক্তারের এত প্রয়াসের পরও বেঁচে থাকার তাগিদে যে ছল চাতুরির আশ্রয় লেনিনকে নিতে হল, তার প্রয়োজন ছিল। এখানকার সেরা ডাক্তারও বলেছিলেন, এবডোমেন রিওপেন করতে হবে। এ স্থানটিতে লেখকের যে বিশ্বাস বাস্তবতাকে নির্মাণ করেছে সে বাস্তবতা নিজে পূর্ণ সত্যে পরিণত হয়েছে।
বিপ্রতীপ উপন্যাসের লেখক যে কারণে গল্পটি উপস্থাপনে পূর্ণভাবে সফল তা চিত্রিত হয়েছে এভাবে: জীবনে বেঁচে থাকা, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যিনি বা যারা বেশি সেবা দেবেন তারাই নমস্য। মতাদর্শিক পার্থক্য বাস্তবসম্মত নয়, বরং তা শ্রেণী স্বার্থ জড়িত। এরকম একটি সাহিত্য রচনায় চিন্তাশীল মানুষ নতুনভাবে কিছু বিষয়কে দেখার সুযোগ পাবেন বলে অনুমান করি। অনতিক্রম্য অনুষঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরদর্পে এ উপন্যাসে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছেন। ঠাকুর কবির কাছে মানুষ জীবনযাপনের সব পর্বে আশ্রয় পেতে পারে এরকম দৃঢ় বিশ্বাস থেকে জনাব আহমেদ তার উপন্যাসে রবীন্দ্র সাহিত্য থেকে উদ্ধৃতি দেন। রবীন্দ্রনাথকে প্রতিদিনের জীবনে বাস্তব করে তোলার এরকম চেষ্টা আমাদের সাহিত্যে এর আগে হয়েছে কিনা তার কোনো ভূরিভূরি প্রমাণও নেই। সাতচল্লিশ-পূর্ব থেকে লাদেনের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে চিত্রিত এ উপন্যাসটি ১২০ পৃষ্ঠার কলেবরে ক্ষীণ স্বাস্থ্যের হয়েছে বলতে দ্বিধা নেই। তবুও বইটি সংগ্রহে রাখা যে কোনো সচেতন পাঠকের কাম্য হবে বলে বিশ্বাস রাখা যায়।
ইলিয়াস আহমেদ

No comments

Powered by Blogger.