কালের পুরাণ- সুজাতার সফরে বাংলাদেশ কী পেল? by সোহরাব হাসান

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের সফরটি নিছক শুভেচ্ছা সফর ছিল না। ছিল তার চেয়েও কিছু বেশি। তবে কতটা বেশি এবং কতটা ফলপ্রসূ, সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সুজাতা সিং ঢাকায় আসার আগের দিন টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ইন্দ্রানী বাগচি লিখেছেন, ‘ভারত তার শীর্ষ কূটনীতিক, পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে পাঠাচ্ছে ঢাকার রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে, যেখানে দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল এরশাদের জাতীয় পার্টি আসন্ন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। দিল্লির কূটনীতিকেরা মনে করেন, সুজাতা সিংকে তাঁর পূর্বসূরির চেয়ে অনেক বেশি ঝঞ্ঝাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।(টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৩ ডিসেম্বর ২০১৩)
চার মাস আগে সাউথ ব্লকের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিবেশী বাংলাদেশে এটাই সুজাতা সিংয়ের প্রথম সফর। তিনি পেশাদার কূটনীতিক, ভারতের তৃতীয় নারী পররাষ্ট্রসচিব, এর আগে চোকিলা আয়ার ও নিরুপমা রাও এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে অন্য একজনকে পররাষ্ট্রসচিব করায় বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে সফল দায়িত্ব পালনের পর দেব মুখার্জিকে নেপালের রাষ্ট্রদূত করা হলে কূটনৈতিক মহল অবাক হয়েছিল। তাঁকেও পররাষ্ট্রসচিব করা হয়নি। সেদিক থেকে সুজাতা সিংকে ভাগ্যবানই বলতে হবে।
দিল্লির স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সুজাতা সিংয়ের বাংলাদেশকে বুঝতে-জানতে অসুবিধা হলো, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে রাষ্ট্রদূতের গুরুদায়িত্ব পালন করলেও উপমহাদেশের কোনো দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। আর সুবিধা হলো, প্রতিবেশী দেশগুলো সম্পর্কে আগে থেকে একটি ‘মাইন্ড সেট’ তৈরি না থাকায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন করে দেখার ও ভাবার সুযোগ আছে।
প্রথম ঢাকা সফর সুজাতা সিংকে কিছুটা বিব্রত করেছে বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও সহিংসতা। বিরোধী দলের অবরোধ ডিঙিয়েই তাঁকে ঢাকা শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছোটাছুটি করতে হয়েছে। সুজাতা সিং বারিধারায় যখন জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন তাঁর বাসার সামনে শত শত দলীয় নেতা-কর্মীর ভিড় ছিল, তাঁরা এসেছেন বা আনানো হয়েছে দলপ্রধানের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে।
একজন বিদেশি কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করার মতো মানসিক অবস্থা তখন এরশাদের থাকার কথা নয়। এর আগে ২২ ঘণ্টা অজ্ঞাতবাসে ছিলেন। সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেই এরশাদ ঘোষণা দেন, ‘ওনারা বলেছেন, নির্বাচন করুন। আমি নির্বাচন না করলে নাকি জামায়াত-শিবিরের মতো মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসবে। জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় আসুক তা আমিও চাই না। আর ওরা এলে সে জন্য সরকারই দায়ী।’ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এটি মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ঘোষণাটি তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়েও বেশি জরুরি মনে করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে জানানো।
এরশাদের কথাবার্তা শুনে বহু বছর আগে ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকারের একজন প্রতিনিধির আক্ষেপের কথাই মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু, তার শত্রুর প্রয়োজন হয় না।’ বিশ্ব কূটনীতিতে কথাটি প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রেক্ষাপটে কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, ‘এরশাদ যার বন্ধু, তার শত্রুর দরকার হয় না।’
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব যে অভিজ্ঞতা নিয়ে গেলেন বাংলাদেশ থেকে, তা তাঁর জন্য যত না অস্বস্তিকর, তার চেয়ে বেশি লজ্জাকর বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের জন্য। প্রতিবারই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাজিয়া লাগে এবং বাইরে থেকে সেই কাজিয়া মেটাতে বিদেশিদের আসতে হয়। আগে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এসব ব্যাপারে উপদেশ-পরামর্শ দিত। এখন তাদের সঙ্গে দুই আঞ্চলিক শক্তি—ভারত ও চীন যোগ দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনী সহিংসতায় ভারত উদ্বিগ্ন।’ যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে।
সত্য যে, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং জনগণের অদম্য কর্মশক্তির কারণে একদা তলাবিহীন ঝুড়ি নামে পরিচিত দেশটি বিশ্বের মানচিত্রে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু রাজনীতিকেরা সেই অগ্রসরমাণ বাংলাদেশকে ধারণ না করে মধ্যযুগীয় গোত্র সংস্কৃতিকে লালন করছেন, যার কাফফারা দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে।
গেল সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনাকালে ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ও সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে বেশ অনুশোচনা লক্ষ করা গিয়েছিল। দিল্লির সাংবাদিক ও কূটনীতিকেরা মনে করেন, শেখ হাসিনার সরকার সীমান্তে ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে যে সাহসী ভূমিকা নিয়েছে, ভারতের উচিত ছিল তার বিনিময়ে আরও কিছু দেওয়া। দুর্ভাগ্য, সেটি হয়নি। তবে তাঁরা এ কথা জানাতে ভোলেননি যে গত পাঁচ বছরে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে; ভারতীয় ঋণে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে, বাংলাদেশ ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে, যার পুনরুল্লেখ দেখলাম সুজাতা সিংয়ের বিবৃতিতেও।
ঢাকায় ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব নিশ্চয়ই দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা তাঁর কাছে দ্বিপক্ষীয় বিষয় তুলে ধরার চেয়ে নির্বাচনের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতেই বেশি সচেষ্ট ছিলেন বলে ধারণা করি। ভারতের আশঙ্কা, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরে কেউ ক্ষমতায় এলে তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে এবং জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। এসব কারণে বিএনপি নেতৃত্ব বারবার দিল্লিকে আশ্বস্ত করতে চাইছেন যে আগে যা-ই ঘটুক না কেন, ভবিষ্যতে তাঁরা ভারতের সঙ্গে সদ্ভাব রেখেই চলবেন। বুধবার বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুজাতা সিংয়ের সাক্ষাতের পর দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
খালেদা জিয়া দিল্লি সফরের সময়ও অনুরূপ আশ্বাস দিয়েছিলেন। গত ২১ অক্টোবর নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা প্রকাশকালেও তিনি বলেন, ‘জনগণের সমর্থনে ভবিষ্যতে সরকারে গেলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মিলে আমরা একযোগে কাজ করব। বর্তমান সম্পর্ক বহাল রাখার পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর নতুন পথের সন্ধান আমরা করব।’ (প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর, ২০১৩)। কিন্তু খালেদা জিয়ার এই আশ্বাসে যে তাঁরা আশ্বস্ত হতে পারেননি, সেটি ভারতের নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্পষ্ট। বিএনপির সমস্যা হলো, দলটিতে বহু নেতা আছেন, যাঁরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান, আবার দেশটির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ করার নেতার সংখ্যাও কম নয়।
বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লির প্রধান উদ্বেগ জঙ্গিবাদের উত্থান, যার প্রভাব সীমান্তবর্তী পাঁচটি রাজ্য তথা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছে। জামায়াতে ইসলামী এই মুহূর্তে নিবন্ধিত দল না হলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের দ্বিতীয় প্রধান শক্তি। বর্তমানে বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তার মূলেও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বলে ধারণা করা হয়। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ভারতকে যতই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে অভিহিত করুক না কেন, জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে তার অবস্থান পরিষ্কার না করা পর্যন্ত তারা আশ্বস্ত হবে না।
সন্ধ্যায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে সুজাতা সিংয়ের মতবিনিময় সভায়ও ঘুরেফিরে নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসে। তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচনের বিকল্প নেই।
সুজাতা সিং যদিও বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে দূতিয়ালি করতে আসেননি। তবে ভারতের পক্ষে তিনি যে বার্তাটি নিয়ে এসেছেন, সেটি বুঝতে কারোরই অসুবিধা হয়নি। ভারত এই মুহূর্তে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাই চায়। ‘সর্বোচ্চসংখ্যক’ দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায়। সাংবাদিকেরা যখন সুজাতা সিংয়ের কাছে প্রশ্ন করেন, প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তখন তাঁর জবাব ছিল, বাংলাদেশের জনগণই সেটি ঠিক করবে। এ প্রসঙ্গে তিনি নেপাল ও মালদ্বীপের উদাহরণ টেনে বলেন, ওই দুটি দেশের নির্বাচনও কোনো কোনো দল বর্জন করেছে।
এই সর্বোচ্চসংখ্যক কথাটি বেশ ধোঁয়াটে। কিছুদিন আগে নেপালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাওবাদী ১৬টি দলের জোট নির্বাচন বর্জন করে এবং ১০ দিন ধরে হরতাল পালন করে। তা সত্ত্বেও সেখানে গড়ে ৭০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর অর্থ, বর্জনকারীদের পক্ষে ১০ শতাংশ জনসমর্থন ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে যদি ‘সর্বোচ্চসংখ্যক’ দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয় এবং প্রধান বিরোধী দল বর্জন করে, তাহলে চিত্রটি ভিন্ন হবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ ধরনের নির্বাচন বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতি আনবে না, যেটি প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের একান্ত কাম্য।
কূটনীতিকদের মতে, ভারতকেও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে তার বাংলাদেশনীতি গ্রহণ করা উচিত। পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি অগ্রাধিকার পেলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক টেকসই হবে না। ভারতে দীর্ঘদিন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন—এ রকম একজন বাংলাদেশি কূটনীতিক বলেছেন, ভারত যেমন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বহুদলীয় বা জোটগত সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে, তেমনি পররাষ্ট্রনীতিতেও তাদের উচিত বহুপক্ষীয় সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া। অর্থাৎ, সব ডিম এক ঝুড়িতে না রাখার নীতি গ্রহণ করা। তবে ঝুড়িটি তলাবিহিন কি না, তা-ও পরখ করে নেওয়া দরকার।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.