রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আর গণতান্ত্রিক অঙ্গীকার এক নয় by সুলতান মাহমুদ রানা
দেশে
প্রতিটি সরকারের শেষ সময়ে এসে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন প্রশ্নে
সংকট সৃষ্টি যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। ’৯০ পরবর্তী প্রায় প্রতিটি
সরকারের মেয়াদ শেষেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার
সৃষ্টি হয়েছে। কখনও সংকট থেকে সুষ্ঠু উত্তরণ ঘটেছে আবার কখনও রাজনৈতিক
ঘোলাটে পরিবেশ জাতির জন্য চরম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে এবং মেয়াদ শেষ করে ক্ষমতা থেকে চলে যায়। কিন্তু
রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই আনতে পারেনি। রাজনীতিকরা
তাদের প্রদত্ত গণতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্র“তি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকার করা হয় কিন্তু গণতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক পরিবেশ
কোনোটাই রক্ষিত হয় না। নির্বাচনের উদ্দেশ্য হল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
অব্যাহত রাখা, কারণ গণতন্ত্র আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ১১ নং
অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক
মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের
শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ সত্যিকারের গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক শাসনের
কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভর করে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সরকারের আচরণ ও
কার্যক্রমের ওপর। রাজনীতিকরা সাধারণ মানুষকে সব সময়ই বোঝানোর চেষ্টা করেন,
একমাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে
যায় এবং এরপর রূপকথার কেচ্ছার মতো যেন, ‘everyone will live happily
thereafter’ অর্থাৎ সবাই পরবর্তীকালে মহাসুখে বসবাস করবে। গণতন্ত্র কায়েমের
জন্য আর কিছুই দরকার হবে না। তবে এ কথা অবশ্যই ঠিক যে, গণতন্ত্র নিশ্চিত
করতে সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য।
কিন্তু সংসদ নির্বাচনের আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রসম্মত অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার এমন হবে যাতে রাজনৈতিক দলগুলো দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধরে রাখতে সংসদীয় কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। রাজনৈতিক বিরোধিতার জের ধরে বিরোধী দলের নেতার নামে প্লেট চুরির মামলা ঠুকে দেয়া কিংবা ককটেল ফাটানোর মামলায় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কারাগারে বন্দি করে রাখা- এসব গণতন্ত্রের নমুনা নয়। গণতন্ত্রে বিরোধী দলও সাংবিধানিক মর্যাদা পায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সরকারি ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিরোধী দলের যথাযথ মান রাখে না। পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও তা মেনে চলার মানসিকতা এখানে নেই। পরমত মেনে চলার প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মনীষী ভলতেয়ারের বিখ্যাত উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য : I do not agree with a word you say, but ও রিষষ defend to the death your right to say it.’ অর্থাৎ ‘আমি তোমার একটি কথাও সমর্থন করি না, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করব।’ রাজনৈতিক দলগুলোকে আজ একই কণ্ঠে অঙ্গীকার করতে হবে, তারা আজ যে সমঝোতা ও প্রতিশ্র“তি দেবে তা আগামী দিনেও যথাযথভাবে মেনে চলবে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে পুনরায় দেশে কোনো অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে না। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে হতে হবে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও গণতন্ত্রমনা। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিশ্র“তি দেয় ঠিকই, কিন্তু তা রক্ষায় তাদের সফলতার পরিমাণ খুবই কম। সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও দলতন্ত্র ও ফায়দাতন্ত্রের লাগামহীন চর্চার ফলে তারা যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। সংগঠিত নাগরিক সমাজের অধিকাংশ আজ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অনুগত। ’৯০-এর গণআন্দোলনের সময় একতাবদ্ধ শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও অন্য পেশাজীবীদের অনেকেই তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে এখন দলীয় অঙ্গ কিংবা সহযোগী সংগঠনের খাতায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। ফলে তারা গণতান্ত্রিক শাসনকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে অতন্দ প্রহরীর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
দেশের গণতান্ত্রিক শাসনের ব্যর্থতার মূলে আরও একটি বড় সমস্যা হল- সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকলেও দেশে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান অর্থাৎ এখানে প্রধানমন্ত্রীই সব ক্ষমতার মূলে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কিছুই কার্যকর অর্থে করা সম্ভব নয়। সংসদীয় বিধান মোতাবেক সংসদে সরকারের প্রতি অনাস্থা আনার বিধান থাকলেও সংবিধানে বর্ণিত ৭০ নং অনুচ্ছেদের ফলে তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবিধানিক কিছু পরিবর্তন কিংবা সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। কারণ ক্ষমতার কেন্দ বিন্দু যদি এক ব্যক্তিভিত্তিক হয় তাহলে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার মাত্রার চেয়ে দুর্নীতি কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগই বেশি তৈরি হয়। দেশের সাংবিধানিক ধারা মতে, সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মতের বিরুদ্ধে সংসদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে এমনকি ভোটের সময় সংসদে অনুপস্থিত থাকলে পদ হারানোর ভয়ে সংসদ সদস্যরা নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধির বাইরে চলে যান। এটিই হচ্ছে এ দেশে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার নমুনা। যেখানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।
রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও সমাজ গঠনের কোনো আদর্শভিত্তিক পরিকল্পনা কিংবা বক্তব্য দেয় না। ক্ষমতায় যাওয়াই হল দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য। রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস ও দুর্নীতি এখন রাজনীতির বড় নিয়ামক। এখানে নির্বাচন হয়, কিন্তু কীভাবে হয় সেটা একটু বিশ্লেষণ করলেই এর প্রকৃতি অনুধাবন করা যাবে। যেভাবে একজন বিত্তশালী ব্যক্তি হাট কিংবা বাজার ইজারা নিয়ে থাকে, অনেকটা সেভাবেই দেশের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। একজন বিত্তশালী ব্যক্তি হাট বা বাজার ইজারা নেন এজন্য যে, কয়েক বছর পর সেখান থেকে তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করবেন এবং লাভবান হবেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিটি নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত হয়ে সেই টাকা তুলতে অনেকটাই সচেষ্ট থাকেন। অর্থ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হওয়া বর্তমানে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনে ৪০ লাখ টাকা খরচ করলে নির্বাচিত হওয়ার পর তা কীভাবে দ্বিগুণ করা যায় সেদিকেও খেয়াল রাখেন। কাজেই নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হাট বা বাজার ইজারা নিয়ে ব্যবসা করার শামিলই বটে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য দেশের রাজনীতিকরা অতীতে নানা প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো তারা রক্ষা করতে পারেননি। যেমন ১৯৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখা। ওই রূপরেখার মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নানাবিধ সংস্কারের অঙ্গীকার করেছিল। যেমন- জাতীয় সংসদকে সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ বিন্দুতে পরিণত করা, নির্বাচিত সরকারকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু দেশে বিদ্যমান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই তিন জোটের রূপরেখার প্রতিশ্র“তি রাখতে পারেনি। বিরোধী দলগুলো সংসদের অধিবেশন বর্জন করেছে প্রতিনিয়ত। সংসদকে সমস্যা সমাধানের কেন্দ বিন্দুতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতা এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে পুনরায় ক্ষমতা ধরে রাখার নতুন ফন্দি করতে সচেষ্ট না হয়ে গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্র“তি দিন। আমরা চাই সত্যিকার গণতন্ত্র। এজন্য শুধু নির্বাচন নয় বরং নির্বচন পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সমঝোতা এবং তা মেনে চলার অঙ্গীকার আবশ্যক। যে গণতন্ত্রে স্থিতিশীলতা, একে অপরের প্রতি আস্থা এবং জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর ব্যবস্থা আছে, সেই গণতন্ত্রের প্রতীক্ষায় আছি আমরা সর্বসাধারণ।
সুলতান মাহমুদ রানা : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
কিন্তু সংসদ নির্বাচনের আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রসম্মত অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার এমন হবে যাতে রাজনৈতিক দলগুলো দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধরে রাখতে সংসদীয় কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। রাজনৈতিক বিরোধিতার জের ধরে বিরোধী দলের নেতার নামে প্লেট চুরির মামলা ঠুকে দেয়া কিংবা ককটেল ফাটানোর মামলায় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কারাগারে বন্দি করে রাখা- এসব গণতন্ত্রের নমুনা নয়। গণতন্ত্রে বিরোধী দলও সাংবিধানিক মর্যাদা পায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সরকারি ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিরোধী দলের যথাযথ মান রাখে না। পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও তা মেনে চলার মানসিকতা এখানে নেই। পরমত মেনে চলার প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মনীষী ভলতেয়ারের বিখ্যাত উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য : I do not agree with a word you say, but ও রিষষ defend to the death your right to say it.’ অর্থাৎ ‘আমি তোমার একটি কথাও সমর্থন করি না, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করব।’ রাজনৈতিক দলগুলোকে আজ একই কণ্ঠে অঙ্গীকার করতে হবে, তারা আজ যে সমঝোতা ও প্রতিশ্র“তি দেবে তা আগামী দিনেও যথাযথভাবে মেনে চলবে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে পুনরায় দেশে কোনো অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে না। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে হতে হবে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও গণতন্ত্রমনা। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিশ্র“তি দেয় ঠিকই, কিন্তু তা রক্ষায় তাদের সফলতার পরিমাণ খুবই কম। সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও দলতন্ত্র ও ফায়দাতন্ত্রের লাগামহীন চর্চার ফলে তারা যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। সংগঠিত নাগরিক সমাজের অধিকাংশ আজ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অনুগত। ’৯০-এর গণআন্দোলনের সময় একতাবদ্ধ শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও অন্য পেশাজীবীদের অনেকেই তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে এখন দলীয় অঙ্গ কিংবা সহযোগী সংগঠনের খাতায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। ফলে তারা গণতান্ত্রিক শাসনকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে অতন্দ প্রহরীর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
দেশের গণতান্ত্রিক শাসনের ব্যর্থতার মূলে আরও একটি বড় সমস্যা হল- সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকলেও দেশে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান অর্থাৎ এখানে প্রধানমন্ত্রীই সব ক্ষমতার মূলে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কিছুই কার্যকর অর্থে করা সম্ভব নয়। সংসদীয় বিধান মোতাবেক সংসদে সরকারের প্রতি অনাস্থা আনার বিধান থাকলেও সংবিধানে বর্ণিত ৭০ নং অনুচ্ছেদের ফলে তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবিধানিক কিছু পরিবর্তন কিংবা সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। কারণ ক্ষমতার কেন্দ বিন্দু যদি এক ব্যক্তিভিত্তিক হয় তাহলে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার মাত্রার চেয়ে দুর্নীতি কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগই বেশি তৈরি হয়। দেশের সাংবিধানিক ধারা মতে, সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মতের বিরুদ্ধে সংসদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে এমনকি ভোটের সময় সংসদে অনুপস্থিত থাকলে পদ হারানোর ভয়ে সংসদ সদস্যরা নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধির বাইরে চলে যান। এটিই হচ্ছে এ দেশে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার নমুনা। যেখানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।
রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও সমাজ গঠনের কোনো আদর্শভিত্তিক পরিকল্পনা কিংবা বক্তব্য দেয় না। ক্ষমতায় যাওয়াই হল দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য। রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস ও দুর্নীতি এখন রাজনীতির বড় নিয়ামক। এখানে নির্বাচন হয়, কিন্তু কীভাবে হয় সেটা একটু বিশ্লেষণ করলেই এর প্রকৃতি অনুধাবন করা যাবে। যেভাবে একজন বিত্তশালী ব্যক্তি হাট কিংবা বাজার ইজারা নিয়ে থাকে, অনেকটা সেভাবেই দেশের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। একজন বিত্তশালী ব্যক্তি হাট বা বাজার ইজারা নেন এজন্য যে, কয়েক বছর পর সেখান থেকে তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করবেন এবং লাভবান হবেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিটি নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত হয়ে সেই টাকা তুলতে অনেকটাই সচেষ্ট থাকেন। অর্থ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হওয়া বর্তমানে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনে ৪০ লাখ টাকা খরচ করলে নির্বাচিত হওয়ার পর তা কীভাবে দ্বিগুণ করা যায় সেদিকেও খেয়াল রাখেন। কাজেই নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হাট বা বাজার ইজারা নিয়ে ব্যবসা করার শামিলই বটে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য দেশের রাজনীতিকরা অতীতে নানা প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো তারা রক্ষা করতে পারেননি। যেমন ১৯৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখা। ওই রূপরেখার মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নানাবিধ সংস্কারের অঙ্গীকার করেছিল। যেমন- জাতীয় সংসদকে সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ বিন্দুতে পরিণত করা, নির্বাচিত সরকারকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু দেশে বিদ্যমান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই তিন জোটের রূপরেখার প্রতিশ্র“তি রাখতে পারেনি। বিরোধী দলগুলো সংসদের অধিবেশন বর্জন করেছে প্রতিনিয়ত। সংসদকে সমস্যা সমাধানের কেন্দ বিন্দুতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতা এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে পুনরায় ক্ষমতা ধরে রাখার নতুন ফন্দি করতে সচেষ্ট না হয়ে গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্র“তি দিন। আমরা চাই সত্যিকার গণতন্ত্র। এজন্য শুধু নির্বাচন নয় বরং নির্বচন পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সমঝোতা এবং তা মেনে চলার অঙ্গীকার আবশ্যক। যে গণতন্ত্রে স্থিতিশীলতা, একে অপরের প্রতি আস্থা এবং জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর ব্যবস্থা আছে, সেই গণতন্ত্রের প্রতীক্ষায় আছি আমরা সর্বসাধারণ।
সুলতান মাহমুদ রানা : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments