এসো নীপবনে- সত্য-মিথ্যা by আবুল হায়াত
আমি মিথ্যার বেসাতি করি। কথাটা একবচনে শুনতে খুব খারাপ লাগছে কি? তাহলে বহুবচনেই বলা যাক। আমরা মিথ্যার বেসাতি করি। ‘আমরা’ বলতে আমি অভিনয়শিল্পীদের বোঝাচ্ছি।
কথাটা আসলেই সত্যি। ‘অভিনয়’ ব্যাপারটিই মিথ্যাশ্রয়ী। অনেকে বলেন কল্পনাশ্রয়ী। বিষয় তো একই। যা হয়নি, ঘটেনি, হবে না বা ঘটবে না তাকে আমরা সত্যরূপে প্রকাশ করছি নাটকের মাধ্যমে। বিশেষ করে অভিনয় করে। বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যাকে উপস্থাপন করে অভিনয় করছি বা করার চেষ্টা করছি। যিনি যত বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যাকে উপস্থাপন করছেন তিনিই তত ভালো অভিনেতা।
আসলে মিথ্যাটা কী?
সোজা কথায় যাহা সত্য নয়, তাহাই মিথ্যা। অভিধান অনুযায়ী—একটি অসত্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যরূপে উপস্থাপন করাই হচ্ছে মিথ্যা। আরও বিস্তারিত বলা হয়েছে কোথাও কোথাও—ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে বঞ্চিত করার জন্য কিংবা বিভ্রান্ত করার জন্য কোনো অসত্যকে সত্যরূপে উপস্থাপন করাই হচ্ছে মিথ্যা। তাহলে অন্তত এই একটি কারণে অভিনয়শিল্পীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না—‘মিথ্যা’র পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে, তখনই সেটা অপরাধ। সাদা বা সৎ মিথ্যার একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ক্যানসারে আক্রান্ত সন্তানকে বা কোনো আত্মীয়কে যখন তার মৃত্যু সন্নিকট জেনেও কেউ বলছেন, ‘কিছু হয়নি তোমার। ডাক্তার বলে গেলেন, এই তো আর দিন সাতেক পরেই তুমি উঠে চলাফেরা করতে পারবে।’
আসলে আমরা সবাই জন্মগতভাবে অভিনেতা। অর্থাৎ অসত্য বলতে পারাটা মানুষেরই প্রকৃতি। উদ্দেশ্যটাই নির্ধারণ করবে আপনি মিথ্যা বলছেন, না অসত্য বলছেন। এবার তাহলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আমরা অভিনয়শিল্পীগণ অসত্যের বেসাতি করি। মিথ্যার নয়।
মিথ্যা নিয়ে এত টানাহেঁচড়া করছি কেন? নিশ্চয়ই আপনার মনে এ প্রশ্ন জাগছে। জাগাটাই স্বাভাবিক। উত্তরটা দেওয়ার আগে একটা গল্প বলি।
একটি মাইক্রোবাসে দেশের বিখ্যাত সব রাজনীতিবিদ যাচ্ছিলেন এক সম্মেলনে যোগ দিতে। মাইক্রোটি গ্রামের পথে দুর্ঘটনায় পড়ে। প্রত্যেক রাজনীতিবিদ মারা যান। একজন কৃষক খেতে কাজ করছিলেন। তিনি দেখেন এই দুর্ঘটনা। তিনি একাই সবাইকে দাফন করেন।
কদিন পরই ওপর মহল থেকে রাজনীতিবিদদের খোঁজে আসেন মেলা লোকজন, সেপাই-সান্ত্রি। গাড়ির ভগ্নাবশেষ দেখে খুঁজে পান অকুস্থল। কৃষকেরও দেখা পান তাঁরা।
‘সবাই মারা গেছেন?’ কেউ প্রশ্ন করেন।
‘জি সবাই।’ কৃষক বলেন।
‘দেহগুলো কোথায়?’ অন্য কেউ জানতে চান।
‘কবর দিয়ে দিয়েছি।’
‘আপনি নিশ্চিত সবাই মারা গেছেন?’ আরেকজনের প্রশ্ন। ‘মাইক্রোবাসটির যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য বলছিলেন, “আমি মারা যাইনি”। কিন্তু আমরা জানি, রাজনীতিবিদরা সব সময় মিথ্যা কথা বলেন, তাই ভাবলাম তখনো মিথ্যাই বলছেন...।’
এই গল্পটা কিন্তু আমেরিকার, এখানকার নয়। সেখানকার রাজনীতিবিদদের স্বভাবচিত্র নিয়ে নানা চুটকি-গল্প চালু আছে। আরেকটি গল্প বলি তাহলে, আমেরিকারই।
এক মাইক্রোভর্তি রাজনীতিবিদ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। গাড়িটি দুর্ঘটনায় পড়ে সব যাত্রী নিহত হন। পরদিন পত্রিকায় সংবাদ বেরোয়: ‘দেশবাসীর জন্য একটি দুঃসংবাদ এবং একটি সুসংবাদ আছে। সুসংবাদ হচ্ছে এক মাইক্রোবাসভর্তি রাজনীতিবিদ দুর্ঘটনায় পড়ে নিহত হয়েছেন। আর দুঃসংবাদ হচ্ছে—মাইক্রোটিতে দুর্ঘটনার সময় একটি সিট খালি ছিল!’
মিথ্যার কথা বলতে গিয়ে রাজনীতিবিদদের কথা চলে এল, সে জন্য দুঃখিত। কিন্তু আসলেই মিথ্যার সঙ্গে অভিনয়শিল্পীরা যেমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তেমনি রাজনীতিবিদেরাও জড়িত। অন্তত বর্তমান যুগে।
অভিনয়ের শেষ কথা বলে কিছু নেই। মিথ্যাকে নিয়ে আপনি ইচ্ছামতো খেলতে পারেন। নিজের ইচ্ছামতো। আমরা অভিনেতারাও পারি। তবে আমাদের বেলায় এটা ‘অসত্য’। কিন্তু রাজনীতিবিদদের বেলায় কী? ‘অসত্য’ না মিথ্যা?
বিচারটা আপনাদের ওপরই ছেড়ে দিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের উক্তিটা স্মরণ করা যেতে পারে: ‘পৃথিবীর প্রাচীনতম ব্যবসার সবচেয়ে কাছেরটি হচ্ছে রাজনীতি।’
আরেকটা বইতে কিছুদিন আগে দেখলাম একজন হলিউড অভিনেতার উক্তি: মিথ্যা তিন প্রকার—এক, ছোট মিথ্যা। দুই, বড় মিথ্যা। তিন, রাজনীতি।
রাজনীতি শব্দটা এসেছে গ্রিক শব্দ ‘পলিতিকোস’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে নাগরিকসম্পর্কীয়, নাগরিকের জন্য বা নাগরিক-এর। এর সংজ্ঞা এ রকম: পলিতিকোস ইজ দ্য প্র্যাকটিস অ্যান্ড থিওরি অব ইনফ্লুয়েন্সিং আদার পিপল অন আ সিভিক অর ইন্ডিভিজুয়াল লেভেল (নাগরিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অন্য লোকদের প্রভাবিত করার শাস্ত্র ও অনুশীলন)।
আর যা-ই থাক, এর ভেতর ‘অসত্য’ বা মিথ্যার কোনো স্থান নেই। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি আমরা? আমার মতো একজন চরম আশাবাদী মানুষও আজ অতলান্তিক হতাশায় পতিত হয়েছি। বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, মিথ্যা আসলে চার প্রকার: এক, ছোট মিথ্যা। দুই, বড় মিথ্যা। তিন, রাজনীতি। চার, বাংলাদেশের রাজনীতি।
তাহলে ‘সত্যের অবস্থান কী? সত্যের অবস্থান বড় কঠিন, সাংঘাতিক নিষ্ঠুর। আজ বাংলাদেশের মানুষ অসহায়, নিরাপত্তাহীন, রাজনীতিবিদদের জেদের শিকার, এটাই সত্য। নিরপরাধ মানুষ বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে, এটাই সত্য। রাজনীতিবিদেরা লাশের ওপর উৎসব করছেন আর ক্ষমতার লড়াই লড়ছেন, এটাই মহাসত্য। তার চেয়েও বড় সত্য: ‘আপনারা আমাদের বানান নাই। আমরাই আপনাদের বানাইছি।’
জয়তু গীতা সেন, আপনাকে সালাম!
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments