আর যাওয়ার জায়গা নাই by ফরহাদ মজহার
ভারতের
পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঝড়ের মতোই এসেছিলেন, ঝড়ের মতোই গেলেন। পাঁচ
তারিখ খুব সকালে যখন তিনি দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন, তখন থেকেই ভাবছি তার এই
আসার আদৌ নতুন কোনো তাৎপর্য আছে কিনা। দিল্লি ঢাকাকে যেটা জানাতে চেয়েছে
সেটা ভারতীয় পত্রপত্রিকার ও তাদের থিংকট্যাংকগুলোর সুবাদে আমরা আগেই জানি।
সেটা হল শেখ হাসিনার একতরফা নির্বাচনের নীতি সমর্থন। তিনি নেপালের উদাহরণ
দিয়ে বলেছেন, সেখানেও একটি দল নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু
শেষাবধি সেখানে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন বর্জনের পরোয়া না করে শেখ
হাসিনাকে ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই’ নির্বাচন করতে হবে, এটাই উচিত কাজ (দেখুন
প্রথম আলো, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই নির্বাচন হওয়া উচিত’, ৬ ডিসেম্বর ২০১৩)।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দিল্লি সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হোক সেটাই
চায় কিনা, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন। সুজাতা সিং বলেছেন,
‘অধিকাংশের অংশগ্রহণ’ কাম্য। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ
দিয়ে নির্বাচন করা গেলে দিল্লির তাতে বিশেষ আপত্তি থাকার কথা নয়। সুজাতা
সিং ঢাকায় নেমেই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন তিনি
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সালমান খুরশিদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে যা জানার জেনে এসেছেন।
প্রধানমন্ত্রী তাকে বিশেষ বিমানে পাঠিয়েছেন এ কথাই বলতে যে, নির্বাচন করতে
হবে। একতরফা নির্বাচনের কী পরিণতি হতে পারে তার নমুনা আমরা এখন দেখছি।
অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। ঢাকার বাইরে রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ কতটুকু আছে দিল্লির
নীতিনির্ধারকরা সেটা হিসাব ও মূল্যায়ন করেছেন কিনা জানি না। নেপালের
নির্বাচনের অবস্থা আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক নয়। তুলনা অর্থহীন। এরপরও
শেখ হাসিনাকে দিল্লি যখন একতরফা নির্বাচনের পরামর্শ দিচ্ছে, তাতে আমাদের
আশংকাই ঠিক হতে চলেছে। দিল্লি বাংলাদেশে রক্তপাতই চায়। দক্ষিণ এশিয়ায়
শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা দিল্লি নিজের কর্তব্য গণ্য করে না।
খবরের কাগজে যা পড়েছি আর বিভিন্ন সূত্রে যতটুকু জানাজানি তাতে নিশ্চিত যে, ভারতের পররাষ্ট্র সেক্রেটারির ভ্রমণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সত্য ছাড়া নতুন কিছুই যোগ করেনি। তবে বিয়োগের খাতায় যুক্ত হয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। এটা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের জন্য নতুন বাস্তবতা। তিনি সম্ভবত এই আকস্মিকতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এ ঘটনা সুজাতা সিং ও দিল্লির সাউথ ব্লকের মাথাব্যথার বড় কারণ হতে পারে। তিনি দিল্লি ছাড়ার আগে জেনে এসেছিলেন মহাজোটের নতুন সরকারে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আছেন। এটাই স্বাভাবিক। দিল্লি শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় ফের ফিরিয়ে আনতে চায়। এদিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের এখনকার রক্তপাতের জন্য নির্বিচারে শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থনের দায় দিল্লির এড়ানো মুশকিল। শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি ও বিরোধী দলকে নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পেছনে দিল্লির উৎসাহ ও প্রশ্রয় কাজ করেছে।
এরশাদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক বিবেচনায় রাখলে দিল্লির প্রধান মিত্র শেখ হাসিনার সঙ্গেই জাতীয় পার্টির থাকার কথা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে চিড় ধরেছে এমন কোনো খবর আমার জানা নেই। ফলে এরশাদ ‘সর্বদলীয়’ সরকারে থাকবেন না, সেটা সুজাতা সিংয়ের জন্য খুবই বিস্ময়কর খবর। এর জন্য তার প্রস্তুতি থাকার কথা নয়। এরশাদ গত তিন ডিসেম্বর মঙ্গলবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। পরদিন চার তারিখ বুধবার তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকা তার দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগ ও দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। এরশাদ নির্বাচন করবেন না এই হঠাৎ ঘোষণা শুধু শেখ হাসিনার নয়, দিল্লির পরিকল্পনাকেও বেশ নড়বড়ে করে দিয়েছে। সুজাতা সিংয়ের সফরের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র আছে কিনা জানা যায়নি।
তারপরও সবাই বলছেন, ডিগবাজি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নতুন দিচ্ছেন না, এটা তার পরিচিত ক্রীড়া। ফলে এরশাদ আসলে কী চাইছেন এবং কী করবেন সেটা চূড়ান্তভাবে জানার জন্য আমাদের ১৩ তারিখ অবধি অপেক্ষা করতে হবে। সেই দিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। মাঝখানে রয়েছে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফর। আজ ছয় তারিখ শুক্রবার তিনি বাংলাদেশে আসবেন। তার সফর শেষ হবে ১০ তারিখে। নতুন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় কিনা সেটা তখন দেখা যাবে।
নতুনভাবে গঠিত মহাজোট সরকারকেই আওয়ামী লীগ ‘সর্বদলীয়’ দাবি করছে। নৈতিক বৈধতা হারিয়ে ফেলা সরকারকে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। এই বেকায়দা অবস্থায় তথাকথিত ‘সর্বদলীয়’ সরকার থেকে জাতীয় পার্টির বেরিয়ে আসা ক্ষমতাসীনদের জন্য আছাড় খাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এই বিপদ কতটা টের পেয়েছেন আমরা জানি না। তবে তার কাণ্ডজ্ঞান সক্রিয় থাকলে এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় টের পেয়েছেন যে দিল্লির ছক অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজনীতি চলছে না। এরশাদের অবস্থান সাময়িকও যদি হয় এদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। দিল্লির ঘুঁটি তিনি সাময়িক হলেও কিছুটা এলোমেলো করে দিতে পেরেছেন। এর পরিণতি খারাপ দিকে গড়াতে পারে সে ব্যাপারেও এরশাদের হুঁশ আছে। তিনি বুঝেছেন এতবড় অঘটন ঘটিয়ে তার অক্ষত থাকা কঠিন। গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। তাই আÍহত্যার হুমকি দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কাণ্ডজ্ঞানের কথা তুলছি বাধ্য হয়ে। এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় একজন ভারতীয় আমলা হিসেবে সুজাতা সিং যে যুক্তি দিয়েছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় দেখেছি, সেখানে কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানেরই প্রকট অভাব দেখা গেছে। সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের পর এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তাকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান হবে। সেটা তিনি চান কিনা? তিনি উত্তর দিয়েছেন, যদি সেটা ঘটে তবে তার দায় সরকারের। বলেছেন, ‘সরকার সবাইকে শত্র“ বানিয়েছে। দেশের জনমত ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে।’ যদি এই সুবচন শেষ মুহূর্তে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অভিজ্ঞতাসিদ্ধ বিবেচনা বোধ (!) হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে জনরোষ থেকে তিনি কিছুটা নিস্তার পাবেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যদি তিনি তার সুবিধাবাদ পরিত্যাগ করে এই অবস্থানে অনড় থাকেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে দরকষাকষির চালাকি পরিহার করেন, তাহলে তাকে নিয়ে কার্টুনের প্রতিযোগিতাও অনেক কমে আসবে।
ভারতীয় সচিবের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতায় কাকে চায় বা না চায় সেটা বাংলাদেশের ব্যাপার। মনে যাই থাকুক, এ ব্যাপারে কিছু না বলাই কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান। কূটনীতিক হিসেবে সে ব্যাপারে মন্তব্য অনভিপ্রেত। আমি ‘শিষ্টাচার’ বলছি না, কারণ দিল্লির কাছ থেকে সেটা আশা করা বৃথা। তবে দিল্লি যদি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আদৌ প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার পক্ষে নির্বিচারে দাঁড়ানো কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় নয়। বিশেষত দেশের সবাইকে যে সরকার শত্র“তে পরিণত করে ফেলেছে। দিল্লির উচিত এরশাদের মতো ভুল শুধরে বাংলাদেশের জনগণের মন জয় করার চেষ্টা করা। আর সেই শিক্ষাটা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছ থেকে বিনীত চিত্তে গ্রহণ করে সুজাতা সিং দিল্লি ফিরে গেলে তা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক হতো। দিল্লির পররাষ্ট্রনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটানোই বরং কাজ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই, ঠাট্টা মনে হলেও, দিল্লির উপযুক্ত শিক্ষক। আমি মশকারা করে বলছি না, বরং আন্তরিকভাবেই বলছি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীনরা দায়ী- দিল্লির এই উপলব্ধি দরকার।
আর আমাদেরও উচিত ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রী রচনার প্রশ্নকে সব সময়ই নজরের সামনে রাখা; তাদের ন্যায়সঙ্গত উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগকে আন্তরিকভাবে বোঝা ও প্রশমনের চেষ্টা করা। যেন দক্ষিণ এশিয়াকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা শুধু নয়, প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়ে ওঠে। ষোল কোটি মানুষের এই দেশটির নিজের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্যই সেটা জরুরি। জরুরি আমাদের বৈষয়িক সমৃদ্ধির জন্যও। ভারতের আমলাতন্ত্র, শাসকশ্রেণী ও গণমাধ্যমের ভূমিকার কারণে যা কঠিন হয়ে আছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য দিল্লির উচিত প্রতিবেশীদের সঙ্গে দাসমূলক সম্পর্ক নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রীর সম্পর্ক চর্চা। সেই জায়গা থেকেই দরকার অজ্ঞতা, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ, মিথ্যাচার, কুপ্রচার বা ঘৃণা চর্চার মানসিকতা ও সংস্কৃতি থেকে নিজেদের মুক্তির প্রাণপণ প্রয়াস চালানো। উভয় পক্ষের।
অন্য আরেক দিক থেকেও পররাষ্ট্র সচিবের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। ভারত যেখানে তার নিজের দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রশমন করতে পারছে না, সেখানে বাংলাদেশের মৌলবাদ নিয়ে উৎকণ্ঠা একান্তই হিন্দুত্ববাদী উৎকণ্ঠা ও ইসলাম-বিদ্বেষ ছাড়া আর কী হতে পারে? গুজরাটের দাঙ্গায় মুসলমানদের হত্যার জন্য যাকে দায়ী করা হয় ভারতে আজ সেই নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত করার রাজনীতি প্রবল। নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েও যেতে পারেন। যারা তাদের নিজের দেশের মৌলবাদ রুখতে অক্ষম, তারা যখন অন্য দেশে এসে মৌলবাদ ঠেকানোর জন্য শেখ হাসিনাকে সমর্থনের কথা বলেন, তাকে ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে।
এসব ধৃষ্টতা আমাদের সহ্য করতে হবে। একজন ভারতীয় আমলা, যিনি রাজনীতিবিদ নন কিংবা ভারতের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিও নন, তিনি অনায়াসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। অথচ তার রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কথা বলার থাকলে কথা বলার কথা শুধু সচিব পর্যায়ে। পরাশক্তির নির্লজ্জ দালালি করতে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা নিজেদের আত্মসম্মান ও আÍমর্যাদাই শুধু হারান না, দেশের মাথাও লুটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু জনগণ নিজেরা যতদিন তাদের মর্যাদা রক্ষাকে রাজনীতির কর্তব্য বলে গণ্য করবে না ততদিন এ ধরনের ধৃষ্টতা কৌটিল্যপনা ও মোগলাই অহংকার নির্বিশেষে শেয়াল কিংবা সিংহ সবাই আমাদের দেখিয়ে যাবে।
দুই
ব্যক্তি হিসেবে সুজাতা সিং সম্পর্কে আমি আপত্তি করছি না। তিনি সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে যোগদানের পরপরই পররাষ্ট্র বিভাগকে নতুনভাবে সাজাতে চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করছেন কিংবা সরকারি পর্যায়ে যারা নীতিনির্ধারক তাদের এই পরিবর্তনটা বোঝা দরকার। সমুদ্র ভারতের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ- এই উপলব্ধি ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনেক দিন আগে থেকেই আছে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক্ষেত্রে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা আছে। এগুলো নতুন খবর নয়। সমুদ্রকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ভারতের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি ও কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ সমুদ্র ও সমুদ্রের সন্নিহিত দেশ ও অঞ্চল শুধু প্রতিরক্ষা বিভাগের নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের বিষয় ও তৎপরতার এলাকা। সুজাতা সিং পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সমুদ্রকেন্দ্রিক অঞ্চলের দেশগুলো যে বিভাগের অধীনে ছিল সে বিভাগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আগে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও মালদ্বীপ ছিল এই বিভাগের অধীন (ইঝগ ফরারংরড়হ)। সুজাতা সিং দায়িত্ব নেয়ার পর মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে তিনি শুধু দ্বিপাক্ষিক গণ্য করছেন না, তাদের নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করেছেন। ভারত মহাসাগর ঘিরে দিল্লির বৃহৎ ও বিস্তৃত স্বার্থের দিক থেকে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপকে তিনি চিহ্নিত করেছেন। এই দুটো দেশ ভারত মহাসাগরে দিল্লির নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত রাখার খুঁটি। সেই জায়গা থেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন; সেটা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়িয়েও বহুপাক্ষিক আরও বিভিন্ন সম্পর্কের অন্তর্গত হবে। তাদের দেখভাল করবে ভিন্ন একটি বিভাগ। তার অধীনে যাবে সেশেলস, মরিশাস ও মাদাগাস্কার।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়ের দরকার আছে। সেটা দেখবে বাকি বিভাগ। বাংলাদেশ দিল্লির দক্ষিণ এশিয়া নীতির অন্তর্গত। সুজাতা হয়তো ভাবছেন বাংলাদেশ দিল্লির অধীনই থাকবে এবং বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির নীতিও হবে এই বশ্যতা নিশ্চিত করা। গত ৪২ বছর এটা সম্ভব হয়েছে, সেটা এখনও হবে। এরশাদ শেখ হাসিনার হাত থেকে ছুটে গেছেন কিনা আমরা এখনও জানি না। সুজাতা একান্তে এরশাদকে আর কিছু বলেছেন কিনা সেটাও আমাদের জানার উপায় নেই। তবে যারা বলছেন, এরশাদ যদি শেষ অবধি শেখ হাসিনার হাত থেকে ছুটে যায় তাহলে ক্ষমতাসীনদের হাতে জরুরি অবস্থা জারি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না, তারা কিছুটা আগাম কথা বলছেন। অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফরের ফল কী দাঁড়ায়, তার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। ফার্নান্দেজ আসছেন নাভি পিল্লাইয়ের কড়া বক্তব্যের পরে। হানাহানি ও সংঘাত বন্ধ না হলে রাজনীতিবিদ, আমলা ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা হেগে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ফৌজদারি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন- এই সম্ভাবনাও নতুন বাস্তবতা।
এর ফলে পরিস্থিতির কিছু গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। জরুরি অবস্থা জারি করে সরকার চরম হিংসাত্মক নীতি অনুসরণ করলে সেটা বাস্তবসম্মত সমাধান হবে না। ক্ষমতাসীনদের প্রস্থানের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে।
আর যাওয়ার জায়গা নেই- এ দিকটাই শুধু এখন পরিষ্কার।
খবরের কাগজে যা পড়েছি আর বিভিন্ন সূত্রে যতটুকু জানাজানি তাতে নিশ্চিত যে, ভারতের পররাষ্ট্র সেক্রেটারির ভ্রমণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সত্য ছাড়া নতুন কিছুই যোগ করেনি। তবে বিয়োগের খাতায় যুক্ত হয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। এটা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের জন্য নতুন বাস্তবতা। তিনি সম্ভবত এই আকস্মিকতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এ ঘটনা সুজাতা সিং ও দিল্লির সাউথ ব্লকের মাথাব্যথার বড় কারণ হতে পারে। তিনি দিল্লি ছাড়ার আগে জেনে এসেছিলেন মহাজোটের নতুন সরকারে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আছেন। এটাই স্বাভাবিক। দিল্লি শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় ফের ফিরিয়ে আনতে চায়। এদিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের এখনকার রক্তপাতের জন্য নির্বিচারে শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থনের দায় দিল্লির এড়ানো মুশকিল। শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি ও বিরোধী দলকে নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পেছনে দিল্লির উৎসাহ ও প্রশ্রয় কাজ করেছে।
এরশাদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক বিবেচনায় রাখলে দিল্লির প্রধান মিত্র শেখ হাসিনার সঙ্গেই জাতীয় পার্টির থাকার কথা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে চিড় ধরেছে এমন কোনো খবর আমার জানা নেই। ফলে এরশাদ ‘সর্বদলীয়’ সরকারে থাকবেন না, সেটা সুজাতা সিংয়ের জন্য খুবই বিস্ময়কর খবর। এর জন্য তার প্রস্তুতি থাকার কথা নয়। এরশাদ গত তিন ডিসেম্বর মঙ্গলবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। পরদিন চার তারিখ বুধবার তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকা তার দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগ ও দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। এরশাদ নির্বাচন করবেন না এই হঠাৎ ঘোষণা শুধু শেখ হাসিনার নয়, দিল্লির পরিকল্পনাকেও বেশ নড়বড়ে করে দিয়েছে। সুজাতা সিংয়ের সফরের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র আছে কিনা জানা যায়নি।
তারপরও সবাই বলছেন, ডিগবাজি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নতুন দিচ্ছেন না, এটা তার পরিচিত ক্রীড়া। ফলে এরশাদ আসলে কী চাইছেন এবং কী করবেন সেটা চূড়ান্তভাবে জানার জন্য আমাদের ১৩ তারিখ অবধি অপেক্ষা করতে হবে। সেই দিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। মাঝখানে রয়েছে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফর। আজ ছয় তারিখ শুক্রবার তিনি বাংলাদেশে আসবেন। তার সফর শেষ হবে ১০ তারিখে। নতুন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় কিনা সেটা তখন দেখা যাবে।
নতুনভাবে গঠিত মহাজোট সরকারকেই আওয়ামী লীগ ‘সর্বদলীয়’ দাবি করছে। নৈতিক বৈধতা হারিয়ে ফেলা সরকারকে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। এই বেকায়দা অবস্থায় তথাকথিত ‘সর্বদলীয়’ সরকার থেকে জাতীয় পার্টির বেরিয়ে আসা ক্ষমতাসীনদের জন্য আছাড় খাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এই বিপদ কতটা টের পেয়েছেন আমরা জানি না। তবে তার কাণ্ডজ্ঞান সক্রিয় থাকলে এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় টের পেয়েছেন যে দিল্লির ছক অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজনীতি চলছে না। এরশাদের অবস্থান সাময়িকও যদি হয় এদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। দিল্লির ঘুঁটি তিনি সাময়িক হলেও কিছুটা এলোমেলো করে দিতে পেরেছেন। এর পরিণতি খারাপ দিকে গড়াতে পারে সে ব্যাপারেও এরশাদের হুঁশ আছে। তিনি বুঝেছেন এতবড় অঘটন ঘটিয়ে তার অক্ষত থাকা কঠিন। গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। তাই আÍহত্যার হুমকি দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কাণ্ডজ্ঞানের কথা তুলছি বাধ্য হয়ে। এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় একজন ভারতীয় আমলা হিসেবে সুজাতা সিং যে যুক্তি দিয়েছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় দেখেছি, সেখানে কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানেরই প্রকট অভাব দেখা গেছে। সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের পর এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তাকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান হবে। সেটা তিনি চান কিনা? তিনি উত্তর দিয়েছেন, যদি সেটা ঘটে তবে তার দায় সরকারের। বলেছেন, ‘সরকার সবাইকে শত্র“ বানিয়েছে। দেশের জনমত ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে।’ যদি এই সুবচন শেষ মুহূর্তে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অভিজ্ঞতাসিদ্ধ বিবেচনা বোধ (!) হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে জনরোষ থেকে তিনি কিছুটা নিস্তার পাবেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যদি তিনি তার সুবিধাবাদ পরিত্যাগ করে এই অবস্থানে অনড় থাকেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে দরকষাকষির চালাকি পরিহার করেন, তাহলে তাকে নিয়ে কার্টুনের প্রতিযোগিতাও অনেক কমে আসবে।
ভারতীয় সচিবের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতায় কাকে চায় বা না চায় সেটা বাংলাদেশের ব্যাপার। মনে যাই থাকুক, এ ব্যাপারে কিছু না বলাই কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান। কূটনীতিক হিসেবে সে ব্যাপারে মন্তব্য অনভিপ্রেত। আমি ‘শিষ্টাচার’ বলছি না, কারণ দিল্লির কাছ থেকে সেটা আশা করা বৃথা। তবে দিল্লি যদি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আদৌ প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার পক্ষে নির্বিচারে দাঁড়ানো কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় নয়। বিশেষত দেশের সবাইকে যে সরকার শত্র“তে পরিণত করে ফেলেছে। দিল্লির উচিত এরশাদের মতো ভুল শুধরে বাংলাদেশের জনগণের মন জয় করার চেষ্টা করা। আর সেই শিক্ষাটা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছ থেকে বিনীত চিত্তে গ্রহণ করে সুজাতা সিং দিল্লি ফিরে গেলে তা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক হতো। দিল্লির পররাষ্ট্রনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটানোই বরং কাজ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই, ঠাট্টা মনে হলেও, দিল্লির উপযুক্ত শিক্ষক। আমি মশকারা করে বলছি না, বরং আন্তরিকভাবেই বলছি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীনরা দায়ী- দিল্লির এই উপলব্ধি দরকার।
আর আমাদেরও উচিত ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রী রচনার প্রশ্নকে সব সময়ই নজরের সামনে রাখা; তাদের ন্যায়সঙ্গত উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগকে আন্তরিকভাবে বোঝা ও প্রশমনের চেষ্টা করা। যেন দক্ষিণ এশিয়াকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা শুধু নয়, প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়ে ওঠে। ষোল কোটি মানুষের এই দেশটির নিজের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্যই সেটা জরুরি। জরুরি আমাদের বৈষয়িক সমৃদ্ধির জন্যও। ভারতের আমলাতন্ত্র, শাসকশ্রেণী ও গণমাধ্যমের ভূমিকার কারণে যা কঠিন হয়ে আছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য দিল্লির উচিত প্রতিবেশীদের সঙ্গে দাসমূলক সম্পর্ক নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রীর সম্পর্ক চর্চা। সেই জায়গা থেকেই দরকার অজ্ঞতা, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ, মিথ্যাচার, কুপ্রচার বা ঘৃণা চর্চার মানসিকতা ও সংস্কৃতি থেকে নিজেদের মুক্তির প্রাণপণ প্রয়াস চালানো। উভয় পক্ষের।
অন্য আরেক দিক থেকেও পররাষ্ট্র সচিবের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। ভারত যেখানে তার নিজের দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রশমন করতে পারছে না, সেখানে বাংলাদেশের মৌলবাদ নিয়ে উৎকণ্ঠা একান্তই হিন্দুত্ববাদী উৎকণ্ঠা ও ইসলাম-বিদ্বেষ ছাড়া আর কী হতে পারে? গুজরাটের দাঙ্গায় মুসলমানদের হত্যার জন্য যাকে দায়ী করা হয় ভারতে আজ সেই নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত করার রাজনীতি প্রবল। নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েও যেতে পারেন। যারা তাদের নিজের দেশের মৌলবাদ রুখতে অক্ষম, তারা যখন অন্য দেশে এসে মৌলবাদ ঠেকানোর জন্য শেখ হাসিনাকে সমর্থনের কথা বলেন, তাকে ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে।
এসব ধৃষ্টতা আমাদের সহ্য করতে হবে। একজন ভারতীয় আমলা, যিনি রাজনীতিবিদ নন কিংবা ভারতের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিও নন, তিনি অনায়াসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। অথচ তার রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কথা বলার থাকলে কথা বলার কথা শুধু সচিব পর্যায়ে। পরাশক্তির নির্লজ্জ দালালি করতে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা নিজেদের আত্মসম্মান ও আÍমর্যাদাই শুধু হারান না, দেশের মাথাও লুটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু জনগণ নিজেরা যতদিন তাদের মর্যাদা রক্ষাকে রাজনীতির কর্তব্য বলে গণ্য করবে না ততদিন এ ধরনের ধৃষ্টতা কৌটিল্যপনা ও মোগলাই অহংকার নির্বিশেষে শেয়াল কিংবা সিংহ সবাই আমাদের দেখিয়ে যাবে।
দুই
ব্যক্তি হিসেবে সুজাতা সিং সম্পর্কে আমি আপত্তি করছি না। তিনি সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে যোগদানের পরপরই পররাষ্ট্র বিভাগকে নতুনভাবে সাজাতে চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করছেন কিংবা সরকারি পর্যায়ে যারা নীতিনির্ধারক তাদের এই পরিবর্তনটা বোঝা দরকার। সমুদ্র ভারতের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ- এই উপলব্ধি ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনেক দিন আগে থেকেই আছে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক্ষেত্রে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা আছে। এগুলো নতুন খবর নয়। সমুদ্রকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ভারতের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি ও কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ সমুদ্র ও সমুদ্রের সন্নিহিত দেশ ও অঞ্চল শুধু প্রতিরক্ষা বিভাগের নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের বিষয় ও তৎপরতার এলাকা। সুজাতা সিং পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সমুদ্রকেন্দ্রিক অঞ্চলের দেশগুলো যে বিভাগের অধীনে ছিল সে বিভাগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আগে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও মালদ্বীপ ছিল এই বিভাগের অধীন (ইঝগ ফরারংরড়হ)। সুজাতা সিং দায়িত্ব নেয়ার পর মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে তিনি শুধু দ্বিপাক্ষিক গণ্য করছেন না, তাদের নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করেছেন। ভারত মহাসাগর ঘিরে দিল্লির বৃহৎ ও বিস্তৃত স্বার্থের দিক থেকে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপকে তিনি চিহ্নিত করেছেন। এই দুটো দেশ ভারত মহাসাগরে দিল্লির নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত রাখার খুঁটি। সেই জায়গা থেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন; সেটা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়িয়েও বহুপাক্ষিক আরও বিভিন্ন সম্পর্কের অন্তর্গত হবে। তাদের দেখভাল করবে ভিন্ন একটি বিভাগ। তার অধীনে যাবে সেশেলস, মরিশাস ও মাদাগাস্কার।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়ের দরকার আছে। সেটা দেখবে বাকি বিভাগ। বাংলাদেশ দিল্লির দক্ষিণ এশিয়া নীতির অন্তর্গত। সুজাতা হয়তো ভাবছেন বাংলাদেশ দিল্লির অধীনই থাকবে এবং বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির নীতিও হবে এই বশ্যতা নিশ্চিত করা। গত ৪২ বছর এটা সম্ভব হয়েছে, সেটা এখনও হবে। এরশাদ শেখ হাসিনার হাত থেকে ছুটে গেছেন কিনা আমরা এখনও জানি না। সুজাতা একান্তে এরশাদকে আর কিছু বলেছেন কিনা সেটাও আমাদের জানার উপায় নেই। তবে যারা বলছেন, এরশাদ যদি শেষ অবধি শেখ হাসিনার হাত থেকে ছুটে যায় তাহলে ক্ষমতাসীনদের হাতে জরুরি অবস্থা জারি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না, তারা কিছুটা আগাম কথা বলছেন। অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফরের ফল কী দাঁড়ায়, তার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। ফার্নান্দেজ আসছেন নাভি পিল্লাইয়ের কড়া বক্তব্যের পরে। হানাহানি ও সংঘাত বন্ধ না হলে রাজনীতিবিদ, আমলা ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা হেগে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ফৌজদারি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন- এই সম্ভাবনাও নতুন বাস্তবতা।
এর ফলে পরিস্থিতির কিছু গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। জরুরি অবস্থা জারি করে সরকার চরম হিংসাত্মক নীতি অনুসরণ করলে সেটা বাস্তবসম্মত সমাধান হবে না। ক্ষমতাসীনদের প্রস্থানের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে।
আর যাওয়ার জায়গা নেই- এ দিকটাই শুধু এখন পরিষ্কার।
No comments