বিশ্বনায়কের মহাপ্রয়াণ
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা ও প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা অপরিসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে নিজের আসন করে নিয়েছিলেন। একদা স্বদেশের শ্বেতাঙ্গ শাসক এবং আত্মগর্বে গর্বিত পশ্চিমের নেতারা যাঁকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁরাই এই আফ্রিকান নেতাকে বন্ধু, সুহূদ ও পথপ্রদর্শক হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন। গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে তাঁর অবদান যেমন অবিস্মরণীয়, তেমনি তাঁর শূন্য আসনও পূরণ হওয়ার নয়। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্ম নেওয়া নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বৈরশাসককে কেবল উচ্ছেদ করেননি, গণতন্ত্রকেও সুসংহত করেছেন। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অগ্রগতির যে ধারা তিনি সূচনা করে গেছেন, তা অব্যাহত রয়েছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা একাধিকবার কারারুদ্ধ হন; ১৯৬২ সালে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে একটানা ২৭ বছর জেল খাটতে হয়েছে। পাশাপাশি আন্দোলন-সংগ্রামও চলেছে। জেলে থাকতেই নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ক সরকারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সরকার এএনসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে মুক্তি দেয়। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং শান্তি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সাবেক শ্বেতাঙ্গ শাসকের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলেন,
যার অংশ হিসেবে ডি ক্লার্ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত অনন্য। দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বক্তৃতায় দক্ষিণ আফ্রিকার মহানায়ক বলেছিলেন, ‘আমরা শ্বেতাঙ্গ শাসনের পরিবর্তে কৃষ্ণাঙ্গদের শাসন কায়েম করতে চাই না। আমরা এমন শাসন কায়েম করতে চাই, যেখানে সাদা-কালোর মধ্যে ভেদ থাকবে না, সব নাগরিক সমান সুযোগ ভোগ করবে।’ ১৯৯৩ সালে ডি ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। নেলসন ম্যান্ডেলার চরিত্রের সবচেয়ে অনুকরণীয় দিক হলো, ক্ষমতার প্রতি নির্মোহ। পাঁচ বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের পর তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেন। ইচ্ছা করলে আজীবন প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারতেন ম্যান্ডেলা। অবসর জীবনে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানবতা ও শান্তির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। এই মহান নেতার সঙ্গে আমাদেরও এক দুর্লভ আনন্দময় স্মৃতি রয়েছে। ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ডেমিরেলের সঙ্গে তিনিও বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তি, ন্যায়, সমঝোতা ও সমন্বয়ের যে বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তা বর্তমান বাংলাদেশের জন্যও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই মহানায়কের মহাপ্রয়াণে আমরা শোকাভিভূত। তাঁর স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
No comments