নির্বাচনী খেলা এবং উলুখাগড়াদের জীবন by একেএম শাহ নাওয়াজ
আন্দোলনের
সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় দীর্ঘদিনের। ‘আন্দোলন’ শব্দটি সবসময় একটি
ইতিবাচক ধারণা বহন করে। অধিকার বঞ্চিত সমাজ, গোষ্ঠী বা গণমানুষের
স্বার্থরক্ষায় বা মুক্তির জন্য সংগঠিত দাবি আদায়ের প্রেরণা থেকেই আন্দোলনের
ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার রাজনীতির চক্রে পড়ে
আন্দোলন শব্দটির বিকৃত প্রয়োগ চলছে এখন সর্বত্র। স্বার্থবাদী নেতারা
আন্দোলন শব্দের অসৎ ব্যবহার করে অনুসারীদের পথে নামাচ্ছেন। নানা অন্যায়ে
যুক্ত করাচ্ছেন তাদের। নিজেরা নিরাপদে থেকে অনুসারীদের ঠেলে দিচ্ছেন বিপদে।
আর ঘরে তুলে নিচ্ছেন লাভের ফসল। এ ধরনের অমানবিক ও যুক্তিহীন আন্দোলন
করছেন জাতীয় রাজনীতির নেতা-নেত্রীরা। আন্দোলনের নামে শিক্ষাজীবন বিপন্ন
করছে কোনো কোনো শিক্ষক গোষ্ঠী। শিল্প শ্রমিকদের নামানো হচ্ছে পথে। যুক্ত
করানো হচ্ছে ধ্বংসাত্মক কাজে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আমরা সবাই রাজা
আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ আর এর বিকৃত রূপান্তর করে যেন নানা ঘরানার
আন্দোলনকারীরা বলতে চাচ্ছেন ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই আন্দোলনের রাজত্বে।’
রাজতন্ত্রের যুগের রাজাদের মতোই এ আন্দোলনকারী রাজাদের ক্ষমতা অগাধ। কারও
কাছে জবাব দেয়ার দরকার পড়ে না। এভাবে একসময় নির্মম স্বৈরাচারের ভূমিকায়
অবতীর্ণ হন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনের নামে অনাচার করতে আরও বেশি উৎসাহিত
হন, যখন সরকারি কোনো অনুশাসন-শাসন কার্যকর থাকে না। আর এসব অনাচারে
দুর্ভোগ ও ক্ষতি পোহাতে হয় দেশবাসীকে।
বিএনপির ঝগড়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে। এ দুই দল বিভিন্ন সময় সরকার গঠন করেছে। দুই-চারটা ভালো কাজও করেছে। মানুষ বিশ্বাস করে, এ করাটা অনেকটা একান্ত দায়ে পড়ে। দেশ জাতির কল্যাণে লাগে এমন কিছু কাজ অর্থাৎ সরকারি রাজনীতির ভাষায় ‘উন্নয়ন’ না করলে অস্তিত্ব বিপন্ন হবে বলেই কখনও কখনও তেমন সাফল্যের নমুনা পাই। এর বাইরে ক্ষমতাসীনরা গভীর মনোযোগে বাকি কাজগুলো করেন দলীয় ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায়। সাধারণ দেশবাসীকে একপাশে ফেলে দলীয়করণের আবর্তে বন্দি করা হয়। দুর্নীতি প্রতিহত করতে ভূমিকা রাখেনি কোনো ক্ষমতাসীন দল। বরঞ্চ নানা প্রশ্রয়ে দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে। দলগুলোর স্বার্থবাদী আচরণে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে। আমাদের বড় দুই দলই সরকারি দলে থেকে অভিন্ন আচরণ করেছে। বিরোধী দলে থেকেও স্বার্থ রক্ষার সরকারবিরোধী আন্দোলনে একইভাবে দেশ ও মানুষকে বিপদগ্রস্ত করেছে। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের লক্ষ্য পূরণে সচেষ্ট থেকেছে। তাই নির্বাচনের এ প্রস্তুতিলগ্নে নানা বিভ্রান্তি ও ভীতি দেশবাসীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীরা নিজেদের লক্ষ্য পূরণে অবলীলায় হরতাল-অবরোধে বিপন্ন করছে দেশবাসীকে। মানুষের কষ্ট, মানুষের আর্তি তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না। কোনো দ্বিধা না রেখেই একের পর এক সম্পদহানি ও প্রাণঘাতী কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এমন যদি হতো, নতুন চেহারার নতুন প্রত্যয়ের দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মুক্তির জন্য গণধিকৃত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শানিয়েছে, বিশাল আস্থা নিয়ে মানুষ এ দলটিকে সমর্থন দিয়েছে, তাহলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশবাসী কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করত চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। এর মধ্যে থাকত স্বতঃস্ফূর্ততা। কিন্তু চিরচেনা আওয়ামী লীগ আর জামায়াত আশ্রিত বিএনপিকে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার সিঁড়ি পাইয়ে দিতে সাধারণ মানুষ জীবনবাজি রাখবে কেন?
তারপরও আমাদের রাজনীতির সুপারস্টার দলগুলো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে খেয়ালখুশির আন্দোলন চাপিয়ে দিচ্ছেন ভীষণ নির্মমতায়। এ কারণেই বলছিলাম, ঝগড়াটা আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে। একদল আরেক দলকে ঘায়েল করতে যত ইচ্ছা কর্মসূচি দিক আপত্তি নেই, কিন্তু তাই বলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করা কেন? এদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমরা বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলতে পারি, নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আপনারা যত ইচ্ছা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করুন; কিন্তু ককটেল ফাটানো, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, মন্ত্রীদের আক্রমণ করা- এসব কি গণতন্ত্রসম্মত? রাজনীতিতে জনগণকে জিম্মি করার কোনো রীতি কি পৃথিবীর কোথাও আছে? আপনারা কীভাবে নিশ্চিত হলেন, সাধারণ মানুষ আপনাদের সহিংস আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে?
সরকারের নির্বাচনী সিদ্ধান্ত আপনাদের পছন্দ হয়নি বা দাবি পূরণ করেনি সরকার পক্ষ। এ কারণে আপনাদের আদালতে দোষী সরকার আর সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা। আপনাদের তোপানলের আগুনে পুড়বেন তারা। আপনাদের ককটেল আর গান পাউডারের মুখোমুখি হবেন তারা। তার বদলে অস্ত্র ঘুরিয়ে দিচ্ছেন কেন জনগণের দিকে? অবলীলায় দেশবাসীর ওপর লাগাতার হরতাল চাপিয়ে দিচ্ছেন কোন অধিকারে? তাহলে কি কবুল করছেন, এদেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে? আপনাদের দাবি না মানায় আওয়ামী লীগ অনুসারী বলে শাস্তি পেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। রাজনীতির প্রতারণাপূর্ণ ভাষায় এসবকে মানুষের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ হরতাল পালন বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কোটি কোটি কোমলমতি শিশু পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে না স্বতঃস্ফূর্তভাবে! লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের পরিবার কর্মহীন হয়ে পেটে পাথর বেঁধে পড়ে আছে। শত শত অটোরিকশা চালক, ট্রাক-বাসচালক স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেদের পিকেটারদের আগুনের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, অগ্নিদগ্ধ হচ্ছেন! পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জীবনপ্রদীপ নিভে যাচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে! স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ রেখে বাড়িতে বসে আছেন! দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হচ্ছে আর হরতালের এ সাফল্য দেখে সাধারণ মানুষ দারুণ তৃপ্তিতে হাততালি দিচ্ছেন!
একটি প্রশ্নের উত্তর সহিংসতা ছড়ানো হরতাল আহ্বানকারী নেতা-নেত্রী এবং তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী তথা নাগরিক সমাজের মানুষ কখনও দেন না যে, হরতাল তো ডাকা হচ্ছে সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য, যাতে সরকার তাদের দলীয় দাবি মেনে নেয়। যতই ‘জনগণের দাবি’র কথা বলা হোক, বিষয়টি বায়বীয়। এ নিয়ে কোনো জনমত জরিপ বা জনমতের ওপর ভোটাভুটি হয়নি। তাহলে দলীয় দাবি আদায়ের কৌশল হিসেবে সরকারকে বিপর্যস্ত করার জন্য জননেতারা সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলছেন কোন অধিকারে? মানুষের কষ্টের টাকায় কেনা গাড়ি এদেশের সড়ক-মহাসড়কে চালানোর নাগরিক অধিকার রয়েছে। সেগুলো কেন হার্মাদের মতো নির্বিচারে ভেঙে ফেলা হচ্ছে? কেন আগুন দেয়া হচ্ছে? কেন নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে? কেন দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করা হচ্ছে? কেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে? নেতা-নেত্রীরা এতটাই ক্ষমতাবান আর স্বৈরাচারী যে, তারা পরিপাটি পোশাকে ও নধরকান্তি চেহারায় টিভি ক্যামেরা আর সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্নকারী সহিংস হরতালের ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছেন। এসব তাদের কাছে এতটাই সহজ যে, ২২ অক্টোবর বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল জানিয়ে দিলেন, যেদিন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে সেদিন থেকে দেশ অচল করে দেয়া হবে। যেন দেশটি বিএনপি আর আওয়ামী লীগের খেলার পুতুল। তারা নিজেদের ঝগড়া মেটাবেন, ঝগড়ায় জিতবেন কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদকে বাজি রেখে। দেশের ও দেশের মানুষের প্রতি যাদের ন্যূনতম ভালোবাসা নেই, দায়িত্ব নেই, তারা জনগণের রাজনীতি করেন কেমন করে সে এক বিস্ময়। সেদিন এক টিভি মন্তব্যে বিএনপির দিকে কিঞ্চিৎ ঝোঁকা এক আইনজ্ঞ শিক্ষক বলছিলেন, এখন রাজপথে আরও কঠোর আন্দোলন করা ছাড়া বিএনপির অন্য কোনো উপায় নেই। আমি অবাক হলাম, তিনি আন্দোলনের ধরন নিয়ে কোনো কথা বললেন না। এটি মুক্তিযুদ্ধের ডাক নয় যে জীবনপণ করে, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত আরেক পক্ষের জেতা-হারার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা কেন অধিকারের পর্যায়ে পৌঁছে গেল?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদেরও কোনোভাবে কলুষমুক্ত ভাবার কারণ নেই। জনগণের ঘাড়ে বন্দুক রাখতে তারাও কসুর করছেন না। নিজেরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে কোনো ধরনের কসরৎ বাকি রাখেননি। নৈতিকতা ও যুক্তি বলেও কথা থাকে। সংসদের জনপ্রতিনিধিত্বের শক্তিতে যা কিছু করে ফেলার মধ্যে হয়তো আইনগত সমর্থন থাকতে পারে, কিন্তু সবকিছু ন্যায়সম্মতভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এখানেও নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের জন্য জনগণকেই জিম্মি করা হচ্ছে। নিজ নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে অসুস্থ রাজনীতির অগ্নিকুণ্ডে ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিপন্ন করা হচ্ছে দেশের অর্থনীতির। নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি জনগণকে রক্ষা করার দায় বোধ থেকে সমঝোতার পথে হাঁটা যে আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের পবিত্র দায়িত্ব তা তাদের বিবেচনায় আছে বলে মনে হয় না।
এভাবে রাজনীতির সুবিধাবাদী খেলুড়েরা যার যার লক্ষ্য পূরণে খেলতেই থাকবেন আর উলুখাগড়া দেশবাসীর জীবন বিপন্ন হতে থাকবে। কিন্তু এ কথা ভেবে বিস্মিত হতে হয়, আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকরা কেমন করে ভুলে যান দেশ ও রাজনীতির ভিত্তি ও শক্তি এ বিপন্ন উলুখাগড়ারাই? ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়ে তার ওপর যতই সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করুন না কেন, তা ধসে পড়বেই। রাজনীতি করতে হলে শেষ পর্যন্ত উলুখাগড়াদের কাছেই ফিরতে হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিএনপির ঝগড়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে। এ দুই দল বিভিন্ন সময় সরকার গঠন করেছে। দুই-চারটা ভালো কাজও করেছে। মানুষ বিশ্বাস করে, এ করাটা অনেকটা একান্ত দায়ে পড়ে। দেশ জাতির কল্যাণে লাগে এমন কিছু কাজ অর্থাৎ সরকারি রাজনীতির ভাষায় ‘উন্নয়ন’ না করলে অস্তিত্ব বিপন্ন হবে বলেই কখনও কখনও তেমন সাফল্যের নমুনা পাই। এর বাইরে ক্ষমতাসীনরা গভীর মনোযোগে বাকি কাজগুলো করেন দলীয় ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায়। সাধারণ দেশবাসীকে একপাশে ফেলে দলীয়করণের আবর্তে বন্দি করা হয়। দুর্নীতি প্রতিহত করতে ভূমিকা রাখেনি কোনো ক্ষমতাসীন দল। বরঞ্চ নানা প্রশ্রয়ে দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে। দলগুলোর স্বার্থবাদী আচরণে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে। আমাদের বড় দুই দলই সরকারি দলে থেকে অভিন্ন আচরণ করেছে। বিরোধী দলে থেকেও স্বার্থ রক্ষার সরকারবিরোধী আন্দোলনে একইভাবে দেশ ও মানুষকে বিপদগ্রস্ত করেছে। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের লক্ষ্য পূরণে সচেষ্ট থেকেছে। তাই নির্বাচনের এ প্রস্তুতিলগ্নে নানা বিভ্রান্তি ও ভীতি দেশবাসীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীরা নিজেদের লক্ষ্য পূরণে অবলীলায় হরতাল-অবরোধে বিপন্ন করছে দেশবাসীকে। মানুষের কষ্ট, মানুষের আর্তি তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না। কোনো দ্বিধা না রেখেই একের পর এক সম্পদহানি ও প্রাণঘাতী কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এমন যদি হতো, নতুন চেহারার নতুন প্রত্যয়ের দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মুক্তির জন্য গণধিকৃত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শানিয়েছে, বিশাল আস্থা নিয়ে মানুষ এ দলটিকে সমর্থন দিয়েছে, তাহলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশবাসী কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করত চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। এর মধ্যে থাকত স্বতঃস্ফূর্ততা। কিন্তু চিরচেনা আওয়ামী লীগ আর জামায়াত আশ্রিত বিএনপিকে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার সিঁড়ি পাইয়ে দিতে সাধারণ মানুষ জীবনবাজি রাখবে কেন?
তারপরও আমাদের রাজনীতির সুপারস্টার দলগুলো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে খেয়ালখুশির আন্দোলন চাপিয়ে দিচ্ছেন ভীষণ নির্মমতায়। এ কারণেই বলছিলাম, ঝগড়াটা আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে। একদল আরেক দলকে ঘায়েল করতে যত ইচ্ছা কর্মসূচি দিক আপত্তি নেই, কিন্তু তাই বলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করা কেন? এদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমরা বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলতে পারি, নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আপনারা যত ইচ্ছা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করুন; কিন্তু ককটেল ফাটানো, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, মন্ত্রীদের আক্রমণ করা- এসব কি গণতন্ত্রসম্মত? রাজনীতিতে জনগণকে জিম্মি করার কোনো রীতি কি পৃথিবীর কোথাও আছে? আপনারা কীভাবে নিশ্চিত হলেন, সাধারণ মানুষ আপনাদের সহিংস আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে?
সরকারের নির্বাচনী সিদ্ধান্ত আপনাদের পছন্দ হয়নি বা দাবি পূরণ করেনি সরকার পক্ষ। এ কারণে আপনাদের আদালতে দোষী সরকার আর সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা। আপনাদের তোপানলের আগুনে পুড়বেন তারা। আপনাদের ককটেল আর গান পাউডারের মুখোমুখি হবেন তারা। তার বদলে অস্ত্র ঘুরিয়ে দিচ্ছেন কেন জনগণের দিকে? অবলীলায় দেশবাসীর ওপর লাগাতার হরতাল চাপিয়ে দিচ্ছেন কোন অধিকারে? তাহলে কি কবুল করছেন, এদেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে? আপনাদের দাবি না মানায় আওয়ামী লীগ অনুসারী বলে শাস্তি পেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। রাজনীতির প্রতারণাপূর্ণ ভাষায় এসবকে মানুষের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ হরতাল পালন বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কোটি কোটি কোমলমতি শিশু পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে না স্বতঃস্ফূর্তভাবে! লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের পরিবার কর্মহীন হয়ে পেটে পাথর বেঁধে পড়ে আছে। শত শত অটোরিকশা চালক, ট্রাক-বাসচালক স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেদের পিকেটারদের আগুনের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, অগ্নিদগ্ধ হচ্ছেন! পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জীবনপ্রদীপ নিভে যাচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে! স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ রেখে বাড়িতে বসে আছেন! দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হচ্ছে আর হরতালের এ সাফল্য দেখে সাধারণ মানুষ দারুণ তৃপ্তিতে হাততালি দিচ্ছেন!
একটি প্রশ্নের উত্তর সহিংসতা ছড়ানো হরতাল আহ্বানকারী নেতা-নেত্রী এবং তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী তথা নাগরিক সমাজের মানুষ কখনও দেন না যে, হরতাল তো ডাকা হচ্ছে সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য, যাতে সরকার তাদের দলীয় দাবি মেনে নেয়। যতই ‘জনগণের দাবি’র কথা বলা হোক, বিষয়টি বায়বীয়। এ নিয়ে কোনো জনমত জরিপ বা জনমতের ওপর ভোটাভুটি হয়নি। তাহলে দলীয় দাবি আদায়ের কৌশল হিসেবে সরকারকে বিপর্যস্ত করার জন্য জননেতারা সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলছেন কোন অধিকারে? মানুষের কষ্টের টাকায় কেনা গাড়ি এদেশের সড়ক-মহাসড়কে চালানোর নাগরিক অধিকার রয়েছে। সেগুলো কেন হার্মাদের মতো নির্বিচারে ভেঙে ফেলা হচ্ছে? কেন আগুন দেয়া হচ্ছে? কেন নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে? কেন দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করা হচ্ছে? কেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে? নেতা-নেত্রীরা এতটাই ক্ষমতাবান আর স্বৈরাচারী যে, তারা পরিপাটি পোশাকে ও নধরকান্তি চেহারায় টিভি ক্যামেরা আর সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্নকারী সহিংস হরতালের ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছেন। এসব তাদের কাছে এতটাই সহজ যে, ২২ অক্টোবর বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল জানিয়ে দিলেন, যেদিন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে সেদিন থেকে দেশ অচল করে দেয়া হবে। যেন দেশটি বিএনপি আর আওয়ামী লীগের খেলার পুতুল। তারা নিজেদের ঝগড়া মেটাবেন, ঝগড়ায় জিতবেন কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদকে বাজি রেখে। দেশের ও দেশের মানুষের প্রতি যাদের ন্যূনতম ভালোবাসা নেই, দায়িত্ব নেই, তারা জনগণের রাজনীতি করেন কেমন করে সে এক বিস্ময়। সেদিন এক টিভি মন্তব্যে বিএনপির দিকে কিঞ্চিৎ ঝোঁকা এক আইনজ্ঞ শিক্ষক বলছিলেন, এখন রাজপথে আরও কঠোর আন্দোলন করা ছাড়া বিএনপির অন্য কোনো উপায় নেই। আমি অবাক হলাম, তিনি আন্দোলনের ধরন নিয়ে কোনো কথা বললেন না। এটি মুক্তিযুদ্ধের ডাক নয় যে জীবনপণ করে, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত আরেক পক্ষের জেতা-হারার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা কেন অধিকারের পর্যায়ে পৌঁছে গেল?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদেরও কোনোভাবে কলুষমুক্ত ভাবার কারণ নেই। জনগণের ঘাড়ে বন্দুক রাখতে তারাও কসুর করছেন না। নিজেরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে কোনো ধরনের কসরৎ বাকি রাখেননি। নৈতিকতা ও যুক্তি বলেও কথা থাকে। সংসদের জনপ্রতিনিধিত্বের শক্তিতে যা কিছু করে ফেলার মধ্যে হয়তো আইনগত সমর্থন থাকতে পারে, কিন্তু সবকিছু ন্যায়সম্মতভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এখানেও নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের জন্য জনগণকেই জিম্মি করা হচ্ছে। নিজ নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে অসুস্থ রাজনীতির অগ্নিকুণ্ডে ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিপন্ন করা হচ্ছে দেশের অর্থনীতির। নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি জনগণকে রক্ষা করার দায় বোধ থেকে সমঝোতার পথে হাঁটা যে আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের পবিত্র দায়িত্ব তা তাদের বিবেচনায় আছে বলে মনে হয় না।
এভাবে রাজনীতির সুবিধাবাদী খেলুড়েরা যার যার লক্ষ্য পূরণে খেলতেই থাকবেন আর উলুখাগড়া দেশবাসীর জীবন বিপন্ন হতে থাকবে। কিন্তু এ কথা ভেবে বিস্মিত হতে হয়, আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকরা কেমন করে ভুলে যান দেশ ও রাজনীতির ভিত্তি ও শক্তি এ বিপন্ন উলুখাগড়ারাই? ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়ে তার ওপর যতই সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করুন না কেন, তা ধসে পড়বেই। রাজনীতি করতে হলে শেষ পর্যন্ত উলুখাগড়াদের কাছেই ফিরতে হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments