সংলাপের সূচনা (?) ভালোই হয়েছে by ড. মাহবুব উল্লাহ্

অবশেষে দুই প্রধান দলের সাধারণ সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের আলোচনা বৈঠকটি হল। অবশ্য দল দুটির পক্ষ থেকে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে খোলাখুলি কোনো স্বীকারোক্তি আসেনি। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য দুই প্রধান দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে আসছিলেন সুধী সমাজ এবং বিদেশী কূটনীতিকরা। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকা সফর শেষে মহাসচিব পর্যায়ে সংলাপের তাগিদ দিয়ে গেছেন। এর আগে এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকেও অনুরূপভাবে সংলাপের তাগিদ দেয়া হয়েছিল। টেলিভিশন টকশোতে যারা নিয়মিত আলোচনা করেন, তাদের অনেকেই সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপের আগ্রহ ব্যক্ত করে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে চিঠি দেন। সেই চিঠি পাওয়ার স্বীকারোক্তির কথা আমরা জেনেছি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের চিঠি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য জানাবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পর আর কোনো সাড়া মেলেনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এর পর শাসক দল নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করে। এই মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি (এরশাদ), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু) প্রভৃতি দলের ঠাঁই হয়েছে। জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়–য়া নির্বাচনকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এই মন্ত্রিসভাকে শুরুর দিকে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা বলে দাবি করা হলেও পরবর্তী সময়ে এই দাবি থেকে শাসক দল সরে এসেছে। এখন বলা হচ্ছে, এটা হল বহুদলীয় মন্ত্রিসভা। এই মন্ত্রিসভা গঠনের সংবাদ জানতে পেরে বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার টিম নিয়ে সাক্ষাৎপ্রার্থী হন। রাষ্ট্রপতি তাকে সাক্ষাতের জন্য দ্রুততার সঙ্গেই সময় জানিয়ে দেন। সেই বৈঠকে রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা বলে তার পক্ষে কোনো উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দেন। তিনি আরও বলেন, সংলাপের জন্য দুই প্রধান দলকেই উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রপতি বিএনপি চেয়ারপারসনের পেশ করা লিখিত বক্তব্যটি যথাযথ মহলের কাছে পৌঁছে দেয়ারও আশ্বাস দেন। এর পর বেশ কটি দিন কেটে গেছে। সংলাপের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি।
২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের কুশল বিনিময় ঘটে। মিডিয়া সূত্রে জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার কথা বলেন। এ ব্যাপারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু জানাননি। এ সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশকিছু ঘটনা ঘটে যায়। বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন কংগ্রেসের সাব-কমিটিতে একটি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এই শুনানিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাদেশের সংকটের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে এবং সংকট সমাধানকল্পে কোনো সমঝোতা না হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও ইঙ্গিত দেয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ ভারত সরকারকে বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করতে পরামর্শ প্রদান করে। এসব ঘটনার আলোকে বাংলাদেশের একটি ইংরেজি দৈনিক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে বলে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ঢাকায় এক আলোচনা সভায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে দেশ অচল করে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এভাবেই পরিস্থিতির চাপে দুই প্রধান দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে গত শনিবার একটি একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি যে গোপন বৈঠক ছিল তা বলাই বাহুল্য। এই সম্পর্কে ঢাকার একটি দৈনিক নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল শনিবার রাজধানীর বনানীর একটি বাড়িতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গোপনে বৈঠক করেন। সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে সৈয়দ আশরাফ ওই বাড়িতে যান। এর আগে ৬টা ৪০ মিনিটে মির্জা ফখরুল সেখানে পৌঁছেন। বৈঠকে দুই দলের দুই নেতার সঙ্গে দলীয় অন্য কেউ ছিলেন না।
দুই দলের ঘনিষ্ঠ সূত্র বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে রাজি হননি। বৈঠকের পর সৈয়দ আশরাফ ও মির্জা ফখরুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে রাতে মির্জা ফখরুল বৈঠকের কথা অস্বীকার করেন।
সরেজমিন দেখা যায়, মির্জা ফখরুল ইসলাম গতকাল বিকালে মতিঝিলে একটি অনুষ্ঠান শেষ করে বনানীর উদ্দেশে রওনা দেন। বনানী কবরস্থানের পাশে গাড়ি বদল করে তিনি সন্ধ্যায় ওই নির্দিষ্ট বাড়িতে পৌঁছান। বাড়িটি রাস্তার পাশে হলেও মির্জা ফখরুল আশপাশের কয়েকটি গলি ঘুরে ওই বাড়িতে ঢোকেন।
এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে সৈয়দ আশরাফ রাত ৮টা ৭ মিনিটে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। মির্জা ফখরুল বেরিয়ে যান ৮টা ২০ মিনিটে। তারা দু’জন দুই দিক দিয়ে বের হয়ে যান।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এই আলোচনার জন্য সৈয়দ আশরাফ ও মির্জা ফখরুল দুই দলের দুই শীর্ষ নেত্রীর কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওমরাহ হজ পালনের জন্য সৌদি আরব যাওয়ার আগে সৈয়দ আশরাফকে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এর আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দুই দলের সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে আলোচনা শুরুর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ব্যবসায়ীদের ওই প্রতিনিধি দল এর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করেন।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, গতকালের বৈঠকে দুই নেতা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের দাবিগুলো লিখিতভাবে সৈয়দ আশরাফকে দেয়া হয়েছে। তিনি দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। পরে সৈয়দ আশরাফ এসব দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে আবার বৈঠক হবে বলে মির্জা ফখরুলকে জানান।
প্রশ্ন উঠতে পারে বৈঠক নিয়ে এত লুকোচুরি খেলা কেন? অনেকেই বলবেন, স্বচ্ছতার এই যুগে এমন লুকোচুরি সঠিক হয়নি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, একান্ত আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার বিষয়টিকে একটি পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে না পারলে মিডিয়ার ঔৎসুক্য এবং নানা মুনির নানা মন্তব্যের ফলে মূল উদ্যোগটি ভেস্তে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও দুই দেশের মধ্যে বিবদমান বিষয় নিয়ে সংগোপনে আলোচনা এগিয়ে নেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। আলোচনা যখন একটি পর্যায়ে উপনীত হয় তখনই কেবল অন্য মহলকে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
প্রশ্ন হল, দুই নেতার বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীনদের কাছে কী দাবিনামা পেশ করা হয়েছে? যশোরের একটি সাপ্তাহিক ‘দেশকাল’ সূত্রে জানা যায়, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা এবং সমঝোতার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনাকে সরে যেতে হবে। সংসদ ভেঙে দিয়ে এর পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। প্রশাসন এখন যেভাবে ‘সাজানো’ আছে, বিশেষ করে ডিসি, এসপিদের রদবদল করতে হবে। এসব বিষয়ে দুই দল একমত হলে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেবে। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, এসব শর্ত পূরণ হবে বলে তারা মনে করেন না। কারণ তাদের ধারণা, সরকার চাইছে বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করতে। মফস্বলের নতুন এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির রিপোর্ট নির্ভরযোগ্য মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিএনপি নেতারা বহুবার বলেছেন, তারা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের অধীনে নির্বাচন করবেন না। জাতীয় সমঝোতার স্বার্থে বিএনপির এই দাবিগুলো (যদি বিএনপি করে থাকে) যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক এক কেবিনেট মিটিংয়ে বলেছিলেন, তিনি সর্বোচ্চ ছাড় দিতে প্রস্তুত আছেন। পরবর্তীকালে তিনি আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব তার জন্য বড় কোনো ব্যাপার নয়। এ যাত্রা তিনি যদি জাতির স্বার্থে এই উদারতাটুকু প্রদর্শন করতে পারেন, তাহলে জনগণও তাকে অধিকতর শ্রদ্ধা জানাবে। রাজনৈতিক সংঘাত দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। দেশের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল ও শ্রীবৃদ্ধি হোক। এটাই দেশবাসীর কামনা।
ড. মাহবুব উল্লাহ :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর

No comments

Powered by Blogger.