শিক্ষাব্যবস্থা সবার জন্য এক হোক by নুরুল ইসলাম বিএসসি

একটি বই পড়েছিলাম ‘The Governing Principles of Ancient China’। এ বইটিতে ৩৬০ জন বিভিন্ন পণ্ডিত ও মনীষীর কথা আছে। এখানে ভালো ভালো প্রশাসক তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার কথাও বর্ণনা করেছেন। এ বইটিতে লেখা নিয়ম-কানুনগুলো ফলো করে দেশটির প্রশাসন। এ বইয়ের ২১০নং রুলসে বর্ণনা করা হয়েছে ‘The best way to govern people is to pay undivided attention to education’.
একজন শাসকের সর্বোত্তম কাজ হল, মানুষকে অবিভক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। এ কাজটির প্রতি আমি যেমন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি, এই সরকারও যত্ন সহকারে গুরুত্ব দিয়েছে। উন্নয়ন শুধু দালান-ইমারত নয়। উন্নয়নের ১নং শর্ত শিক্ষা। দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশে অবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার বদলে বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এখানে হাত দিলেই মাদ্রাসাগুলো তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
এই শিক্ষার ওপর আমি বিগত ৩০ বছর ধরে কাজ করছি। নিজের অর্থায়নে অসংখ্য স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। এর বাইরেও যেগুলোর দায়িত্ব নিয়েছি, সেখানেও আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছি। কাজেম আলী হাই স্কুল এন্ড কলেজ দেখার আমন্ত্রণ জানাই। এমন একজনকে সভাপতি করা হয়েছে, যার দূরদর্শিতার তুলনা হয় না। আমাকে শতভাগ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে যুগোপযোগী করেছেন।
শিক্ষার বিকল্প নেই। আজ যদি এই বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রাম-গঞ্জে গড়ে তোলা যেত, তাহলে সাঈদীকে চাঁদে দেখা যায় বলে কেউ প্রচারও করত না বা কেউ বিশ্বাসই করত না। শিক্ষিতের মধ্যেও কিছু দুষ্ট শিক্ষিত লোক থেকে যায়। এদের হৃদয়ের দ্বার উন্মোচিত হয়নি, হৃদয়ে শিক্ষার আলো প্রবেশ করেনি। অন্ধকারে বসে এরা জীবন চর্চা করে এবং সমাজের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায়। এরাই নারীদের গৃহবন্দি করে পঞ্চম শ্রেণীর ওপর না পড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে।
শিক্ষা দু’প্রকার। প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাকৃতিক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই। কিন্তু যারা প্রতিষ্ঠানে যায়নি, তাদের মধ্যেও শিক্ষিত লোক আছে। আরজ আলী মাতব্বর কোনোদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাননি। তিনি প্রাকৃতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এমন সব বই রচনা করেছেন, যা পড়লে অবাক হতে হয়। আমাদের নবীও (দঃ) কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাননি। কিন্তু তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষিত ব্যক্তি। প্রকৃতি ও আল্লাহ হজরতকে এমনভাবে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন, যাঁর সমকক্ষ পৃথিবীতে আর নেই।
আজ থেকে ৩৪ বছর আগে আমার মনে হয়েছে, সাধারণ দান-খয়রাত না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারলে এবং ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালাতে পারলে প্রকৃত উন্নয়ন হবে। একজন শিক্ষিত নারী সংসারের চেহারা পাল্টাতে পারে, এজন্যই সর্বপ্রথম বালিকা হাইস্কুল গড়ে তুলি। আস্তে আস্তে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাতির করে শিক্ষক নিয়োগ দিলে, উপযুক্ততার বিচার না করলে ওই প্রতিষ্ঠান প্রসার লাভে সক্ষম হয় না। এদিকে লক্ষ্য রেখে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব প্রতিষ্ঠান নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু গড়লে হয় না, নিয়মিত তদারকও করতে হয়। দৈনন্দিন শিক্ষা কার্যক্রমে, পরীক্ষার খাতায় কোনো রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই চলতে দিতে হবে। প্রশাসনিক কাজেও প্রতিষ্ঠান প্রধানকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। মূল জায়গা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি থাকলে তা প্রশমনের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালকরা নিরপেক্ষ থাকবেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির প্রত্যেক সদস্য নিরপেক্ষ হবেন এবং শুধু প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রসারে, মান নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন। বর্তমান অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে অনেক কাজ করার বাকি। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখনও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে পিছিয়ে। এদিকে খেয়াল রেখে শিক্ষা কার্যক্রম নতুন করে সাজাতে হবে। বিজ্ঞানের যুগে, ইন্টারনেটের যুগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এই আশা রইল।
নুরুল ইসলাম বিএসসি : সংসদ সদস্য ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.