দয়া করে আমজনতার কথা ভাবুন by বেগম জাহান আরা
মার্কিন
কংগ্রেস বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের
নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টও।
বৃহস্পতিবার রাতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনার পর একটি প্রস্তাবনাও পাস
হয়েছে। পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাচন কমিশনকে
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনাসহ নির্বাচনের আগে ও পরে সহনশীলতা প্রদর্শন
এবং শান্ত থাকার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পার্লামেন্ট
সদস্যরা। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশস্থ কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ তো আমরা
দেখছিই। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে উড়ে আসেন শুভাকাক্সক্ষী ও গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তিরা। এই তো ক’দিন আগে ঘুরে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য
এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। টগবগে তারুণ্য
নিয়ে মোড়লি করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন। গণতান্ত্রিক যাত্রা অব্যাহত রাখার
কথা বললেন তিনি। বললেন, বাংলাদেশের অমিত ধনসম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা।
ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক করিডোর থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার আশার কথা।
দেশে ফিরে বলেছেন, বাংলাদেশ সফরকালে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের দলীয় মতবিরোধের
ঊর্ধ্বে ওঠা এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সমাধান খোঁজার আহ্বান
জানিয়েছেন।
লাখ লাখ কথা খরচ হয়েছে এ পর্যন্ত। কিন্তু সমাধানের পথ বের হচ্ছে না। স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টসে একটা আইটেম থাকত দড়ি টানাটানি। খুবই মজার খেলা। দেখতে ভালো লাগত। প্রধানত এ খেলায় দু’পক্ষের কেউ-ই দৌড়-লাফ-ঝাঁপ করতে পারত না। তাদের জন্যই বিনোদন ছিল ওটা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সে রকম একটা দড়ি টানাটানি চলছে মনে হয়। বিরোধী দল চায় তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। আর সরকার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী চান দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক।
গণতন্ত্রে জেদাজেদির কোনো ধারা আছে কি-না জানি না। তবে দলতন্ত্রে তো আছেই। এ দেশে অনেক দল, অনেক পথ। মোক্ষ লাভ একটাই- ক্ষমতা চাই। ক্ষমতার লোভে দল গঠিত হয়। দল ভাঙে। জোট গড়ে ওঠে। জোট ভাঙে। বন্ধু শত্র“ হয়। শত্র“ বন্ধু হয়। দুঃখ যাতনায় ক্লেশে পড়ে থাকে আমজনতা।
রাজনৈতিক নেতাদের যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, কী চেয়েছে আপনাদের কাছে আমজনতা? তারা তো দিয়েই গেছে, দিয়েই যাচ্ছে। কথায় কথায় জনগণের রেশ টেনে কথা বলেন আপনারা। ক’জন মাটিঘেঁষা, পরিশ্রমী, সংগ্রামী, দেশ অনুগত মানুষ দেখেন আপনারা প্রতিদিন? প্রতি মাস? প্রতি বছর? শুধু নির্বাচনের সময় সেই নিরন্ন, দুঃখী, সৎ মানুষগুলোর সামনে কেঁদেকেটে নতজানু হয়ে ভোট চান। প্রতিশ্র“তি দেন নতুন করে। ভঙ্গ প্রতিশ্র“তির জন্য ক্ষমা চান। এই তো দেখা যায়। তবু ওরা তাকিয়ে থাকে আপনাদের সদিচ্ছার দিকে।
দলীয় মতবিরোধজনিত রাজনৈতিক প্রায় অচলাবস্থায় দেশের জনগণ যে কষ্ট পাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা স্বস্তি চায়। শান্তি চায়। সেটুকুও দিতে পারেন না নেতারা। দল তো দেশ নয়। দলের চেয়ে দেশ বড়। মেধায় মননে এদেশের মানুষ যথেষ্ট যোগ্য। তবু দলীয়করণের দাপটে পেছনে পড়ে থাকে প্রকৃত যোগ্য মানুষরা। সামনে আসে অযোগ্য, অদক্ষ, ধামাধরা তেলাপোকারা। ব্যতিক্রম তো আছেই। এই প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ। এ ক্ষতি একদিনের নয়। দীর্ঘদিনের জমাকৃত ক্ষতি।
কেউ কেউ বলছেন, দেশে একদলীয় শাসনের আলামত দেখা যাচ্ছে। যেন একদলীয় সরকার তথা শাসনব্যবস্থা আগে দেখেনি কেউ। যেন ভুলে গেছে সবাই বাকশালের কথা! যুগান্তের আদর্শ এবং রাজনৈতিক পরিচিতি ছুড়ে ফেলে বড় বড় নেতারা বাকশালের স্ট্যাম্প লাগালেন গায়ে। গোল্লায় গিয়েছিল ‘গণতন্ত্র’ চর্চা। কারণ ওই একটাই, ক্ষমতার ভাগ নেয়া। জনগণ তো কচু-ঘেঁচু। তাতেও শান্তি পাননি ক্ষমতালোভীরা। যে মহামানবের মতো মানুষটার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছিল নেতারা, তাদের হাউশ হল এক নম্বর নেতা হওয়ার। তাই-ই হল ১৯৭৫ সালের আগস্টে। পথ নিষ্কণ্টক করার জন্য প্রায় তিন মাস পর আরও চার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা নেতাকে নৃশংসভাবে খুন করা হল বদ্ধ জেলের ভেতর। কেন? ক্ষমতাকে নিরংকুশ করার জন্য। এর মধ্যে সাধারণ মানুষ কোথায়? কে ভাবে তাদের কথা?
সামরিক শাসনের লোকজন হাঁসফাঁস করে গণতন্ত্রের জন্য। কারণ, গণতন্ত্রে সর্বদলীয় কর্মকাণ্ডের সুযোগ থাকে, যা সামরিক শাসন তথা স্বৈরশাসনের কাঠামোতে থাকে না। কিন্তু গণতন্ত্র শব্দটা বলতে যত ভালো লাগে, গণের উদ্দেশে বা জন্য তান্ত্রিক তথা তন্ত্রবিধি মোতাবেক সেটার চর্চা তত ভালো লাগে না নেতাদের। গণতন্ত্রের বুলি আউড়ে আবার ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকার ভোগের লোভ জাগে মনে। শাসনতন্ত্রের দলীয়করণেও মন ভরে না, দলীয়করণ চাই নির্বাচনেও। জনগণ কিছুই বোঝে না এসবের। যেসব চামচা পরিস্থিতি বোঝে, তারা এতই কথা বলে যে কী বলা হল তার হিসাব থাকে না। প্রবীণ এক নেতা মন্ত্রী বললেন, দেশে বিরোধী দলই নেই। তাহলে আর সমস্যা কোথায়? নির্বাচনেরই বা দরকার কী? হয়ে যাক না আবার বাকশাল। সেটা নেহায়েত পারছেন না বলেই তো এত উষ্মা! তবু সামনে পেলে নেতাকে প্রস্তাবটা দিতাম। কিন্তু তারা তো থাকেন বহু দূরে। ধরা যায় না। ছোঁয়া যায় না। সামনে থেকে দেখা যায় না। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলা যায় না। আমরা শুধু তাদের বাণী শুনি।
২২ নভেম্বর দুই মহিলা সংসদ সদস্যের এক আলোচনা অনুষ্ঠান দেখলাম টিভিতে। প্রসঙ্গ ছিল নির্বাচন এবং সঙ্গত কারণেই ‘সংলাপ না সংঘর্ষ?’ দুই দলের দু’জন সদস্য। তাদের নিজেদের এত কথা বলার আছে, নিজ দল সমর্থন এবং অন্য দল কর্তন নিয়ে এত যুক্তি আছে যে, কেউ ধৈর্য ধারণ করতে পারছিলেন না। দু’জনই একসঙ্গে বেশ উচ্চকণ্ঠে কথা বলছিলেন। বেচারা সঞ্চালকের উড়ে যাওয়ার দশা। টিভিতে সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকে। তাই তাদের অবিরত কথার মধ্যেই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। এটা কোনো ব্যাপার নয় আমার জন্য। আমি দেখছিলাম, তারা কেউ সমস্যা উত্তরণের প্রসঙ্গে গঠনমূলক কথা বলেন কি-না। হতাশ হয়েছি। তবে ‘সংলাপ’ শব্দটা শুনেছি কয়েকবার। এই এক বিপদ। ‘সংলাপ’ শব্দটা ক্ষয়ে গেল শুনতে শুনতে। কী নিয়ে সংলাপ, কেন সংলাপ, সেটা তো জানাই আছে।
আশ্চর্য হয়ে যাই অন্য টকশোগুলোর বচন-বাচন দেখেও। কথা বলতে বলতে কেউ লাইনে উঠেও পড়ে যান ইচ্ছে করে। কেন আজ এমন দেয়ালে পিঠ ঠেকার অবস্থা, সেটার সমাধানই বা কী- এ দুটো প্রশ্ন এলেই গলা মিইয়ে যায় অনেকের। কেউ বা বলেনও। কিন্তু কিছুই আসে যায় না তাতে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু কাজ করেছেন, যাকে অসাংবিধানিকও বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ঝড় তোলা প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়ে গেল। বলা হচ্ছে, সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা। আসলে এটা সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা নয় কিছুতেই।
প্রশ্ন হল, বিশ্ব রাজনীতিকরা এই অনার্য অধ্যুষিত বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে উৎকণ্ঠিত কেন? এটা ঠিক যে, বিশ্ব নেতারা আন্তরিকভাবেই চাইছেন বাংলাদেশের শান্তি। চাইছেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা বজায় থাকুক। সাধ্যমতো তারা বোঝাচ্ছেন নেতাদের। শুনছেন না কেউ। এরপর নইলে কী? কেউ জানে না। শুধুই অনুমান যে, সংঘর্ষের ফল ভালো হবে না। হয় না কখনও। সে তো সবাই জানে। বেচারা আমজনতা! কোনো দোষ না করে, কোনো লোভে পা না দিয়ে এবং কোনো দুর্নীতি না করেও মরবে তারাই। এরপরও নেতাদের কি অধিকার থাকে জনগণের দোহাই দিয়ে কোনো কথা বলার? তাদের স্বার্থেই ছাড় দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তো বলেছিলেনই, তিনি শান্তি চান, প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না।
এখনও আশাবাদ মানুষের মনে। হয়তো শেষ মুহূর্তে একটা সমঝোতা হবে, যাতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কেন উল্টো সুরে কথা বলছে? কমিশন জানাচ্ছে, ‘নির্বাচনে আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে থাকবে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও।’ এই যুদ্ধ যুদ্ধ প্রস্তুতির কারণ কী? মরবে তো সেই আমজনতাই। নেতারা যাদের ক্ষমতার উৎসরূপে পরিচয় দেন, তাদের ভয় করার তো কিছু নেই।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া অবশেষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে বর্তমান অচলাবস্থার একটা সমাধানের আবেদন জানিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি তো নিজের ক্ষমতাবলে আইনের ঊর্ধ্বে উঠতেই পারেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আমি সংবিধান লংঘনের কথা বলছি না। আমার বিশ্বাস, সমাজের সুহৃদ বা শীর্ষ নাগরিক হিসেবেও চাইলে একটা পথ হয়তো বের করতে পারতেন তিনি। ড. কামাল হোসেন এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ দেশের অনেক রাজীনিতিকও তাই মনে করেন। কারণ, সবারই শেষ ভরসা রাষ্ট্রের অভিভাবকের ওপর। তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকবেন কী করে? এখনও তাই আশা করে আছি।
অশনি সংকেত তো বেজেই যাচ্ছে। একপেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তারপরও দুন্দুভি দামামা বাজিয়ে রণক্ষেত্র তৈরির প্রস্তুতি চলছে। বিরোধী দলেও সাজ সাজ রবের হুংকার। আগেও বলেছি, আবারও বলছি- প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে একবার শুধু আমজনতার মুখের দিকে তাকান। বাঁচান তাদের সংঘর্ষের ক্ষতি থেকে। কারও কথা শুনতে হবে না আপনাকে। নিজের কথাটাই রাখুন। পারিষদের তোষামোদিতে কান দেবেন না। আপন অন্তর্জাত উপলব্ধির কথাটাই আবার বলুন। ইতিহাস সৃষ্টি করুন বাংলাদেশে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘কথায় ও কর্মে আত্মীয়তা’ অর্জন করুন। দেশের গভীর সংকটে তুলনাহীন মহানুভবতা দেখানোর এটাই শ্রেষ্ঠ সুযোগ।
ড. বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক
লাখ লাখ কথা খরচ হয়েছে এ পর্যন্ত। কিন্তু সমাধানের পথ বের হচ্ছে না। স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টসে একটা আইটেম থাকত দড়ি টানাটানি। খুবই মজার খেলা। দেখতে ভালো লাগত। প্রধানত এ খেলায় দু’পক্ষের কেউ-ই দৌড়-লাফ-ঝাঁপ করতে পারত না। তাদের জন্যই বিনোদন ছিল ওটা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সে রকম একটা দড়ি টানাটানি চলছে মনে হয়। বিরোধী দল চায় তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। আর সরকার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী চান দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক।
গণতন্ত্রে জেদাজেদির কোনো ধারা আছে কি-না জানি না। তবে দলতন্ত্রে তো আছেই। এ দেশে অনেক দল, অনেক পথ। মোক্ষ লাভ একটাই- ক্ষমতা চাই। ক্ষমতার লোভে দল গঠিত হয়। দল ভাঙে। জোট গড়ে ওঠে। জোট ভাঙে। বন্ধু শত্র“ হয়। শত্র“ বন্ধু হয়। দুঃখ যাতনায় ক্লেশে পড়ে থাকে আমজনতা।
রাজনৈতিক নেতাদের যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, কী চেয়েছে আপনাদের কাছে আমজনতা? তারা তো দিয়েই গেছে, দিয়েই যাচ্ছে। কথায় কথায় জনগণের রেশ টেনে কথা বলেন আপনারা। ক’জন মাটিঘেঁষা, পরিশ্রমী, সংগ্রামী, দেশ অনুগত মানুষ দেখেন আপনারা প্রতিদিন? প্রতি মাস? প্রতি বছর? শুধু নির্বাচনের সময় সেই নিরন্ন, দুঃখী, সৎ মানুষগুলোর সামনে কেঁদেকেটে নতজানু হয়ে ভোট চান। প্রতিশ্র“তি দেন নতুন করে। ভঙ্গ প্রতিশ্র“তির জন্য ক্ষমা চান। এই তো দেখা যায়। তবু ওরা তাকিয়ে থাকে আপনাদের সদিচ্ছার দিকে।
দলীয় মতবিরোধজনিত রাজনৈতিক প্রায় অচলাবস্থায় দেশের জনগণ যে কষ্ট পাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা স্বস্তি চায়। শান্তি চায়। সেটুকুও দিতে পারেন না নেতারা। দল তো দেশ নয়। দলের চেয়ে দেশ বড়। মেধায় মননে এদেশের মানুষ যথেষ্ট যোগ্য। তবু দলীয়করণের দাপটে পেছনে পড়ে থাকে প্রকৃত যোগ্য মানুষরা। সামনে আসে অযোগ্য, অদক্ষ, ধামাধরা তেলাপোকারা। ব্যতিক্রম তো আছেই। এই প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ। এ ক্ষতি একদিনের নয়। দীর্ঘদিনের জমাকৃত ক্ষতি।
কেউ কেউ বলছেন, দেশে একদলীয় শাসনের আলামত দেখা যাচ্ছে। যেন একদলীয় সরকার তথা শাসনব্যবস্থা আগে দেখেনি কেউ। যেন ভুলে গেছে সবাই বাকশালের কথা! যুগান্তের আদর্শ এবং রাজনৈতিক পরিচিতি ছুড়ে ফেলে বড় বড় নেতারা বাকশালের স্ট্যাম্প লাগালেন গায়ে। গোল্লায় গিয়েছিল ‘গণতন্ত্র’ চর্চা। কারণ ওই একটাই, ক্ষমতার ভাগ নেয়া। জনগণ তো কচু-ঘেঁচু। তাতেও শান্তি পাননি ক্ষমতালোভীরা। যে মহামানবের মতো মানুষটার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছিল নেতারা, তাদের হাউশ হল এক নম্বর নেতা হওয়ার। তাই-ই হল ১৯৭৫ সালের আগস্টে। পথ নিষ্কণ্টক করার জন্য প্রায় তিন মাস পর আরও চার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা নেতাকে নৃশংসভাবে খুন করা হল বদ্ধ জেলের ভেতর। কেন? ক্ষমতাকে নিরংকুশ করার জন্য। এর মধ্যে সাধারণ মানুষ কোথায়? কে ভাবে তাদের কথা?
সামরিক শাসনের লোকজন হাঁসফাঁস করে গণতন্ত্রের জন্য। কারণ, গণতন্ত্রে সর্বদলীয় কর্মকাণ্ডের সুযোগ থাকে, যা সামরিক শাসন তথা স্বৈরশাসনের কাঠামোতে থাকে না। কিন্তু গণতন্ত্র শব্দটা বলতে যত ভালো লাগে, গণের উদ্দেশে বা জন্য তান্ত্রিক তথা তন্ত্রবিধি মোতাবেক সেটার চর্চা তত ভালো লাগে না নেতাদের। গণতন্ত্রের বুলি আউড়ে আবার ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকার ভোগের লোভ জাগে মনে। শাসনতন্ত্রের দলীয়করণেও মন ভরে না, দলীয়করণ চাই নির্বাচনেও। জনগণ কিছুই বোঝে না এসবের। যেসব চামচা পরিস্থিতি বোঝে, তারা এতই কথা বলে যে কী বলা হল তার হিসাব থাকে না। প্রবীণ এক নেতা মন্ত্রী বললেন, দেশে বিরোধী দলই নেই। তাহলে আর সমস্যা কোথায়? নির্বাচনেরই বা দরকার কী? হয়ে যাক না আবার বাকশাল। সেটা নেহায়েত পারছেন না বলেই তো এত উষ্মা! তবু সামনে পেলে নেতাকে প্রস্তাবটা দিতাম। কিন্তু তারা তো থাকেন বহু দূরে। ধরা যায় না। ছোঁয়া যায় না। সামনে থেকে দেখা যায় না। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলা যায় না। আমরা শুধু তাদের বাণী শুনি।
২২ নভেম্বর দুই মহিলা সংসদ সদস্যের এক আলোচনা অনুষ্ঠান দেখলাম টিভিতে। প্রসঙ্গ ছিল নির্বাচন এবং সঙ্গত কারণেই ‘সংলাপ না সংঘর্ষ?’ দুই দলের দু’জন সদস্য। তাদের নিজেদের এত কথা বলার আছে, নিজ দল সমর্থন এবং অন্য দল কর্তন নিয়ে এত যুক্তি আছে যে, কেউ ধৈর্য ধারণ করতে পারছিলেন না। দু’জনই একসঙ্গে বেশ উচ্চকণ্ঠে কথা বলছিলেন। বেচারা সঞ্চালকের উড়ে যাওয়ার দশা। টিভিতে সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকে। তাই তাদের অবিরত কথার মধ্যেই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। এটা কোনো ব্যাপার নয় আমার জন্য। আমি দেখছিলাম, তারা কেউ সমস্যা উত্তরণের প্রসঙ্গে গঠনমূলক কথা বলেন কি-না। হতাশ হয়েছি। তবে ‘সংলাপ’ শব্দটা শুনেছি কয়েকবার। এই এক বিপদ। ‘সংলাপ’ শব্দটা ক্ষয়ে গেল শুনতে শুনতে। কী নিয়ে সংলাপ, কেন সংলাপ, সেটা তো জানাই আছে।
আশ্চর্য হয়ে যাই অন্য টকশোগুলোর বচন-বাচন দেখেও। কথা বলতে বলতে কেউ লাইনে উঠেও পড়ে যান ইচ্ছে করে। কেন আজ এমন দেয়ালে পিঠ ঠেকার অবস্থা, সেটার সমাধানই বা কী- এ দুটো প্রশ্ন এলেই গলা মিইয়ে যায় অনেকের। কেউ বা বলেনও। কিন্তু কিছুই আসে যায় না তাতে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু কাজ করেছেন, যাকে অসাংবিধানিকও বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ঝড় তোলা প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়ে গেল। বলা হচ্ছে, সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা। আসলে এটা সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা নয় কিছুতেই।
প্রশ্ন হল, বিশ্ব রাজনীতিকরা এই অনার্য অধ্যুষিত বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে উৎকণ্ঠিত কেন? এটা ঠিক যে, বিশ্ব নেতারা আন্তরিকভাবেই চাইছেন বাংলাদেশের শান্তি। চাইছেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা বজায় থাকুক। সাধ্যমতো তারা বোঝাচ্ছেন নেতাদের। শুনছেন না কেউ। এরপর নইলে কী? কেউ জানে না। শুধুই অনুমান যে, সংঘর্ষের ফল ভালো হবে না। হয় না কখনও। সে তো সবাই জানে। বেচারা আমজনতা! কোনো দোষ না করে, কোনো লোভে পা না দিয়ে এবং কোনো দুর্নীতি না করেও মরবে তারাই। এরপরও নেতাদের কি অধিকার থাকে জনগণের দোহাই দিয়ে কোনো কথা বলার? তাদের স্বার্থেই ছাড় দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তো বলেছিলেনই, তিনি শান্তি চান, প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না।
এখনও আশাবাদ মানুষের মনে। হয়তো শেষ মুহূর্তে একটা সমঝোতা হবে, যাতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কেন উল্টো সুরে কথা বলছে? কমিশন জানাচ্ছে, ‘নির্বাচনে আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে থাকবে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও।’ এই যুদ্ধ যুদ্ধ প্রস্তুতির কারণ কী? মরবে তো সেই আমজনতাই। নেতারা যাদের ক্ষমতার উৎসরূপে পরিচয় দেন, তাদের ভয় করার তো কিছু নেই।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া অবশেষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে বর্তমান অচলাবস্থার একটা সমাধানের আবেদন জানিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি তো নিজের ক্ষমতাবলে আইনের ঊর্ধ্বে উঠতেই পারেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আমি সংবিধান লংঘনের কথা বলছি না। আমার বিশ্বাস, সমাজের সুহৃদ বা শীর্ষ নাগরিক হিসেবেও চাইলে একটা পথ হয়তো বের করতে পারতেন তিনি। ড. কামাল হোসেন এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ দেশের অনেক রাজীনিতিকও তাই মনে করেন। কারণ, সবারই শেষ ভরসা রাষ্ট্রের অভিভাবকের ওপর। তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকবেন কী করে? এখনও তাই আশা করে আছি।
অশনি সংকেত তো বেজেই যাচ্ছে। একপেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তারপরও দুন্দুভি দামামা বাজিয়ে রণক্ষেত্র তৈরির প্রস্তুতি চলছে। বিরোধী দলেও সাজ সাজ রবের হুংকার। আগেও বলেছি, আবারও বলছি- প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে একবার শুধু আমজনতার মুখের দিকে তাকান। বাঁচান তাদের সংঘর্ষের ক্ষতি থেকে। কারও কথা শুনতে হবে না আপনাকে। নিজের কথাটাই রাখুন। পারিষদের তোষামোদিতে কান দেবেন না। আপন অন্তর্জাত উপলব্ধির কথাটাই আবার বলুন। ইতিহাস সৃষ্টি করুন বাংলাদেশে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘কথায় ও কর্মে আত্মীয়তা’ অর্জন করুন। দেশের গভীর সংকটে তুলনাহীন মহানুভবতা দেখানোর এটাই শ্রেষ্ঠ সুযোগ।
ড. বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক
No comments