রাজনীতিকরা নিজেদের রক্ষা করতে না পারলে অন্যরা পারবেন না by মইনুল হোসেন
দেশে
বিদ্যমান ভয়াবহ অবস্থার কথা ভেবে সরকারের মধ্যে কিছু জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি
সঙ্গত কারণে উদ্বেগ বোধ করছেন; কিন্তু কিছু লোক আবার এই ভেবে আনন্দ বোধ
করছেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব না হলে তাতে কিছু যায় আসে না।
নির্বাচন না হলে সরকার বদলাবে না এবং তাদের কিছু হারানোরও নেই, কারণ তারাই
ক্ষমতায় থেকে যাবেন। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার প্রক্রিয়ায়
সরকার জটিলতা সৃষ্টি করে বসেছে এ কথা সত্যি। তবে বিষয়টি এমন যে নির্বাচন
অনুষ্ঠান মোটেও সহজ হবে না। আমি তো নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
কারণ সরকার কোনো নির্বাচনী ঝুঁকি নিতে নারাজ। নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জয়
নিশ্চিত করতেই সব কিছু করা হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের
জন্য সরকার শাসনতন্ত্রে পঞ্চদশ সংশোধনী আনেনি। আদতে বহুদলীয় নির্বাচন
অনুষ্ঠান অসম্ভব করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পঞ্চদশ
সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের অবসান ঘটিয়েই শাসনতন্ত্রে জটিলতা
সৃষ্টি করা হয়েছে এ আশায় যে, এই পরিবর্তন সরকারের জন্য নির্বাচনে বিজয়
অর্জন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা বহুদিন
ধরেই চলেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের
ব্যাপারে জনগণকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং নানাভাবে পঞ্চদশ সংশোধনী
থেকেও বিচ্যুৎ হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ সরকারকে শিথিল ও নড়বড়ে করে ফেলেছে।
সংলাপের কথা যতই বলা হোক না কেন, মূল কথা হচ্ছে সরকার নির্বাচনকালীন
নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার ব্যাপারে কোনো সমঝোতা করবে না।
সর্বদলীয় সরকারের ধারণাটি সামনে আনা হয়েছে অন্যদের সরকারে যোগদানে প্রলুব্ধ করতে, যাতে তারা লাভবান হতে পারে। আর রাজনীতি যে এখন বিকিকিনির বিষয় সেটা তো কারও অজানা নয়। রাজনীতিতে নীতি-চরিত্রের সঙ্গতি বজায় রাখার বিষয়টি বর্তমানে গুরুত্ব পাচ্ছে না, যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের জীবন থেকে ওসব গুণাবলী বিদায় নিয়েছে। দেশব্যাপী দুর্নীতি আর অপরাধ করে রক্ষা পাওয়ার বড় ব্যবসার নাম এখন রাজনীতি। তাই রাজনীতির বাইরে এখন কোনো সংগঠিত অপরাধীদের সন্ধান পাওয়া কঠিন।
অন্য দল ভাঙার আশায় এ সংক্রান্ত আইন বদলানো হয়েছে এবং অন্য দলের লোকেরা যাতে সরকারে যোগদান করতে আকৃষ্ট হয় সে রকম একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নতুন কেউ দলে যোগদান করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পথে যে বাধা ছিল, সে বাধা আর এখন নেই। উপরন্তু নিজেদের লোকদের নিয়ে গঠিত স্বীকৃত সরকারকে তারা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন এবং ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে, শাসনতন্ত্র সংশোধন করে এ ধরনের অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণাকে তারা নিরুৎসাহিত করেছেন। এখন সরকার চেষ্টা করছে নির্বাচনের জন্য শাসনতন্ত্রে যে ব্যবস্থা রয়েছে তার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সৃষ্ট বিরোধ থেকে মুক্তি পেতে।
নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু যখন তারা পদত্যাগ করলেন, তখন আবার তাদের পদত্যাগকে পদত্যাগ হিসেবে গ্রহণ না করে শাসনতন্ত্রকে অবজ্ঞা করা হল।
এমনটি হওয়া খুবই সম্ভব যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার কিছু রাজনৈতিক গুরু বলে থাকবেন, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে না এবং দলটি ভেঙে একটি অংশ মন্ত্রী হওয়ার প্রকাশ্য আমন্ত্রণ এবং টেবিলের নিচের অনেক আকর্ষণীয় সুবিধা গ্রহণের লোভ সংবরণ করতে পারবে না। যদি তেমনটি ঘটে তবে সেটা হবে আওয়ামী লীগের জন্য পূর্ণ বিজয় এবং সেক্ষেত্রে বিএনপির উল্লেখযোগ্য অস্তিত্বই থাকবে না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের কিছু সদস্য সরকারে যোগ দিতে পারে এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিশ্বাসের অভাব এত প্রকট যে, দল দুটির মধ্যে আস্থার ভিত্তিতে কোনো সম্পর্ক আশা করা কঠিন। তাই বিএনপি ক্যাম্পে দল ভাঙার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা ভোগে বিভোর ক্ষমতার জুয়াড়িরা বুঝতে অস্বীকার করছেন যে, ঢাকার বাইরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই শিথিল। হত্যা, ধ্বংস, অপহরণের ঘটনাবলী বেড়েই চলেছে। জনগণের দুঃখ-দুর্ভোগের ব্যাপারে কারও আবেদন-নিবেদনের প্রতি কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না। পুলিশের সঙ্গে সংঘাত সমানে চলছে, প্রতিবাদকারীদের পুলিশ ব্যাপক হারে ধরপাকড় করছে এবং এতে সংকট আরও গভীর হচ্ছে। জনআক্রোশের ভীতি এমন একটি উপাদান যাকে সহজভাবে নেয়া ঠিক নয়।
সুতরাং এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন যদি অনুষ্ঠান করা সম্ভব না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত সরকার অস্বস্তিতে ভুগতে যাবে কেন? পরিবর্তিত শাসনতন্ত্রে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনকালে ক্ষমতায় থাকবে এবং নতুন সরকার নির্বাচিত হয়ে না আসা পর্যন্ত তারাই সরকারে থাকবেন। নির্বাচনের সময় সংসদ সদস্যরা এবং মন্ত্রিসভা বহাল তবিয়তে থাকবেন। আওয়ামী লীগের দিক থেকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার এটা একটা নিñিদ্র ব্যবস্থা। কিন্তু যেটা মনে রাখতে হবে তা হল, যে সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়, সেই সরকার ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারেও একইভাবে অক্ষম। বাস্তব সত্য হচ্ছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে না পারলে ক্ষমতায় থাকারও গ্রহণযোগ্যতা না থাকবে জাতীয় পর্যায়ে, না থাকবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নের কোনো সারবত্তা নেই।
আশার লক্ষণ হচ্ছে, এখনও সরকারের মধ্যে দুই-চারজন লোক আছেন যারা ক্ষমতায় থাকার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন টেকসই হবে না।
রূঢ় সত্য হচ্ছে, রাজনীতিকরা যদি নিজেদের সাহায্য করার ব্যাপারে অসহায় থাকেন, তবে অন্য কেউ তাদের সাহায্য করতে পারে না। অন্যরা অবশ্যই এ রকম নাজুক পরিস্থিতিতে জাতিকে সাহায্য করবে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
সর্বদলীয় সরকারের ধারণাটি সামনে আনা হয়েছে অন্যদের সরকারে যোগদানে প্রলুব্ধ করতে, যাতে তারা লাভবান হতে পারে। আর রাজনীতি যে এখন বিকিকিনির বিষয় সেটা তো কারও অজানা নয়। রাজনীতিতে নীতি-চরিত্রের সঙ্গতি বজায় রাখার বিষয়টি বর্তমানে গুরুত্ব পাচ্ছে না, যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের জীবন থেকে ওসব গুণাবলী বিদায় নিয়েছে। দেশব্যাপী দুর্নীতি আর অপরাধ করে রক্ষা পাওয়ার বড় ব্যবসার নাম এখন রাজনীতি। তাই রাজনীতির বাইরে এখন কোনো সংগঠিত অপরাধীদের সন্ধান পাওয়া কঠিন।
অন্য দল ভাঙার আশায় এ সংক্রান্ত আইন বদলানো হয়েছে এবং অন্য দলের লোকেরা যাতে সরকারে যোগদান করতে আকৃষ্ট হয় সে রকম একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নতুন কেউ দলে যোগদান করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পথে যে বাধা ছিল, সে বাধা আর এখন নেই। উপরন্তু নিজেদের লোকদের নিয়ে গঠিত স্বীকৃত সরকারকে তারা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন এবং ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে, শাসনতন্ত্র সংশোধন করে এ ধরনের অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণাকে তারা নিরুৎসাহিত করেছেন। এখন সরকার চেষ্টা করছে নির্বাচনের জন্য শাসনতন্ত্রে যে ব্যবস্থা রয়েছে তার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সৃষ্ট বিরোধ থেকে মুক্তি পেতে।
নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু যখন তারা পদত্যাগ করলেন, তখন আবার তাদের পদত্যাগকে পদত্যাগ হিসেবে গ্রহণ না করে শাসনতন্ত্রকে অবজ্ঞা করা হল।
এমনটি হওয়া খুবই সম্ভব যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার কিছু রাজনৈতিক গুরু বলে থাকবেন, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে না এবং দলটি ভেঙে একটি অংশ মন্ত্রী হওয়ার প্রকাশ্য আমন্ত্রণ এবং টেবিলের নিচের অনেক আকর্ষণীয় সুবিধা গ্রহণের লোভ সংবরণ করতে পারবে না। যদি তেমনটি ঘটে তবে সেটা হবে আওয়ামী লীগের জন্য পূর্ণ বিজয় এবং সেক্ষেত্রে বিএনপির উল্লেখযোগ্য অস্তিত্বই থাকবে না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের কিছু সদস্য সরকারে যোগ দিতে পারে এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিশ্বাসের অভাব এত প্রকট যে, দল দুটির মধ্যে আস্থার ভিত্তিতে কোনো সম্পর্ক আশা করা কঠিন। তাই বিএনপি ক্যাম্পে দল ভাঙার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা ভোগে বিভোর ক্ষমতার জুয়াড়িরা বুঝতে অস্বীকার করছেন যে, ঢাকার বাইরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই শিথিল। হত্যা, ধ্বংস, অপহরণের ঘটনাবলী বেড়েই চলেছে। জনগণের দুঃখ-দুর্ভোগের ব্যাপারে কারও আবেদন-নিবেদনের প্রতি কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না। পুলিশের সঙ্গে সংঘাত সমানে চলছে, প্রতিবাদকারীদের পুলিশ ব্যাপক হারে ধরপাকড় করছে এবং এতে সংকট আরও গভীর হচ্ছে। জনআক্রোশের ভীতি এমন একটি উপাদান যাকে সহজভাবে নেয়া ঠিক নয়।
সুতরাং এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন যদি অনুষ্ঠান করা সম্ভব না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত সরকার অস্বস্তিতে ভুগতে যাবে কেন? পরিবর্তিত শাসনতন্ত্রে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনকালে ক্ষমতায় থাকবে এবং নতুন সরকার নির্বাচিত হয়ে না আসা পর্যন্ত তারাই সরকারে থাকবেন। নির্বাচনের সময় সংসদ সদস্যরা এবং মন্ত্রিসভা বহাল তবিয়তে থাকবেন। আওয়ামী লীগের দিক থেকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার এটা একটা নিñিদ্র ব্যবস্থা। কিন্তু যেটা মনে রাখতে হবে তা হল, যে সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়, সেই সরকার ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারেও একইভাবে অক্ষম। বাস্তব সত্য হচ্ছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে না পারলে ক্ষমতায় থাকারও গ্রহণযোগ্যতা না থাকবে জাতীয় পর্যায়ে, না থাকবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নের কোনো সারবত্তা নেই।
আশার লক্ষণ হচ্ছে, এখনও সরকারের মধ্যে দুই-চারজন লোক আছেন যারা ক্ষমতায় থাকার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন টেকসই হবে না।
রূঢ় সত্য হচ্ছে, রাজনীতিকরা যদি নিজেদের সাহায্য করার ব্যাপারে অসহায় থাকেন, তবে অন্য কেউ তাদের সাহায্য করতে পারে না। অন্যরা অবশ্যই এ রকম নাজুক পরিস্থিতিতে জাতিকে সাহায্য করবে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments