পোল্যান্ড বাংলাদেশের ভালো বন্ধু

ইয়ানুশ জারেস্কির হাতে প্রথম আলোর
উপহার সামগ্রী তুলে দিচ্ছেন লেখক
বাংলাদেশের নদীদূষণ বন্ধ, আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সহজলভ্য করা, সবুজ প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যাপ্ত বিদ্যুতের ব্যবস্থা—এসবই সম্ভব বলে মনে করেন পোল্যান্ডের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ইয়ানুশ জারেস্কি। এ জন্য দরকার একটি মাস্টারপ্ল্যান। এ ব্যাপারে পোল্যান্ড বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পোল্যান্ডের মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
ওয়ারশতে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ-১৯-এর চূড়ান্ত দর-কষাকষির ফাঁকে আমি পূর্বনির্ধারিত এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য সম্মেলন-ভেন্যুতে স্থাপিত পোল্যান্ড সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অস্থায়ী কার্যালয়ে যাই। এই সাক্ষাৎকারের সুযোগ করে দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কাউন্সেলর এভা সিদ্দিকী ওলেশেউক। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মাহবুব সিদ্দিকীর স্ত্রী। বাংলাদেশের জন্য তাঁর অসীম ভালোবাসা। আমার অনুরোধে তিনিই মন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। আমি পোল্যান্ডের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলি, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতালাভের পরপরই যে কটি দেশ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, পোল্যান্ড তাদের অন্যতম। পোল্যান্ড বাংলাদেশের ভালো বন্ধু। নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রশংসা করলে মন্ত্রী বলেন, পোল্যান্ড ফুটবলে বেশি সফল হতে পারেনি, কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে এই সম্মেলন সম্পন্ন করা ছিল আমাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ।
একটি তিনতলা ফুটবল স্টেডিয়ামকে যে এমন সুন্দরভাবে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন-ভেন্যুতে সাময়িকভাবে রূপান্তরিত করা যেতে পারে, তা ভাবলেও অবাক লাগে। মাঠ মাঠের মতোই আছে, তার ওপর কাঠের পাটাতন বানিয়ে সম্মেলনের মূল আলোচনাকক্ষ বানানো হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিসজ্জিত, সারা স্টেডিয়াম এলাকা স্বয়ংক্রিয় ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের আওতায় রাখা, বেতার হেডসেটে প্রতিটি বক্তৃতার বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ সম্প্রচার, লিফট, খাওয়া-দাওয়ার সুব্যবস্থা, যেখানে-সেখানে চা-কফি, কী না আছে সেখানে। সম্মেলনের প্রতিনিধিদের যে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে, তা গলায় ঝুলিয়ে বাস-ট্রাম-রেল-সাবওয়েতে সারা শহর বিনা ভাড়ায় চষে বেড়ানো যায়। এই বিশাল আয়োজনের ব্যয়ভার প্রায় পুরোটাই বহন করেছে পোল্যান্ড। হয়তো কিছু সহযোগিতা দিয়েছে জাতিসংঘ। মন্ত্রী ইয়ানুশ জারেস্কি বলেন, পরিবেশ ও জ্বালানি বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পোল্যান্ডের সহযোগিতার ভালো ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে। তাদের প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব, আধুনিক, উন্নত মানের, কিন্তু সস্তা। সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ, পানি পরিশোধন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিরাট সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। আলোচনার সময় মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ওয়াটার ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান এবং প্রেসিডেন্টের অ্যাডভাইজার মারেক গ্রোমিয়েস। তিনি এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষে মন্ত্রীর হাতে প্রথম আলোর উপহারসামগ্রী তুলে দিলে তিনি ধন্যবাদ জানান।
জলবায়ু সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনটি ছিল বেশ দ্বন্দ্বমুখর। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শফিকুর রহমান পাটোয়ারী বেশ কটি বিষয়ে মতবিরোধ কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে ছিলেন আশাবাদী। এডিপি ২-৩-এর ওপর ২২ নভেম্বর ভোররাত পৌনে ছয়টায় যে খসড়া দলিলটি সবার কাছে দেওয়া হয়, তাতে অধিকাংশ বিষয়ে ঐকমত্যের আভাস পাওয়া গেলেও আলোচনা থেমে থেমে চলেছে রাত পর্যন্ত। অনেকেরই ধারণা সম্মেলনে কিছু বিষয় হয়তো অমীমাংসিত থেকে যাবে। তার পরও অগ্রগতি লক্ষণীয়। বিকেলে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত দুই নারী প্রতিনিধির সঙ্গে আমরা কয়েকজন আলোচনা করছিলাম। ওরা জিজ্ঞেস করল সম্মেলনে সব বিষয়ে ঐকমত্যে আসার পথে বাধা কোথায়? আমি বললাম, বিশ্বের বেশ কটি উন্নত দেশ জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নে রাজি না হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্ল্যানারি সেশনে বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের আলোচনায় অনেকেই বলেছেন, ২০১১ ও ২০১২ সালে ওডিএর পরিমাণ ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু-সুবিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিনিধি হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, আমরা সত্যিই দুঃখিত। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোর সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিরাও চান না যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলন পর্যন্ত একটি রোডম্যাপ তৈরির পথ বাধাগ্রস্ত হোক।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.