অথঃ গাজীপুর সমাচার by ফারুক উদ্দিন অহমেদ

যা হওয়ার তাই হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মরণপণ সংগ্রাম করেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সমর্থিত প্রার্থী গাজীপুর পৌর নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। গাজীপুরের আগে দেশের প্রধান চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। তারও আগে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে একই অবস্থা হয়েছে। চট্টগ্রামে ব্যক্তিগতভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও দলের কারণে পরাজিত হয়েছেন। যেমন হয়েছেন রাজশাহীর লিটন ও বরিশালের হিরন। আর নারায়ণগঞ্জে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং আওয়ামী লীগেরই নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও সরকারি দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি, দিয়েছিল একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে! ফলে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আইভী জয়ী হয়েছেন অর্থাৎ সেখানেও আওয়ামী লীগেরই পরাজয় হয়েছে। সব সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হয়েও এখনও আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের দক্ষতা, সততা ও যোগ্যতার গান গাইছেন। অথচ এসব গুণ না থাকার কারণে তাদের উচিত ছিল আফসোস করা এবং লজ্জায় অবনতশির হওয়া! সব জায়গাতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এত বিশাল পরাজয়ের মুখোমুখি কেন হল- তা না খতিয়ে না দেখে দলের নেতারা ভোটারদের গালমন্দ করছেন এবং বিএনপি নেতাদের চরিত্র এমনকি জন্ম, জন্ম তারিখ ইত্যাদি নিয়ে নানা কথা বলছেন। বিএনপি আগে ভালো কাজ করেনি বলেই তো জনগণ তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি ভোট দিয়ে আওয়ামী জোটকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তারা আশা করেছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ত্যাগী নেতাদের দিয়ে সরকার গঠন করবে, দেশের ও দশের কল্যাণ করবে। কিন্তু দেখা গেল, অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে রেলের কালো বিড়াল (তাও ঘাড় বাঁকিয়ে ব্যঙ্গ করে সারাদিন বকবক করা নির্লজ্জ নেতা!), যমুনা সেতুর দুর্নীতিগ্রস্ত রাঘববোয়াল এবং একগাদা ব্যর্থ বাম নেতা এবং বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও বিকারগ্রস্ত কিছু লোককে দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হল। এমন সব ব্যক্তিকে মন্ত্রী বানানো হল যারা সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকা লুট হওয়ার পরও বললেন, ‘ওটা কিছুই না- রাবিশ।’ সরকারি ব্যাংকগুলোকে ব্যাপক অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রেখেও বললেন, ‘এসব বাংলাদেশ ব্যাংকের দোষ।’ পৃথিবীর কোথাও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নেই- একথা বলে আইএমএফ যখন চাপ দিল, তখন ব্যাংক কোম্পানি আইনে কিছু পরিবর্তন আনলেন। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন বহাল থাকল। ওখানে থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করা হয়। তবে তা সাধারণত যোগ্যতা, সততা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নয়, বরং দলীয় আনুগত্য ও ব্যক্তিগত চাটুকারিতার ভিত্তিতে, যা সবাই জানেন। আর এ কারণে ব্যাংকগুলোর বিশেষত সরকারি ব্যাংকগুলোয় দৈনদশা ও লুটপাট চলছে অবিরাম। কেউ এসব থামানোর কথা বলেন না বা চেষ্টা করেন না। কারণ ওভাবেই যে ওদের লাভ! যা হোক, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সব মন্ত্রণালয়ের যখন এই দশা- তখন জনগণ যাবে কোথায়? দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট, অনাচারের কথা যিনিই বলেন, তার ওপরই খক্ষ নেমে আসে। অথচ এগুলো জানানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কিছুটা হলেও প্রতিকার করা হলে কতই না ভালো হতো! উল্টো দু’-তিনজন মন্ত্রী তো অনেককে দমন করার কথা বলেন, যা অত্যন্ত গর্হিত। এটা অগণতান্ত্রিকতা ও দাম্ভিকতারই বহিঃপ্রকাশ! আর আল্লাহ দাম্ভিকতা ভীষণ অপছন্দ করেন। তার ফলও এখন সবাই পাচ্ছেন।
বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে জনগণ সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, অনাস্থা জ্ঞাপন করেছে। তার মানে এই নয় যে, জনগণ বিএনপি দলীয় জোটকে মনের সুখে ভোট দিয়ে সমর্থন করেছে। এসব নির্বাচনের যে ফলাফল হয়েছে, তা হয়েছে মহাজোট সরকারের ব্যর্থতার জন্য, তাদের দোষে- ১৮ দলীয় জোটের গুণে নয়। বিএনপি জোট বিগত সময় মোটের ওপর কোনো ভালো কাজ করেনি, বরং দু’জন রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়েছিল! ভবিষ্যতে কী করবে, সাধারণ মানুষ জানে না। তবে বর্তমান সরকারও যে দু’-একটা ছাড়া মোটের ওপর কোনো ভালো কাজ করেনি, এটা মানুষ জানে। মানুষ হলমার্ক, শেয়ারবাজার কেলেংকারি, পদ্মা সেতু, বিশ্বজিৎ হত্যা, রানা প্লাজা ধস এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের অতুলনীয় মাস্তানি (এমসি কলেজের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দুটি হোস্টেল জ্বালিয়ে দেয়া, টেন্ডারবাজি এবং সরকারি কর্মচারী মারা, পুলিশকে মারা!) দেখে শংকিত। যেহেতু সরকার তথা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী একটাই- বিএনপি, তাই মানুষ বিএনপি প্রার্থীদের এত বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে সর্বত্র।
আওয়ামী লীগ নেতারা তোতা পাখির মতো গদির মোহে ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তির নিন্দা করেন। ব্যারিস্টার রফিক উল হক এবং ড. কামাল হোসেনের মতো লোকের নিন্দা করেন। কিন্তু তারা বোঝেন না, তাদের কেউই এদের সমতুল্য নয়! তারা বীরউত্তম বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকেও তুলোধুনো করেন। কিন্তু বোঝেন না, দেশের মানুষ এদের চেনে, জানে ও বিরাট মূল্য দেয়। এত সব ভুলের পর ভালো কিছু তারা (মহাজোট নেতারা) আশা করেছিলেন কেন, বোধগম্য নয়। ‘দেশের মানুষ বোঝে না’- এটা বলা ও ভাবা যে কত বড় ভুল, তারা এখনও বুঝে উঠছেন না। যখন বুঝবেন, তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই অর্থহীন কথাবার্তা, আÍম্ভরিতা, পরনিন্দা, দুর্নীতি ও জঘন্য দলীয়করণের মনোভাব ছেড়ে দেশের কল্যাণে কাজ করা উচিত এবং একথা দুটি বড় দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভুল শোধরাতে যত বিলম্ব হয়, খেসারতের পরিমাণ তত বড় হয়- এটা মনে রাখাই বাঞ্ছনীয়।
ফারুকউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.