কেমন আছেন বাবুনগরী by নূরুজ্জামান

বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতেই চিকিৎসাধীন আছেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী। তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন দুই থেকে তিন দিন পর্যবেক্ষণের পর বোর্ড বসে চিকিৎসার পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাবুনগরীর সঙ্গে তার স্বজনরা সাক্ষাৎ করছেন। তিনি অনেকের সঙ্গে কথাও বলেছেন। গতকাল বারডেম হাসপাতালের ৭ম তলায় আইসিইউ কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে হেফাজত নেতা-কর্মীদের ভিড়। কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, হুজুরের চিকিৎসা চলছে ১ নম্বর বেডে। ওই বেডের চারদিকে সাদা রঙের পর্দা ঝুলিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে। ঘনিষ্ঠ স্বজন ছাড়া কারও প্রবেশে নিষেধ রয়েছে। বারডেম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদুল হক মল্লিক জানান, বাবুনগরীর শারীরিক অবস্থা আগের মতোই। বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছাড়াও ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ও কিডনিজনিত সমস্যা রয়েছে তার। কবে নাগাদ সুস্থ হবেন তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে চিকিৎসাধীন বাবুনগরী নিয়মিত নামাজ পড়ছেন ও কথা বলছেন ঘনিষ্ঠ স্বজনদের সঙ্গে। বারডেম হাসপাতালের ৭ম তলার আইসিইউ কমপ্লেক্সের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মী ও চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনরা জানান, চিকিৎসাধীন বাবুনগরীর তিন মামলায় জামিন মিললেও গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। তার সাক্ষাতে কারা আসছেন, কি কথা বলছেন- সবই নজরদারি করা হচ্ছে। হেফাজতের নেতা-কর্মীরা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বাবুনগরীর শারীরিক খোঁজখবর নেয়ার জন্য আইসিইউ’র সামনে ভিড় করছেন। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাবুনগরীর নিকটাত্মীয় মাওলানা আবদুল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। আইসিইউ কমপ্লেক্স সূত্রমতে, বাবুনগরীর সঙ্গে সাধারণ নেতাকর্মীদের সাক্ষাতে বারণ আছে। বিশেষ করে সাংবাদিকের কাছে তথ্য সরবরাহে নিষেধ করা হয়েছে। তবে চিকিৎসার বিষয়ে নির্ধারিত সময়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরীর শরীরের অবস্থা উন্নতির দিকে বলে জানিয়েছে বারডেম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র প্রফেসর ডা. এএসএম আরিফ আহসান গতকাল সন্ধ্যায় মানবজমিনকে বলেন, ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা। হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পাওয়ার পর। এখানে আনার পর তার শরীরে মাত্রাতিরিক্ত ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। চিকিৎসক বোর্ড পায়ের ক্ষতে ইনফেকশন দেখলে তা অপসারণে ছোট একটি সফল অপারেশন করেন। পরে তার কিডনি নিয়মিত কাজ না করলে ডায়ালাইসিস সাপোর্ট দেয়া হয়। এখন তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তবে এর মানে তার শরীরের অবস্থা জটিল নয়। তিনি বলেন, ৫ সদস্যের চিকিৎসক দল তাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন। এখন আগে থেকে পায়ের অবস্থা অনেক ভাল। ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে আসছে। ২-৩ দিনের মধ্যে আবার চিকিৎসক বোর্ড বসে স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
বাবুনগরীর মেয়ের জামাই মাওলানা ইমামনগরী বলেন, চিকিৎসকদের তথ্য অনুযায়ী তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। তবে এখনও  তার শারীরিক অবস্থা ভাল হয়নি। বাবুনগরীর পাশে থাকা অন্য রোগীর স্বজনদের কেউ কেউ তার সঙ্গে কথা বলে দোয়া নিচ্ছেন বলে তারা জানিয়েছেন।
ব্রেন স্ট্রোক করে বাবুনগরীর পাশের বেডে ভর্তি হয়েছেন মুন্সীগঞ্জ জেলার আবদুল কাদের জিলানী। গতকাল বিকালে জিলানীর মেয়ে তার পিতাকে দেখতে আইসিইউতে  প্রবেশ করেন। পরে বের হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাবার অবস্থা ভাল নয়। তার রোগমুক্তির জন্য বাবুনগরী হুজুরের কাছে গিয়েছিলাম। সালাম দিয়ে বাবার জন্য দোয়া চেয়েছি। তিনি দোয়া করেছেন।  বাবুনগরীর পাশে ৮ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন পুলিশের এস আই সৈয়দ মোশারফ হোসেন। তার ছেলে পুলিশের কনস্টেবল সোহেল নিজের পিতাকে দেখতে গিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বাবুনগরীর কুশলাদি জানতে চেয়েছেন। বলেন, হুজুরকে সালাম দিলে তিনি হাসিমুখেই উত্তর নিয়েছেন।
আইসিইউ সূত্রমতে, এক নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন বাবুনগরী। তার বেডের চারদিকে সাদা পর্দা ঝুলিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। যাতে অন্যান্য রোগী ও তাদের স্বজনরা দেখতে না পারেন। তবে আইসিইউতে থাকা রোগীর স্বজনরা চাইলে বাবুনগরীর কাছে যেতে পারেন। গতকাল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুছ আহমাদ, রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন্দ ও সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা ইমতিয়াজ আলী দেখা করতে যান। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় দেখা না করেই ফিরে যান।

দ্রুত জামিন দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, সরকার জুনাইদ বাবুনগরীর জনপ্রিয়তায় ভীত। তাই তাকে কারাগারে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। পরে তার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটায় তড়িগড়ি করে তাকে জামিন দিয়ে দায় এড়াবার চেষ্টা করেছে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রিমান্ড নিয়ে এমনই কথা বলেছেন দলটির চট্টগ্রামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। গতকাল সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে সরকারের সমালোচনার কথা তুলে ধরেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, দেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, বরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক, মুফাস্‌সিরে কুরআন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী রিমান্ডে নির্যাতনের কারণে বর্তমান জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছেন। তিনি বর্তমানে মুমূর্ষু অবস্থায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটায় তড়িগড়ি করে তাকে জামিন দিয়ে সরকার দায় এড়াবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ দেশের আলিম-ওলামা, তৌহিদি জনতা জুনাইদ বাবুনগরীর সঙ্কটাপন্ন অবস্থা মেনে নিতে পারেননি। একজন নিরপরাধ বুজুর্গ আলেমের ওপর এরকম অমানুষিক নির্যাতন মানবতা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
সারা দেশের কওমি মাদরাসার আলিম-ওলামা ও ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের তৌহিদি জনতা এ ঘটনায় প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ। তাদের জিজ্ঞাসা, যে দেশে রিমান্ডের নামে এমন বর্বর নির্যাতন চালানো হয় সে দেশকে গণতান্ত্রিক ও সভ্য রাষ্ট্র বলা যায় কি করে? এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। মানুষ আইনের শাসন ও  বিচার ব্যবস্থার ওপর ক্রমশ আস্থা হারাতে বসেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর দ্রুত আরোগ্য কামনায় দেশ-বিদেশে দোয়া ও বিশেষ মুনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। পবিত্র মক্কা-মদিনায় তার সুস্থতা কামনায় সৌদি আরব প্রবাসী হাজার হাজার ওলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতা পবিত্র ওমরাহ পালন, তাওয়াফে যিয়ারত, নফল রোজা পালন এবং মহান আল্লাহর দরবারে বিশেষ  দোয়া ও মুনাজাত করেছেন।
পবিত্র মদিনা শরীফেও অনুরূপ দোয়া ও বিশেষ মুনাজাতে প্রবাসী বাংলাদেশী ওলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও লন্ডন, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান-জার্মানি, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী ওলামা ও তৌহিদি জনতা তার সুস্থতার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছেন।
বিশেষ করে, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ, পাকিস্তানের দারুল উলূম করাচি, জামিয়া আশরাফিয়া লাহোর, আল-আযহার ইউনিভার্সিটি মিসর, কাতারের ড. ইউসুফ আল-কারযাভীও আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর ওপর নির্মম নির্যাতনে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিশেষভাবে মহান আল্লাহর দরবারে তার আরোগ্য কামনায় দোয়া করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী একজন মাদরাসা শিক্ষক হয়ে দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়তা ও সাধারণ মুসলমানদের ব্যাপক ভালবাসা অর্জন করেছেন। তিনি একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও শীর্ষ আলেম। মাতা-পিতার বংশধারার দিক থেকেও একজন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও বুজুর্গ পরিবারের সন্তান।
তার পিতা উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস এবং বিশিষ্ট হাদিসগ্রন্থ মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ তানযীমুল আশতাতের খ্যাতিমান লেখক- যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাদিসশাস্ত্রের পাঠ্য। তার নানা উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ আল্লামা হারুন বাবুনগরী (রহ.)- যিনি জামিয়া আজিজুল উলূম বাবুনগর মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা।
আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী, একজন নিরহঙ্কারী, সদালাপী, মিষ্টভাষী, সরল ও অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী জনপ্রিয় শিক্ষক। তিনি একজন ভাল বক্তা। পার্থিব সম্পদের কোন মোহ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে অনাড়ম্বর চলাফেরায় অভ্যস্ত।
অত্যন্ত সাদাসিধা জীবনযাপনকারী জুনাইদ বাবুনগরীর নিজের কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। দীনের পথের একজন নিবেদিতপ্রাণ ও নির্ভীক সৈনিক হিসেবে প্রিয় নবী (সা.) অবমাননাকারীদের শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সারা দেশের সভা-সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার ওপর এই নির্মম নির্যাতনের অন্যতম কারণ আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।
বিবৃতিতে বলা হয়, ৫ই মে অবরোধে যাওয়ার আগে তিনি সহকর্মীদের বলেছেন, বয়োবৃদ্ধ মা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছেন। মহান আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর শানে অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে আল্লাহ যেন আমাকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন।
সেই কারণে তিনি ৫ই মে দিবাগত রাতে যৌথবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা চলাকালেও অকুতোভয় সিপাহসালারের মতো অবিচল দৃঢ়তায় মঞ্চে অবস্থান করেছেন, নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.