বিষয় পুরনো by সাজেদুল হক

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিই তিনি ব্যতিক্রম। সমালোচিত-আলোচিত। তার বই নিয়েও বিতর্ক নতুন কিছু নয়। ‘এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ নামের বইটি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে আবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে এই যা নতুন।
হাইকোর্টের একটি রায়ে এ বইয়ের উদ্ধৃতি ব্যবহারের পরই এত আলোচনা-সমালোচনা। এ রায়ের লেখক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এর কিছুদিন আগে পরিকল্পনা মন্ত্রী একে খন্দকারের সাক্ষাৎকারভিত্তিক গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ও বিপুল আলোচনার ঝড় তুলেছিল। যে গ্রন্থে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার গুরুত্বের বর্ণনা করেছেন ক্ষমতাসীন দলের এ নেতা। সারা দুনিয়ায় রাজনীতিবিদদের লেখা বই নিয়ে বিতর্ক হয়েছে অনেক। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের লেখালেখির অভ্যাস একেবারেই কম। রাজনীতিবিদদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও নগণ্য। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ এক্ষেত্রে একেবারেই আলাদা। এক ডজনেরও বেশি বই লিখেছেন তিনি। এর বেশির ভাগই গুরুত্বপূর্ণ। একটি লং ড্রাইভ নিয়ে তার লেখা বই প্রথম বিপুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ২০০৯ সালে স্বাধীনতার ঘোষক মামলায় তার দু’টি গ্রন্থের উদ্ধৃতি নিয়েও অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের  (পরে প্রধান বিচারপতি) লেখা ওই রায়ে মওদুদ আহমদের দু’টি বই থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়। বিচারপতি হক তার রায়ে লিখেছেন, ‘বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও লেখক জনাব মওদুদ আহমদ তাহার শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল (১৯৮৩) পুস্তকে ১০-০১-১৯৭২ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে বর্ণনা করিতে গিয়া বলেন, একজন মডারেট পলিটিশিয়ান এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাট হিসেবে পরিচিত শেখ মুজিব মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে সংগ্রাম করেছেন, বছরের পর বছর সহ্য করেছেন অবর্ণনীয় নির্যাতন। অসংখ্যবার এবং সংখ্যাতীত কারণে শেখ মুজিবকে কারাবরণ করতে হয়েছে এবং জীবনের সৃষ্টিশীল সময়গুলোর বিশালতম অংশ তিনি কাটিয়েছেন কারাভ্যন্তরে। জনগণের একজন নন্দিত নেতা হিসেবে তিনি চষে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। যে চেহারা একবার দেখেছেন সে চেহারা সারাজীবনে তিনি ভোলেননি এবং তীক্ষ্নধী স্মৃতিশক্তিবলে শেখ মুজিব তার শত সহস্র কর্মীর নাম মনে রাখতে পারতেন। এতদিনকার বিক্ষুব্ধ, জনপ্রিয় নেতা এবং প্রায় সারাজীবন বিরোধী রাজনীতির মহানায়ক শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি এবং জাতির পিতা হিসেবে তার স্বজনঅধ্যুষিত নিজ বাসভূমে প্রত্যাবর্তন করেন।’ রায়ের আরেক জায়গায় বলা হয়, মওদুদ আহমদ তার ‘ইধহমষধফবংয: পড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ য়ঁবংঃ ভড়ৎ অঁঃড়হড়সু্থ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে লিখেছেন, খধঃবৎ রহ ঃযব বাবহরহম ড়ভ ঃযব ংধসব ফধু ও সবঃ যরস ধঃ যরং যড়ঁংব. ডযবহ ও বহঃবৎবফ রহঃড় যরং ৎড়ড়স যব ঃড়ষফ সব, ও যধাব ফড়হব সু ফঁঃু, হড় িুড়ঁ ফড় ুড়ঁৎং. ঐব সবধহঃ যব যধফ মরাবহ ঃযব পধষষ ভড়ৎ রহফবঢ়বহফবহপব ধষংড় ধহফ ঃযবৎব ধিং হড়ঃযরহম সড়ৎব যব পড়ঁষফ ফড়্থ। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবশ্য তখন দাবি করেছিলেন, তিনি কখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করেননি। সর্বশেষ কর্নেল তাহেরের সামরিক আদালতে বিচার প্রশ্নে হাইকোর্টের দেয়া রায়েও মওদুদ আহমদের বই থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী তার রায়ে লিখেছেন, কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড আদতে হত্যাকাণ্ড। জেনারেল জিয়াউর রহমান ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে মনস্থির করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদের ‘এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। এ রায় প্রকাশের পর মওদুদ আহমদ ব্যাখ্যায় জানান, তিনি তার বইতে লিখেছেন, কর্নেল তাহেরের বিচারের বিষয়ে আমার বইয়ে লেখা প্রাসঙ্গিক অংশ ছিল নিম্নরূপ: ‘...কর্নেল তাহেরকে সাজা দেয়ার প্রশ্নে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা সব সময় তার মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন। এব্যাপারে জিয়া ৪৬ জন সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করেন। সকলে এক বাক্যে তাহেরের জন্য চূড়ান্ত শাস্তির পক্ষে মতামত দেন।’
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর গ্রন্থ নিয়েও বিতর্ক হয়েছে অনেক। এ গ্রন্থে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকারের বক্তব্য সরকারি দলে ব্যাপক আলোচনার ঝড় তোলে। এতে তিনি লিখেছেন, রাজনৈতিক নির্দেশ ছাড়াই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, মেজর জিয়ার ঘোষণা পড়ার পর মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করলো, হ্যাঁ এইবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামলো। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বাপর ঘটনাবলী নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন একে খন্দকার। একে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মির্জার কথোপকথন নিয়ে প্রকাশিত হয় এ বই। স্বাধীনতার ঘোষণা বর্ণনার এক পর্যায়ে একে খন্দকার বলেন, কেউ চট্টগ্রামে এ-সংক্রান্ত সংবাদ পাঠিয়েছিল বা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পাঠিয়েছিল, এমন কোন সংবাদ সে সময় আমরা শুনিনি। এ সম্পর্কে কথা শুরু হয় স্বাধীনতার পর। এখানে একটি কথা বলবো, এই যে ২৭ তারিখে মেজর জিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম  বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী, এরাই কিন্তু এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ সত্যগুলো আমাদের মনে রাখতেই হবে, অর্থাৎ যা ঘটেছে। এরাই নিজ উদ্যোগে মেজর জিয়ার কাছে গিয়েছিলেন, মেজর জিয়া তাদের কাছে যাননি। তবে এটা ঠিক, জিয়া তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ  নেননি। একে খন্দকারের ভাষায় ২৬শে মার্চ দুপুরে স্বাধীনতার ঘোষণা এম এ হান্নান সাহেব যেটা পড়েছিলেন এবং ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে মেজর জিয়া  যেটা পড়েন এর মধ্যে কিন্তু একটা পার্থক্য ছিল। ২৬শে মার্চেরটা অনেকে হয়তো শুনতে পাননি। কারণ সেদিন  তো সবাই বিভিন্ন কারণে উদ্বিগ্ন-হতবিহ্বল ছিলেন। কিন্তু হান্নান সাহেবের কথারও একটা মূল্য ছিল, যদিও তিনি বেসামরিক লোক ছিলেন। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের কথা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও জানি যে মেজর জিয়ার এ  ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারা দেশের  ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে, হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামলো। দুই  ঘোষণার ব্যাপারে তফাৎটা শুধু এখানেই ছিল। একে খন্দকার তার আলোচনার আরেক জায়গায় স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বলেছেন, ’৭১ সালের ২৫শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা হলো কিনা, কে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু এর জন্য অপেক্ষা করছিল না। ২৫শে মার্চ রাতে আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। কোন  ঘোষণা, কারও আবেদন বা কারও নির্দেশের জন্য বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছিল না। যে মুহূর্তে তারা আক্রান্ত হয়, সে মুহূর্তে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য ও পুলিশ তো বটেই, সাধারণ মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। সুতরাং কে  ঘোষণা দিলো, কখন দিলো- তা নিয়ে  যে বিভ্রান্তি, সেই বিভ্রান্তির অবসান হওয়া উচিত। কারণ মানুষ কোন  ঘোষণার অপেক্ষায় তখন বসে ছিল না।
শেষ কথা: রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন। ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ হয় তাদের লেখায়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ নিজে সবসময়ই দাবি করেছেন, তিনি তার বইয়ে কোন অসত্য তথ্য লিখেননি। ইতিহাসের গতিনির্ধারক মানুষদের লেখা নিয়ে বিতর্ক হবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে রাজনীতিবিদদের বার বার মতাদর্শ পরিবর্তনও তাদের লেখা বই নিয়ে বিতর্ক তৈরির একটি কারণ।

No comments

Powered by Blogger.