খোঁড়াখুঁড়ি, নগরজুড়ে দুর্ভোগ by উৎপল রায়

বর্ষার শুরুতে নগরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি। জলাবদ্ধতা, দুর্ভোগ। এটি যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরই বর্ষার শুরুতে এমন চিত্র দেখা যায় রাজধানীতে। সর্বশেষ কয়েক দিনের বৃষ্টিতে রাজধানীতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার মূলেও অনেকটা দায়ী ছিল এমন খোঁড়াখুঁড়ি।
সিটি করপোরেশন, ওয়াসার ড্রেন ও লাইন সংস্কারের কাজও হয় বর্ষা মওসুম শুরুর আগে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ কাজ গড়ায় বর্ষা পর্যন্ত- যা জনদুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেয়। সরজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জলাবদ্ধতা দূরীকরণের নামে নালা সমপ্রসারণ, পানি সরবরাহে ভূগর্ভস্থ পাইপ লাইন স্থাপন ও মেরামত, স্যুয়ারেজ লাইন মেরামত, গ্যাস লাইন স্থাপন ও মেরামতের অজুহাতে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা ও ড্রেন খোঁড়াখুঁড়িতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। মেরামতের জন্য খুঁড়ে রাখা গর্তের মাটি, বালু, কংক্রিটের গুঁড়ো দিনের পর দিন পড়ে থাকছে রাস্তার দু’দিকে। দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। বৃষ্টি হলেই রাস্তা ও অলিগলি পথ হয়ে উঠছে কাদায় আর পানিতে মাখামাখি। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিসিসি), ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ঢাকা ওয়াসা), তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, বিটিআরসি সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বর্ষার আগে তাদের চিরাচরিত ‘খোঁড়াখুঁড়ি’ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে। তবে এর জন্য তারা দায়ী করছেন একে অপরকে। পান্থপথ, গ্রীনরোড মোড় থেকে স্কয়ার হাসপাতাল হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সিগন্যাল পর্যন্ত রাস্তার পাশের স্যুয়ারেজ লাইন মেরামতের কাজ শুরু হয়েছিল এক মাস আগে। কিন্তু স্যুয়ারেজ লাইন তৈরি হলেও অনেক জায়গায় গর্ত এখনও রয়ে গেছে। রাস্তার পাশে জমে আছে মাটি, বালি, কংক্রিটের স্তূপ। রাস্তার পরিধি ছোট হয়ে যাওয়ায় যানজট এই এলাকার নিত্যসঙ্গী। তাছাড়া, স্ল্যাব নির্মাণের জন্য তৈরি করা বড় বড় গর্তে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শ্যামল কুমার ভৌমিক ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, স্ল্যাবগুলো মেরামত না করায় গর্তগুলো এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহে আমি নিজেও দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। এখানকার কর্মরত শ্রমিক জামাল মিয়া জানালেন,  কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে তা তারা জানেন না। যখনই ডাক দেন, কাজ করতে চলে আসেন। কলাবাগান থেকে উত্তর ধানমন্ডি সড়কে গ্যাস পাইপলাইন মেরামত কাজ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শেষ করার কথা ছিল এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে। এই মেরামত কাজ জুন মাস পর্যন্ত চলবে। অভিজাত এলাকা বারিধারা সৌদি মসজিদের পার্শ্ববর্তী রাস্তা সংস্কারের নামে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। কবে নাগাদ এই যন্ত্রণার অবসান হবে তা নিয়ে শঙ্কিত এলাকাবাসী। মিরপুর মাজার রোড থেকে শ্যামলী পর্যন্ত পাইপলাইন তৈরির কাজ নির্ধারিত সময় পার হলেও এখনও চলছে। মিরপুর ১৪ নম্বর শহীদ মোয়াজ্জম চত্বর সড়ক থেকে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ হয়ে ১৩ নম্বর পুলিশ স্টাফ কলেজ পর্যন্ত রাস্তার পাশে স্যুয়ারেজ লাইন মেরামতের কাজ শুরু হয় জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও মেরামত কাজ শেষ হয়নি এখনও।  ড্রেনের মাটি, কংক্রিট ফেলে রাখা হয়েছে রাস্তার পাশে। পাইপ লাইন ফেটে ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশে। বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। এলাকার বাসিন্দারা জানান, বৃষ্টি হলেই এই সড়ক দিয়ে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফুটপাথের চা বিক্রেতা মো. খালেক মিয়া জানালেন, কাউকে আসতে দেখি না। বহুদিন ধইরা কাজ বন্ধ। পল্লবী-রূপনগর সড়কের মিল্কভিটা পয়েন্টে স্যুয়ারেজ লাইন মেরামতের নামে তৈরি করা হয়েছে বড় বড় গর্ত। এতে প্রতিদিনই ঘটছে ছোটখাটো দুর্ঘটনা। এলাকার বাসিন্দা একরাম মোল্লা জানালেন, সেই কবে থেকে কাজ হচ্ছে। শেষ আর হয় না। নর্দ্দা বাসস্ট্যান্ড থেকে গুলশান ২ পর্যন্ত রাস্তার একপাশে পাইপ লাইন স্থাপনের জন্য প্রায় ৫ ফুট রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় এলাকাবাসী পোহাচ্ছেন দুর্ভোগ। গুলশান- ১ থেকে তেজগাঁওমুখী সড়ক মেরামতের জন্য সড়কের পাশে কয়েক ফুট গভীরতায় মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছিল ভূগর্ভস্থ পাইপ লাইন মেরামতের উদ্দেশ্যে। ২০১২ সালে শুরু করা ঢাকা ওয়াসার এই কাজ শেষ করার কথা ছিল গত ৩০শে মার্চ। ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. শাহজাহান মানবজমিনকে বলেন, সাধারণত এপ্রিল মে মাসের পরে আমরা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ রাখি। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজের কাজ এবছরের মতো শেষ হয়েছে। চলতি সময়ে কার্পেটিং ও স্ল্যাব নির্মাণের কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, দ্রুতই তা সম্পন্ন হবে। এছাড়া, রাস্তা ও ড্রেন খোঁড়াখুঁড়ির জন্য ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী  ডিসিসি, টিঅ্যান্ডটি, ডেসকো, তিতাস গ্যাস ও বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানিকে দায়ী করেন। পুরান ঢাকার কবি নজরুল কলেজ থেকে লক্ষ্মীবাজার সোহরাওয়ার্দী কলেজ মোড় পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে স্যুয়ারেজ লাইন মেরামতের নামে গভীর খনন চললেও কবে নাগাদ এ দুর্ভোগ শেষ হবে জানেন না এলাকাবাসী। একটু বৃষ্টি হলেই এই এলাকা পানিতে ডুবে যায়। তখন কাদা পানিতে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এই এলাকার মানুষের জীবনযাপন। মোহাম্মদপুর জাপান গার্ডেন সিটি থেকে শিয়া মসজিদ, তেজগাঁও লিংক রোড থেকে গুলশান ২, মগবাজার রেল ক্রসিং থেকে বিএফডিসি গেট পর্যন্ত রাস্তা ও ড্রেন সংস্কারের নামে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। এবিষয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন সাধারণত মে মাসের পর রাস্তা মেরামত, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন, পাইপলাইন মেরামত ও স্থাপনের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেয় না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে সময়মতো কাজ শেষ হয় না। খোঁড়াখুঁড়ির জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করেন তারা। ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণ-এর প্রধান প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম মানবজমিনকে বলেন, ডিসিসি’র আওতাধীন কোন কোন এলাকায় টেলিফোনের কানেকশন, বিদ্যুৎ সমস্যা, ড্রেনেজ সিস্টেম, পানি সরবরাহে সমস্যার জন্য কাটিং (খোঁড়াখুঁড়ি) অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী যদি এটা মেনে না নেন তাহলে তো তাদের ভোগান্তি আরও বাড়বে। নাগরিক সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হবেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে  মে মাসের মধ্যে কোন খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেয়া হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, তারপরও কেউ যদি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারে ও রাস্তার পাশে মাটি, বালি, কংক্রিট পরিষ্কার না করে তাহলে জরিমানার ব্যবস্থা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.