বাংলাদেশে গণহত্যা ও সরকারের দায়ভার by ফিরোজ মাহবুব কামাল

হেফাজতে ইসলামের মুসল্লিদের রক্তের স্রোতে মতিঝিলের পিচঢালা কালো রাস্তা লালে লাল হয়ে গেছে। গত ৫ মে দিবাগত রাতে হেফাজতে ইসলামের লক্ষাধিক কর্মী যখন খোলা রাস্তায় বসে শান্তিপূর্ণভাবে বসে ছিল, কেউবা জিকর করছিল, কেউবা ঘুমিয়েছিল—তখন রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে হঠাত্ রাস্তায় বিদ্যুতের বাতি বন্ধ করে দেয়া হয়।
সেই ঘন আঁধারে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের হাজার হাজার সদস্য ঝাঁপিয়ে পড়ে হেফাজত কর্মীদের ওপর। বৃষ্টির মতো অবিরাম গুলি বর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপে কেঁপে ওঠে সমগ্র ঢাকা। যেন দেশের ওপর শত্রু বাহিনীর সামরিক অভিযান চলছে! গুলির সঙ্গে তাদের লাঠি দিয়েও পেটানো হয়। ‘দৈনিক আমার দেশ’-এর রিপোর্ট : “রাত তখন প্রায় আড়াইটা। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আগত মুসল্লিদের অনেকেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। অসংখ্য মুসল্লি তখনও জিকিরে মশগুল। এ অবস্থায় মাইকে ভেসে আসে একটি ঘোষণা—আপনারা সরে যান। এখন আমরা শাপলা চত্বর খালি করার জন্য যা যা করা দরকার তা-ই করব।
তাতে স্বভাবতই রাজি হননি আল্লাহর পথে নিবেদিতপ্রাণ মুসল্লিরা। এরপর আর কথা বাড়ায়নি সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী। অন্তত ১০ হাজার পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা ত্রিমুখী হামলা শুরু করে। ব্রাশফায়ারের মুহুর্মুহু গুলি, গ্রেনেড, টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে নিরস্ত্র মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায় তারা।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শাপলা চত্বরে ঘটে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। কেউ কেউ ঘুমের মধ্যেই চলে যান চিরঘুমের দেশে। অনেকে আবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।” (আমার দেশ ৭/০৫/১৩)।
এমন নৃশংস বর্বরতা পাকিস্তান আমলেও ঘটেনি, ব্রিটিশ আমলেও ঘটেনি। কিন্তু ঘটল বাংলাদেশ আমলে। মতিঝিল, দৈনিক বাংলার মোড়, ফকিরাপুল, ইত্তেফাক মোড়সহ আশপাশের এলাকা হয়েছে রক্তে প্লাবিত। কতজন শহীদ হয়েছেন তার সঠিক হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। যখন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে, সেখানে কোনো সাংবাদিককে থাকতে দেয়া হয়নি। বলা হচ্ছে, সকাল হওয়ার আগেই রাতের আঁধারে সরকার অসংখ্য লাশ গোপন করেছে। বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে গতকাল এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন জানায়, নিহতের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি হতে পারে। হেফাজতে ইসলামের হিসাবে নিহতের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি হবে। বিরোধী দল বিএনপি বলছে, শাপলা চত্বরে সহস্রাধিক লোককে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এ গণহত্যা ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালোরাতের চেয়ে ভয়াবহ ও জঘন্য বলে মন্তব্য দলটির। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একজন রিপোর্টার দাবি করেছেন, তিনি পাঁচটি ট্রাকে করে লাশ নিতে দেখেছেন। লাইভ রিপোর্টিংয়ে তার সেই তথ্য প্রচার করা হলেও পরে আর প্রচার করেনি চ্যানেলটি। অভিযান শুরু করে পুলিশ. র্যাব ও বিজিবির যৌথ বাহিনী। গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকা। এ সময় হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা আশপাশের বিভিন্ন অলিগলিতে আশ্রয় নেয়। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওইসব অলিগলিতেও হানা দেয়।
যুদ্ধসাজে সজ্জিত যৌথ বাহিনী এরপর অভিযান চালায় গলিগুলোতেও। সেখান থেকেও পিটিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। এরপরও চলতে থাকে পুলিশের তাণ্ডব। গুলি করতে করতে হেফাজত কর্মীদের ধাওয়া করতে থাকে তারা। এসময় অনেককে পিটিয়ে আহত করা হয়। তাদের রক্তে বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে তাজা রক্তের ফোয়ারা। —(আমার দেশ ৭/০৫/১৩)। ব্রিটিশ সরকার নিষ্ঠুরতায় ইতিহাস গড়েছিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে। সেখানে নিরস্ত্র জনসভার ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছিল। তবে সেখানে লাশ গোপন করা হয়নি। সে হত্যাকাণ্ডও রাতের আঁধারে হয়নি। মতিঝিলে যা ঘটেছে তা জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও নিষ্ঠুর।
আসল রূপে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই নৃশংস বর্বরতার রেকর্ড নির্মিত হয়। আওয়ামী লীগের এটিই আসল রূপ। মরহুম শেখ মুজিব রেকর্ড গড়েছিলেন গণতন্ত্র হত্যায় এবং সেই সঙ্গে তিরিশ-চল্লিশ হাজার বিরোধীদলীয় কর্মী হত্যায়। ডেকে এনেছিলেন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। অসংখ্য নতুন রেকর্ড তৈরি হলো মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার আমলেও। সেটি যেমন পিলখানায়, তেমনি সাভারের রানা প্লাজা ধসে, তেমনি মতিঝিলে। মতিঝিলে রক্ত ধোয়ার জন্য সূর্য ওঠার আগেই মিউনিসিপ্যালিটির পানিবাহী ট্যাঙ্কার আনা হয় এবং রাস্তায় প্রচুর পানি ঢালা হয়। লক্ষ্য, খুনের আলামত তাড়াতাড়ি মুছে ফেলা। কথা হলো, পানি ঢেলে এভাবে রাস্তার খুন মুছতে পারলেও কোটি কোটি মানুষের স্মৃতিতে বীভত্স বর্বরতার যে স্মৃতি রয়ে গেল সেটি কি শত বছরেও বিলুপ্ত হবে? সরকার নাস্তিক ব্লগারদের মাসের পর মাস ব্যস্ত শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়ার সুযোগ দিয়েছে, বিরিয়ানি খাইয়েছে এবং পুলিশ দিয়ে প্রটেকশনও দিয়েছে। অথচ দেশের আলেম-ওলামাদের সে সুযোগ একটি দিনের জন্যও দিল না। হাসিনা সরকারের কাছে ইসলামপন্থীরা যে কতটা অসহ্য, তাদের বিরুদ্ধে এ সরকার যে কতটা নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী—এ হলো তার প্রমাণ।
কোরআনে আগুন ও আওয়ামী মিথ্যাচার
কোনো ঈমানদার ব্যক্তি কি পবিত্র কোরআনে আগুন দেন? পুড়িয়ে ছাই করেন কি ইসলামী বইয়ের মার্কেট? এমন কাণ্ড কি কোনো মুসলিম দেশে ভাবা যায়? এমন ঘটনা কি কোনো দিন পাকিস্তান আমলে হয়েছিল না ব্রিটিশ আমলে? বাগদাদে এমন বর্বর কাণ্ড ঘটেছিল বর্বর হালালু খাঁর দস্যু বাহিনীর হাতে। তখন লাখ লাখ বই পুড়িয়ে ছাই করেছিল হালাকু বাহিনী। শেখ হাসিনার সরকার সে অসভ্যতাই নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশে। গত ৫/৫/১৩ তারিখে তো সেটিই হলো। তাদের কাছে কোরআনের তাফসির মহফিল করা অপরাধ, সে অপরাধে ফাঁসির হুকুম শোনানো হয়েছে দেশের বিখ্যাত তাফসিরকারক মাওলানা সাঈদীকে। আজও কোথাও তাফসিরের মহফিল বসলে র্যাব ও পুলিশ ধেয়ে আসে। শেখ হাসিনা ও তার দল কোরআন-হাদিসের জ্ঞানচর্চায় প্রচণ্ড ভয় পান। তবে তাদের সে ভয়ের কারণও রয়েছে। তারা জানেন, একমাত্র কোরআন-হাদিসের জ্ঞানই মানব মন থেকে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধারণা বিলুপ্ত করে দেয়। অথচ তাদের রাজনীতির মূল ভিত্তিই হলো আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহী চেতনা নিয়েই তারা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রুখতে চান। তখন আসে সেক্যুলারিজমের নামে ইসলাম-বিরোধিতা। আসে অশ্লীলতা, আসে মূর্তি গড়া। আসে মঙ্গল প্রদীপের সংস্কৃতি। অথচ কোরআনের তাফসির হলে এসবের চর্চা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন বাড়ে জিহাদি চেতনা এবং শুরু হয় লড়াই। এজন্যই সরকারের বহু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের বহু নেতার অভিযোগ, মাদরাসা থেকে জিহাদি সৃষ্টি হয়। তাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘ধর্ম আফিমের নেশা’। এজন্যই সরকার সুপরিকল্পিতভাবে দেশের কোমলমতি যুবক-যুবতীদের কোরআন-হাদিসের শিক্ষা থেকে সরিয়ে নাচ-গানের দিকে নিতে চায়। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আকর্ষণ বাড়াতে সরকার এজন্যই যেমন সেখানে দিনরাত পুলিশি প্রহরা দিয়েছে এবং বিরিয়ানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে। স্কুলের কচি শিশুদের পাঠিয়েছে মাথায় ‘ফাঁসি চাই’য়ের স্লোগান লেখা পট্টি বেঁধে। অপরদিকে সরকার কড়া নজর রাখছে, মসজিদে জুমার খোতবায় যাতে জিহাদ বিষয়ক বক্তব্য রাখা না হয়। তাই বাংলাদেশে ইসলামভীতি শুধু কাফেরদের নয়, বরং আওয়ামী লীগারদেরও। সে ভয় নিয়েই বায়তুল মোকাররমের মতো দেশের বড় মসজিদগুলোতে সরকার সমর্থক ইমাম বসানো হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকার র্যাাব ও পুলিশ নামিয়েছে শহর ও গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করার কাজে। কিন্তু তাতেও মনের সাধ মেটেনি। অবশেষে আগুন দিয়েছে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে অবস্থিত ইসলামী বইয়ের সবচেয়ে বড় বাজারটিতে। হাজার হাজার কোরআন-হাদিস ও ইসলামী বই সেখানে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ইসলামের শত্রু দুর্বৃত্তদেরই এতে আনন্দ বেড়েছে। খুনি-সন্ত্রাসীরা সব সময়ই নিজেদের ঘৃণ্য অপরাধ জায়েজ করতে অবিরাম বাহানা তালাশ করে। শেখ মুজিব যখন গণতন্ত্র হত্যা করে বাকশাল কায়েম করেছিলেন এবং হত্যা করেছিলেন ৩০-৪০ হাজার বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মী, তখনও একটি বাহানা খাড়া করেছিলেন। তাদের লক্ষ্য একটাই, সেটি যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা। সে লক্ষ্য পূরণে সব ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুন, নিষ্ঠুরতা, মিথ্যা ও জালিয়াতিকে তারা জায়েজ মনে করে। এমনকি চিহ্নিত শত্রুর সঙ্গে তারা জোট বাঁধতেও রাজি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বিলুপ্ত করার পেছনেও কারণ এটাই এবং সে অভিন্ন লক্ষ্য পূরণেই তারা রাতের আঁধারে ৫ মে হেফাজতের নিরীহ কর্মীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে এবং গণহত্যার পর দোষ ঢাকার জন্য বাহানা সৃষ্টি করে চলেছে। বলছে, বায়তুল মোকাররমে কোরআন-হাদিসের দোকানে আগুন দিয়েছে হেফাজতে ইসলামের মুসল্লিরা। সরকারি দলের পত্র-পত্রিকা ও টিভিতে লাগাতার প্রচারণা চালানো হচ্ছে, বায়তুল মোকাররমে বইয়ের দোকান এবং পল্টনের দোকানপাটে লুটপাট করেছে এবং আগুন লাগিয়েছে হেফাজতে ইসলামের হুজুরেরা।
মিথ্যা রটনা যেখানে স্ট্র্যাটেজি
প্রশ্ন হলো, এ বিশাল মিথ্যাটি হয়তো আওয়ামী লীগের মিথ্যাচারী দলীয় দুর্বৃত্তদের সহজেই গেলানো যেতে পারে, হয়তো সমাজের কিছু বুদ্ধিহীন পাগলকেও বিশ্বাস করানো যেতে পারে, কিন্তু কোনো বিবেকবান মানুষ কি সেটি বিশ্বাস করবেন? বাংলাদেশের জনগণ কি এতটাই বিবেকহীন যে এ ভিত্তিহীন অপপ্রচারকে তারা গ্রহণ করবে? এটি সত্য যে, এমন বিবেকহীন ব্যক্তি আওয়ামী লীগে অসংখ্য। তাদের বিপুল উপস্থিতি এমনকি হাসিনার সরকারের মন্ত্রী পর্যায়েও রয়েছে। সাভারে রানা প্লাজা ধসে যাওয়ার পর এরাই বলেছিল, ‘রানা প্লাজার পিলার ধরে মৌলবাদীরা ধাক্কা দেয়ার কারণে ভবনটি ধসার ঘটনাটি ঘটতে পারে।’ কথাটি বলেছিলেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলেছিলেন একটি স্ট্র্যাটেজির অংশ রূপে। লক্ষ্য ছিল, তাদের সব কুকর্মের দায়ভার বিরোধীদের ঘাড়ে চাপানো। ভবিষ্যতে সে লক্ষ্য পূরণে তারা যে আরও বহু মিথ্যা বলবেন তাতে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে? সে অভিন্ন লক্ষ্য নিয়েই তারা একথাও বলছেন, মতিঝিলের রাস্তার গাছগুলোও কেটেছে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। যেন দা-কুড়াল ও করাত নিয়ে তারা রাস্তায় নেমেছিল। অথচ তাদের মগজে এ প্রশ্নের একবারও উদয় হলো না যে, হেফাজতে ইসলামের যে আলেমরা সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন কোরআন-হাদিসের জ্ঞান শিক্ষা ও শেখানোর কাজে, তারা কি অবশেষে কোরআন-হাদিসে আগুন দেবেন? তারা কাটবেন রাস্তার গাছ এবং লুট করবেন দোকানপাট?
প্রত্যেকটি অপরাধেরই সুস্পষ্ট মোটিভ বা উদ্দেশ্য থাকে। মোটিভ ছাড়া কেউ কখনও সামান্য মেধা বা শ্রমেরও বিনিয়োগ করে না। কাউকে যেমন ক্ষতি করে না তেমনি কোথাও আগুনও দেয় না। প্রশ্ন হলো, কোরআন-হাদিসের দোকানে আগুন দেয়ার পেছনে হেফাজতে ইসলামের আলেমদের কি মোটিভ থাকতে পারে? তা থেকে তাদের অর্জনটা কী? তারা তো নেমেছেন আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কাজে। তাদের কাছে এটি রাজনীতি নয়, বরং জিহাদ। পবিত্র জিহাদে তো তারা পবিত্র কাজগুলোই করবেন। তাদের কেউ কেউ রাস্তায় নেমেছিলেন কাফনের কাপড় পরে। ফলে কোরআন-হাদিসে আগুন দিলে কি মহান আল্লাহর কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত? তারা তো রাস্তায় নেমেছেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। এমন কুকর্মে কি জনগণের কাছেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত? হেফাজতে ইসলামের লড়াই তো নাস্তিক এবং নাস্তিকদের পৃষ্ঠপোষক হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের শত্রুতা অবশ্যই ইসলামী বইয়ের দোকানদারদের বিরুদ্ধে ছিল না। বইয়ের দোকানে তারা আগুন দেবেন কেন? বরং তারা তো চাইবেন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আরও বেশি বেশি কোরআন-হাদিসের দোকান গড়ে উঠুক এবং বেশি বেশি মানুষ জ্ঞানচর্চা করুক। এসব দোকানে আগুন দেয়ার কাজে মোটিভ থাকবে তো তাদের, যারা বাংলাদেশ থেকে ইসলামের প্রভাব কমাতে চায়। চায় ইসলামপন্থীদের গায়ে কুিসত কালিমা লেপন করতে। ইরানে বিপ্লবের শুরুতে বিপ্লব ঠেকাতে শাহের গুপ্তচর বাহিনী আবাদানের সিনেমা হলে আগুন দিয়ে বহু মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল। দোষ চাপিয়েছিল আয়াতুল্লাহ খোমেনির অনুসারীদের ওপর। দেশে দেশে শয়তানি শক্তির এটিই সনাতন কৌশল। আওয়ামী লীগের সে কৌশল ও মিথ্যাচার এখানেও স্পষ্ট। মিথ্যার প্রতি যে প্রচণ্ড আসক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী ম. খা. আলমগীর সাভারে ভবন ধসের দায়ভার চাপিয়েছিলেন ইসলামী মৌলবাদীদের ওপর, এবার সেই অভিন্ন মিথ্যাচার নিয়েই কোরআন-হাদিসে আগুন ও রাস্তায় গাছ কাটার দোষ চাপিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের ওপর।
হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সম্পাদক মাইনুদ্দিন রুহী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী স্বাক্ষরিত লিখিত বিবৃতিতে বলেন, সমাবেশ চলাকালে রোববার দুপুর থেকেই পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের অভিযোগ, গণহত্যার পরিবেশ সৃষ্টিতে পরিকল্পিতভাবেই এসব ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। তারা বলেছেন, রোববার (৫/৫/১৩) দুপুরের পর থেকে গুলিস্তান, নয়াপল্টন, বায়তুল মোকররম উত্তর গেট, বিজয়নগরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশের সম্মিলিত আক্রমণে এবং তাদেরই উস্কানিতে যে জ্বালাও-পোড়াও ও হত্যাযজ্ঞ চলেছে তার দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। হেফাজতে ইসলাম বারবার প্রমাণ করেছে, তারা শান্তিপূর্ণ, জ্বালাও-পোড়াও ও অগ্নিসংযোগে তারা বিশ্বাস করে না। কিন্তু বায়তুল মোকাররম এলাকার আশপাশে জ্বালাও-পোড়াওয়ের যে তাণ্ডব হয়েছে তা ছিল সরকারদলীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের পূর্বকল্পিত হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট। তারা স্বর্ণের দোকানে লুটপাট করেছে, বইয়ের দোকানে আগুন দিয়েছে, পবিত্র কোরআন শরীফ জ্বালিয়ে দিয়েছে, গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। পুলিশের নির্লজ্জ সহযোগিতায় রাজধানীর মধ্যাঞ্চলকে নরকে পরিণত করেছে। কিন্তু সরকারি সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়ার মাধ্যমে হেফাজত কর্মীদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।
নেতারা বলেন, দফায় দফায় হামলা, গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা চালানোর পরও মধ্যরাতে যখন হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে শাপলা চত্বরে অবস্থান করছিলেন, কেউ জিকির করছিলেন, কেউ নামাজ পড়ছিলেন, কেউ সামান্য সময়ের জন্য ঘুমন্ত ছিলেন—এই সময় সরকারের পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব যে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়েছে, হাজার হাজার শান্তিপূর্ণ মানুষকে শহীদ করেছে, ২০ সহস্রাধিক মানুষকে পঙ্গু করেছে, তা ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তদুপরি এই হাজার হাজার শহীদের লাশকে পিকআপ, অ্যাম্বুলেন্স, ট্রাকে করে গুম করা হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন। ৫ মে কালো রাতের বর্বরতা উল্লেখ করে তারা বলেন, সরকার নজিরবিহীনভাবে বিদ্যুত্ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়ে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব আচমকা সমাবেশস্থলে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা সেই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে কমপক্ষে দুই সহস্রাধিক নেতাকর্মী শাহাদাত বরণ করেছেন। অনেক লাশ গুম করা হয়েছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই সিটি করপোরেশনের ময়লা বহনের গাড়িতে করে বিপুলসংখ্যক লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বহু নেতাকর্মী এখনও নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করেছে সংগঠনটি।
সরকারি বাহিনীর সন্ত্রাস ও গণপ্রতিরোধ
ঢাকার নৃশংস গণহত্যার পরও সরকারি বাহিনীর সন্ত্রাস থেমে যায়নি। র্যাব, পুলিশ এবং বিজিবি হানা দিয়েছে মফস্বলের বিভিন্ন মাদরাসায়। প্রতিরোধ গড়ে তুলছে জনগণও। ৬ মে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর, সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় ও শিমরাইল, চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং বাগেরহাটে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সংঘর্ষে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যসহ অন্তত ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন আড়াই শতাধিক। নারায়ণগঞ্জে নিহতদের মধ্যে দু’জন পুলিশ ও তিনজন বিজিবি সদস্য রয়েছে। তবে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে দাবি করছে হেফাজতে ইসলাম ও স্থানীয়রা। আহত হয়েছেন সাংবাদিক, পুলিশ, বিজিবি ও পথচারীসহ দুই শতাধিক। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সোমবার সকাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
মিডিয়া তালাবদ্ধ
খুনিরা কখনোই খুনের কাজটি দিবালোকে করে না। সবার চোখের সামনেও করে না। আওয়ামী লীগও ৫ মে’র খুনের কাজটি দিবাভাগে করেনি। করেছে রাতে এবং রাস্তার আলো নিভিয়ে। সে রাতে কি ঘটেছে সে খবর গোপন করতে সেখানে কোনো মিডিয়া কর্মীকে থাকতে দেয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে প্রাপ্ত খবরগুলো যাতে জনসমক্ষে পৌঁছতে না পারে সে জন্য সরকার বন্ধ করে দিয়েছে বেসরকারি টিভি চ্যানেল দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি। ফলে সরকারের গুণকীর্তনকারী টিভি চ্যানেলগুলো ছাড়া বাংলাদেশে এখন আর কোনো টিভি চ্যানেলই নেই। এ টিভি চ্যানেলগুলোর কাজ হয়েছে সরকারের নৃশংস বর্বরতাকে প্রশংসনীয় কর্মরূপে প্রচার করা। আসল ঘটনা যাতে প্রচার না পায় সেজন্য সরকার আগেই বন্ধ করেছে ‘দৈনিক আমার দেশ’। কারাবন্দি করেছে আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। সম্প্রতি আওয়ামী গুণ্ডারা হামলা করেছে আরেক সাহসী লেখক শফিক রেহমানের বাড়িতে। শফিক রেহমান থানায় খবর দিয়েও কোনো সাহায্য পাননি। বাংলাদেশ এভাবে প্রবেশ করেছে এক যুদ্ধাবস্থায়। সারা দেশ পরিণত হয়েছে একটি জেলখানায়। বাংলাদেশ এখন ভারত ও তার সেবাদাসদের অধিকৃত ভূমি। রহিত হয়ে গেছে দেশপ্রেমিকদের সব মৌলিক মানবিক অধিকার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ায় অতীতেও এমনটি হয়েছে। চুয়াত্তরে বাকশালী স্বৈরাচার এনেছে। এসেছে হত্যা ও গুমের রাজত্ব। মুজিব তার রক্ষীবাহিনী দিয়ে যেভাবে তিরিশ-চল্লিশ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলেন, হাসিনাও সে পথই ধরেছেন। হাসিনার ক্ষমতায় আসার পর তাই সংঘটিত হলো পিলখানা হত্যাকাণ্ড। আগুন লাগল তাজনীন গার্মেন্টে এবং সেখানে পুড়ে কয়লা হলো শতাধিক শ্রমিক। সম্প্রতি ধসে গেল রানা প্লাজা। এ ভবন ধসে হাজারের বেশি লাশ উদ্ধার হলেও শ্রমিকরা বলছেন, চাপা পড়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে সহস্রাধিক মানুষ। আর এখন লাগাতার রক্ত ঝরছে শুধু মতিঝিলে নয়, সারা বাংলাদেশে। এই হলো হাসিনার শাসনামল। প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন, এভাবে গায়ের জোরেই তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কি এত খুন, এত অত্যাচার নীরবে মেনে নেবে? এরই মধ্যে আওয়াজ উঠেছে, ‘খুন হয়েছে আমার ভাই, সব খুনিদের ফাঁসি চাই’

No comments

Powered by Blogger.