ড. ইউনূসের নিবন্ধ- সাভার ট্র্যাজেডি, পোশাকশিল্প ও বাংলাদেশ

১.০- সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক। রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে।
রানা প্লাজায় মৃতদের আত্মা আজ আমাদের কর্মকাণ্ড দেখছে, আমাদের আলোচনা শুনছে। আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস আমাদের সর্বক্ষণ ঘিরে আছে। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড থেকে আমরা কি কিছু শিখলাম? নাকি শুধু মর্মান্তিক বেদনা জানিয়ে আমাদের কর্তব্য শেষ করবো।

২) আমাদের করণীয় কী?

ক) এই ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য কী কী করতে হবে।
খ) যারা প্রাণ হারালো, অঙ্গ হারালো, আয় হারালো তাদের জন্য আমাদের করণীয় কি?
গ) পোশাকশিল্পকে শুধু রক্ষা নয় বরং শক্তিশালী করার জন্য আমাদের কী করতে হবে।
ঘ) সাভারে শুধু শুধু ভবন ধ্বসে পড়েনি। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বসে পড়ার একটি বহিপ্রকাশ হিসেবে এই ভবন ধসে পড়েছে। ভবন ধসের বিশ্লেষন করলে আমাদের ধসে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারা ধরা পড়বে। এই ধস থামাবার উপায় বের করতে হবে।

৩.০  পোষাক শিল্পকে রক্ষা তো বটেই বরং শক্তিশালী করা নিয়ে কিছু বলতে চাই।

সিটিজেন্স অ্যাকশন গ্রুপ গঠন
ক) পোষাক শিল্প সম্বন্ধে প্রশ্ন জেগেছে। বাংলাদেশে পোষাক তৈরি করতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে বলে একটি বিশাল বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এই দেশ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এরপর আরো অনেকে তার দৃষ্টান্ত অনুকরণ করে এদেশ থেকে চলে যেতে পারে।

এটা যদি হয় এটা আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যতকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করবে। এই শিল্প শুধু আমাদের আয় বাড়াচ্ছে না, আমাদের মহিলা সমাজকে সম্পূর্ণ নতুন জীবনের সন্ধান দিয়ে সমাজে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। এই শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে দেওয়া যাবে না। বরং শক্তিশালী করার জন্য সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ হতে হবে।

সরকার, পোষাক শিল্পের মালিকবৃন্দ, এন জি ও, নাগরিক সমাজ সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশি ক্রেতাদের পরিপূর্ণভাবে আশ্বস্ত করতে হবে যে তারা যাতে আর কখনো আমাদের কারণে বিপাকে না-পড়ে সে ব্যাপারে সমস্ত পদক্ষেপ নেবার ব্যাপারে আমরা একতাবদ্ধ এবং ভবিষ্যতে আমাদের অঙ্গীকার দৃঢ়ভাবে পালন করবো।

খ) এদের প্রত্যেকে (সরকার, মালিকপক্ষ, নাগরিক সমাজ, ইত্যাদি) যৌথভাবে যেমন কাজ করবে, তেমনি নিজ নিজ আওতায় স্বতন্ত্রভাবে ও কাজ করে যাবে। নাগরিক সমাজকে নিজস্ব পদ্ধতিতে কর্মসূচি নিতে হবে। নাগরিক সমাজ দেশের পক্ষ থেকে বিদেশি ক্রেতাদের মনে আস্থা এবং আশা সৃষ্টির প্রয়াস নিতে পারে।

তারা অবিলম্বে যৌথভাবে স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ক্রেতা কোম্পানিগুলোর বোর্ড চেয়ারম্যান এবং কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠাতে পারে।

বক্তব্য বিষয় হবে: বাংলাদেশে পোষাক শিল্পের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরা, মহিলাদের ক্ষমতায়নে এবং বাংলাদেশের ব্যাপক পরিবর্তনে এর ভূমিকা তুলে ধরে তাদেরকে ধন্যবাদ জানানো।

এই শিল্পের যাবতীয় সমস্যা মেটাতে সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে এবং পৃথকভাবে নাগরিক সমাজ প্রস্তুত হয়েছে এটা জানানো, এ ব্যাপারে যেসব কর্মসূচি নিয়ে তারা চিন্তা ভাবনা করছেন সেটা জানানো, তাদের কর্মসূচি নিয়ে বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একটা “সিটিজেন্স অ্যাকশন গ্রুপ ফর প্রটেক্টিং গারমেন্ট ওয়াকার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি” বা অনুরূপ নামে যে একটা প্রতিষ্ঠান গঠন হয়েছে সেটা এবং এর পরিচিতি তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।

গ) আরেকটি চিঠি যাবে বিদেশি সংগঠন, এন জি ও, কনসাল্টিং ফার্মের কাছে, যারা তৃতীয় বিশ্বের পোষাক শিল্পের মান উন্নয়ন, শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা, মনিটরিং, স্ক্রিনিং ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন তাঁদের কাছে।
অ্যাকশন গ্রুপ তাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়, তাদের সহযোগিতা চায় এটা জানিয়ে দেওয়া। তাদের সঙ্গে বৈঠকের আহবান জানানো এবং ক্রমাগতভাবে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করা।

ঘ) ক্রেতা দেশগুলির সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লেখা- আমরা পোষাক শিল্পের ব্যাপক পরিবর্তন আনার জন্য বদ্ধ পরিকর সেটা জানিয়ে দেওয়া।

ঙ) দেশের অভ্যন্তরে সরকার, শিল্প মালিক, বি.জি.এম.ই.এ, বি কে.এম.ই.এ, শ্রমিক সংগঠন, এন জি ও, বায়িং হাউস, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দেয়া এবং কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের জন্য বৈঠক করা।
অ্যাকশন গ্রুপ নিয়মিতভাবে সরকার, বিদেশি ক্রেতা, শিল্প মালিক, পোষাক শ্রমিক ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ করে পোষাক শিল্পের সম্প্রসারন  এবং পোষাক শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে পোষাক শিল্প নিয়মিত মনিটর করবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের পরামর্শ দেবে, সংবাদ মাধ্যমকে অবহিত রাখবে এবং কর্মসূচি নেবে। তারা হবে নাগরিক ওয়াচ ডগ প্রতিষ্ঠান।

আমার দু’টি প্রস্তাব
পোষাক শিল্পের সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু প্রস্তাব ক্রেতাদের কাছে আমি মাঝে মাঝে দিয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সে প্রস্তাবটি আমি এখন আবার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে তুলে ধরতে চাই।

বিশেষ করে পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশের পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের  “ক্রীতদাস তুল্য শ্রমিক” ঘোষণা দেওয়ার পর আমার প্রস্তাবটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ মঙ্গলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।

ক) প্রথম প্রস্তাব:
দেশে ন্যুনতম মজুরি আইন আছে। যার ফলে কোন প্রতিষ্ঠান এর নিচে বেতন দিলে এটা বেআইনি প্রতিপন্ন হয়।
আমার প্রস্তাব হলো: পোষাক শিল্পের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে একটি আন্তর্জাতিক ন্যুনতম বেতন স্থির করে দেবে। বাংলাদেশে সর্বনিম্ন বেতনের হার যদি এখন ঘণ্টায় ২৫ সেন্ট হয়ে থাকে এটাকে আন্তর্জাতিক শিল্পের জন্য আন্তর্জাতিক মানের করে সর্বনিম্ন ৫০ সেন্ট নির্ধারণ করে তারা সমস্ত দরদাম নির্ধারণ করবে।

কোনো ক্রেতা এর নিচে বেতন ধরে দর নির্ধারণ করবে না, কোনো শিল্প মালিক এর নিচে বেতন ধার্য করবে না। এটা কমপ্লায়েন্সের একটা অঙ্গ হবে। এর একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে এমন ধারণা করাই স্বাভাবিক।

এর ফলে বাংলাদেশ ‘সস্তা’ শ্রমিকের জন্য যে পরিমাণ আকর্ষনীয় হতে পেরেছিল, সে আকর্ষনীয়তা রাতারাতি হারিয়ে ফেলবে। এই আকর্ষনীয়তা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশকে অন্যান্য দিক থেকে আকর্ষনীয়তার পরিমাণ বাড়াতে হবে।

যেমন: শ্রমিকপ্রতি উৎপাদনের হার বাড়ানো, অন্যান্য সকল দিক থেকে কর্ম দক্ষতা বাড়ানো, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ আস্থা অর্জন করা, কোনরূপ বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি যাতে না-হয় তার নিশ্চয়তা দেওয়া, শ্রমিক মঙ্গল সর্বাঙ্গীনভাবে নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

এই আন্তর্জাতিক ন্যুনতম মজুরি নিশ্চিত না-করা পর্যন্ত পোপের মর্মান্তিক উক্তি ‘ক্রীতদাস তুল্য’ অবস্থান থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের পোষাক ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের নিষ্কৃতি  দিতে পারবে না।

বিভিন্ন ক্রেতাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে, ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে, নাগরিক গোষ্ঠী, চার্চ গ্রুপ এবং মিডিয়া নেতাদের সঙ্গে আন্তরিক আদান প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারে সমর্থন অর্জন করতে হবে। আমি এ ব্যাপারে অতীতে চেষ্টা চালিয়েছি।

সাভার ট্রাজেডির পর এবং পোপের ধিক্কারের পর আবার সুযোগ এসেছে বিষয়টি তুলে ধরার। আমি আমার দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আমার চেষ্টাকে আরো জোরদার করবো, এই অঙ্গীকার করছি।

আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানসমূহকে বুঝাতে হবে, যে পোষাক শিল্পের শ্রমিক বাংলাদেশে বসে কাজ করলেও তাঁরা তাঁদের দেশের জন্যই শ্রম দিচ্ছে। তাঁরা ঐ দেশেরই ব্যবসার স্টেকহোল্ডার। এই শ্রমিকদেরই শ্রমে তাঁদের ব্যবসা। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে তাদের থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন সেটা হয় না। সেখানেই পোপের বক্তব্যের মূল ম্যাসেজ। এটা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানদের বুঝতে হবে।

আন্তর্জাতিক কনজুমারদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য সকল ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে একমত করতে হবে- এমন হবারও দরকার নেই। কয়েকটি বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে এগিয়ে আসলেই কাজটা শুরু হয়ে যাবে। অন্যরাও ক্রমে ক্রমে এটা মেনে নেবে। 

খ) আমার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি অনেকদিন ধরে অনেকের কাছে দিয়েছি। কিন্তু দানা বাঁধেনি। এখন আবার নতুন করে বলার এবং বাস্তবায়নের সুযোগ দেখা দিয়েছে।

আমরা যে পোষাক ৫ ডলার দাম ধরে সুন্দর মোড়কে পুরে চমৎকার কার্টন ভরে নিউইয়র্ক বন্দরে পৌঁছে দিই সেই পোষাকের পেছনে তুলা উৎপাদনকারী কৃষক থেকে শুরু করে, তুলা প্রক্রিয়াজাত করা, পরিবহন করা, সুতা বানানো, কাপড় কেনা, রং করা, জামা তৈরি করে সুন্দর মোড়কে কার্টন ভরে নিউইয়র্ক বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যেতে যত শ্রম, ব্যবস্থাপনার মেধা এবং কাঁচামাল লেগেছে, বিভিন্ন স্তরে মালিককে যা লাভ করতে হয়েছে, তার সবকিছু এই ৫ ডলারের মধ্যে নিহিত আছে।

আমেরিকার কোনো বিপণীকেন্দ্র থেকে যখন একজন আমেরিকান ক্রেতা এটা ৩৫ ডলার মূল্যে এটা কিনে সস্তায় কেনার আনন্দ উপভোগ করেন তখন মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, এই বণ্টন ব্যবস্থায় সামান্যতম পরিবর্তনও কি করা যায় না?

উৎপাদন যারা করলো তারা সবাই মিলে পেলো ৫ ডলার, বিক্রি করতে গিয়ে যোগ হলো আরো ৩০ ডলার। বিক্রিমূল্যটা সামান্য একটু বাড়ালেই শ্রমিকদের জন্য অনেক কল্যাণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় এবং উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করার মধ্যেও কিছুটা সঙ্গতি আসে। এই সঙ্গতি আনার ব্যাপারেই আমার প্রস্তাব।

আমার প্রস্তাব হলো: ৩৫ ডলারের জামাটিকে যদি ৩৫ ডলার ৫০ সেন্টে কিনতে বলি তাতে ক্রেতা কি খুবই বিচলিত বোধ করবে? এই অতিরিক্ত ৫০ সেন্ট দিয়ে যদি আমি উন্নত বিশ্বের কনজুমারদের কাছে পরিচিত এবং আস্থাভাজন একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় বাংলাদেশে একটি “গ্রামীণ বা ব্র্যাক পোষাক শিল্প শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট” গঠণ করতে পারি শ্রমিকের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

তার শারীরিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, অবসরকালীন নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সন্তানের দেখাশোনা,  উপার্জন, ভ্রমণ সবকিছু এর মাধ্যমে করা সম্ভব।

এর জন্য কী করতে হবে? পোষাকের যে মূল্য দর কষাকষির মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে তার ভিত্তিতে উৎপাদন চুক্তির যে মূল্যমান দাঁড়াবে তার ওপর ১০% টাকা আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জমা দেবে আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গঠিত “শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট”- শুধু ঐ কারখানার শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য।

কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে  প্রত্যেক কারখানার জন্য পৃথক পৃথক উপ-তহবিল থাকবে যাতে প্রত্যেক কারখানার উৎপাদনের জন্য সে সে কারখানার শ্রমিকরা সরাসরি উপকৃত হয়।

বাংলাদেশ যদি বছরে ১৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোষাক রপ্তানী করে, আর সকল ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যদি এই প্রস্তাব মেনে নেয় তবে এই তহবিলে প্রতিবছর ১.৮ বিলিয়ন ডলার জমা পড়বে। এর ফলে ৩.৬ মিলিয়ন শ্রমিকদের প্রত্যেকের জন্য বছরে ৫০০ ডলার করে কল্যাণ তহবিলে জমা হবে।

এরকম অর্থ সংগ্রহ করা গেলে এবং তা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা গেলে শ্রমিকদের অনেক দুঃখ লাঘব হবে। অন্যান্য দেশের জন্যও এটা একটা দৃষ্টান্ত হবে। শুধু ৩৫ ডলারের জামাটি ৩৫ ডলার ৫০ সেন্টে বিক্রি করলেই অনেক সমস্যা মিটে যায়।

কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যদি বলে এর ফলে আমার বিক্রি কমে যাবে, আমার লাভ কমে যাবে তাদের আমি বলবো- এর জন্য যাতে আপনার বিক্রি না-কমে, বরং যাতে বাড়ে, সে ব্যবস্থাও করা যায়। আপনার জামায় আমরা একটা ট্যাগ লাগিয়ে দেবো: এতে লেখা থাকবে From the Happy Workers of Bangladesh, with Pleasure. Workers’ wellbeing being Managed by Grameen A_ev BRAC অথবা অন্য কোন আন্তর্জাতিক আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান।

এর সঙ্গে সুন্দর একটা লোগো থাকবে, দেখলেই বুঝতে হবে এই কারখানার শ্রমিকরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে, উষ্ণতার সঙ্গে, এই জামা তৈরি করে দিয়েছে। তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য অতি পরিচিত এবং আস্থাভাজন একটি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়েছে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এটা তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে পারবে।

একজন কনজুমার জামাটি কিনতে গেলেই বুঝতে পারবে তার এই কেনার মাধ্যমে বাংলাদেশের একজন শ্রমিক সুস্থ সুন্দর জীবনের অধিকারী হবার সুযোগ পাচ্ছেন। বিক্রেতা কোম্পানির ওয়েবসাইট এবং বার্ষিক রিপোর্ট থেকে যেকোন জানতে পারবেন তাঁর জামার শ্রমিকদের জন্য কী কী সুযোগ সুবিধা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে করা হচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এতে ঐ জামার বিক্রি বাড়বে, কমবে না।

শ্রমিকরা যে তাঁদের পরিবারের অংশ, এটা দেশি এবং বিদেশি ব্যবসায়ীদের অনুভব করতে হবে। আগের মত ‘ক্রীতদাস তুল্য’ শ্রমিকের দিন শেষ হয়ে যেতে হবে।

আমার প্রস্তাবের সঙ্গে সকল ক্রেতা প্রতিষ্ঠান একমত হয়ে যাবে এমন আশা আমি করছি না। আমি আশা করছি যে দু’ একটি প্রতিষ্ঠান এটা পরীক্ষামূলকভাবে করার জন্য এগিয়ে আসবে। তাদের দেশের সরকার ও শ্রমিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলি, নাগরিক গোষ্ঠী, চার্চ গ্রুপ এটা সমর্থন করার জন্যএগিয়ে আসবে।

সাভারের গণমৃত্যুর প্রেক্ষাপটে এবং পোপের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আরো জরুরিভাবে সকল পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

পোষাক শিল্প বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়াটা আমাদের কাছে যেমন দুঃখজনক হবে, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্যও সমান দুঃখজনক হওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।

যেদেশ তাদের ব্যবসার কারণে গভীরভাবে উপকৃত হতে পারতো, যে-দেশে তাদের কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনগুলি দ্রুত চোখে পড়ার মত হবার সম্ভাবনা সব চাইতে বেশী, সেদেশে কাজ করাটা  আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের কাছে আনন্দদায়ক হবারই তো কথা। যেদেশ তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারতো, সেদেশ থেকে চলে যাওয়াটার মধ্যে কোন সুখ নেই।

সরকার ও নাগরিকরা যদি একজোট হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের যাবতীয় অসুবিধাগুলি দূর করার জন্য এগিয়ে আসে তখন তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা দেশের নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার মধ্যেই থাকবে নতুন প্রজন্মের ব্যবসার আনন্দ। আমরা এই আনন্দ তাদের দিতে চাই। এই আনন্দ উপভোগ করতে তারা এগিয়ে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস।

শুধু যে-ডিজনী চলে গেছে তাদেরকে ফিরিয়েই আনবো না, বরং যারা এখানে এখনো আসেনি তাদেরকেও এখানে আসার জন্য আগ্রহী করে তুলবো আমরা। দুনিয়ার ব্যবসার জগতে পরিবর্তন আসছে। এখনো পরিবর্তনটি ক্ষীণ হলেও সেটা আসছে। আমরা সে পরিবর্তনকে গতিবান করে দিতে পারি। আমাদের কর্মকাণ্ড এবং তার ফলাফল সেই ভিত্তি তৈরি করে দিতে পারে।                  

সাভার বিষয়ক কর্মসূচি
সাভারে যতলোক প্রাণ হারিয়েছে, যাদের অঙ্গহানি হয়েছে, যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিটিজেন্স অ্যাকশন গ্রুপ তাদের একটা পূর্ণাঙ্গ ডাটা-বেস তৈরি করতে পারে এবং ক্রমাগতভাবে আপডেট  করে যেতে পারে।  এটার প্রাথমিক কাজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে করার উদ্যোগ এরইমধ্যে নিয়েছে। অ্যাকশন গ্রুপ এটা সমন্বয় করার দায়িত্ব নিতে পারে।

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এ পর্যন্ত অনেক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, অনেক অর্থ-সংগ্রহ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, এর সর্বোত্তম বাস্তবায়ন কিভাবে হতে পারে এ ব্যাপারে অ্যাকশন গ্রুপ পরামর্শ দিতে পারে। কর্মসূচি মনিটর করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে পারে।

ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগ রেখে তাদের সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য সঠিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে দিতে পারে।

সাভারের কারণে সৃষ্ট অসংখ্য পরিবারের সমস্যা নানাবিধ- তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। বিভিন্ন মেয়াদের, বিভিন্ন ধরনের (স্বাস্থ্য, উপার্জন, লেখাপড়া, ইত্যাদি) সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসার ব্যাপারে দেশবাসীকে উদ্যোগী রাখার জন্য অ্যাকশন গ্রুপকে প্রস্তুত হতে হবে।

আমাদের কি বোধোদয় হবে না?

সাভার সারা জাতির মনে গভীর বেদনা ও বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করে গিয়েছে। এই বেদনা ও ক্ষত আমাদেরকে যেন আমাদের জাতীয় জীবনের মূল সমস্যা সমাধানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তোলে এই কামনা করছি। সাভার আমাদের অপরাজনীতির সৃষ্টি। অপরাজনীতি যে আমাদেরকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলেছে সেটা টেলিভিশনের পর্দার সামনে সাভারে অর্ধ সহস্রাধিক অসহায় মৃত্যু, বহু শত মানুষের অঙ্গহানি আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। তারপরও কি আমরা সবকিছু মেনে যাবো? আমাদের কি বোধোদয় হবে না?

No comments

Powered by Blogger.