ওভাবে অভিযান না চালালে কি চলত না? পিতাকে পুত্র by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
বড় ব্যথিত অশান্ত মন নিয়ে আজ ক’দিন কোনো কিছু করতে পারছি না। কোনো কিছুতে উৎসাহ পাচ্ছি না। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তোমার হত্যার পর যেদিকে তাকাতাম সেদিকেই তোমাকে দেখতে পেতাম। তোমার স্মৃতি চার দিক থেকে ঘিরে রাখত। ধানমন্ডির নৃশংসতা স্বচে দেখিনি, কিন্তু অনুভব করেছি।
আজ ক’দিন ঠিক তেমনি বুকের পাঁজর খান খান হওয়া ব্যথা অনুভব করছি। আমরা এক দিকে সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে শ্রমিকের জীবন বাঁচাতে জীবন দিয়েছি, আজ তিন সপ্তাহ অবিরাম লাশ উদ্ধার চলছে; আবার অন্য দিকে বিরোধী মতবাদের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। এসব দেখে কিছুতেই মন শান্ত থাকছে না। তুমি জানো, এখন যাকে ঘিরে আমার জীবন সেই আল্লাহর দান কুশিমণি। ওর চলন-বলন সব কিছুই আমার কাছে বড় বেশি আনন্দের। ওকে আমি কোনো কিছুতে না করতে পারি না। যেদিন আমার ঘরে এসেছে, সেদিন থেকে ওকে কাঁদতে দেখিনি। আমরা ওকে কাঁদার সুযোগ দেইনি। সারা দিন আমাদের শাসন করে, ছোটাছুটি করে, কলবল করে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। এক মুহূর্ত না থাকলে বাড়িটা ঘুমিয়ে যায় যেন। সেই কুশিমণির প্রতি নজর দিতে পারছি না। কোলে নিয়ে বুকে চেপে রাখতে পারছি না। কিভাবে যেন অন্তরাত্মা, অস্তিত্বের জোর কমে গেছে। মাঝে মধ্যেই অভিযোগ করেÑ সে খেলছে না, ও খেলছে না। আমার বাড়িতে এখন কুশিমণির চেয়ে ছোট কোনো শিশুও নেই। তাই ওর খেলার সাথী নেই। বড়রা ছোটাছুটি করে অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে। দেশের অশান্ত অবস্থায় কুশিমণিও আজ যথেষ্ট অনাদৃত। অথচ ওর মধ্যে আমার জীবন লুকিয়ে। মা যখন চলে গেলেন, তারপর অপ্রয়োজনীয় জগৎ আবার ওরই কারণে প্রয়োজনীয় হয়ে ফিরে এসেছে। সেদিনও ওর মাকে বলেছি, দেশে এমন অবস্থা; কত আগুন, কত ধ্বংস, কত জীবন য়Ñ ওযে এসবের কিছুই বুঝতে চায় না! তোমার-আমার মন ভালো না, তাও বুঝতে চায় না। কী বুঝবে! ছয়-সাত বছরের শিশু তার কী-ই বা বোঝার থাকতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার দুই ছোট ভাই আজাদ ও মুরাদ কুশিমণির মতোই ছিল। মুরাদের সাড়ে ছয়-সাত, আজাদের সাড়ে চার বছর বয়স। সারা দিন খেলাধুলা করত। আমি যুদ্ধ করছি জেনে কাঠ দিয়ে কখনো কলার ডাইগ্যা দিয়ে কামান বানিয়ে বসে থাকতÑ যেমনটা আজ কুশিমণি করে। গত শনিবার বলেছিলাম, আগামীকাল ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি রয়েছে। তাতে যে অমন কিয়ামত হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ ও শাপলা চত্বরের জমায়েতকে কেন্দ্র করে যে ন্যক্কারজনক ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে তা তুলনাহীন। কোনো কিছুর সাথে এর তুলনা চলে না। জনমত বা গণজমায়েত যদি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নিয়ামক হয়, তাহলে হেফাজতে ইসলামের গণজমায়েতকে কোনোক্রমেই সম্মান না দেখিয়ে উপায় নেই; কিন্তু তেমনটি হয়নি। কেউ কাউকে সম্মান দেখায়নি। যাতে করে সর্বোপরি মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। অসংখ্য জীবন নাশ হয়েছে।

আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল গত ৫ ফেব্র“য়ারি শাহবাগের স্বতঃস্ফূর্ত ব্লগারদের জমায়েতকে কেন্দ্র করে। এখন বিজ্ঞানের জমানা। ইন্টারনেটের কল্যাণে ফেসবুকের মাধ্যমে এক চমৎকার সমাজিক যোগাযোগের ত্রে সৃষ্টি হয়েছে। ৫ ফেব্র“য়ারি কাদের মোল্লার বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে প্রথমে কয়েক শ’, পরে কয়েক হাজার, তারপর লাখ এমনকি এটা বলতেই হবে দেশের বিবেককে তারা নাড়া দিয়েছিল। ওর ক’দিন আগে অনেক কম অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসির দণ্ড শুনিয়েছিলেন। তার তুলনায় অনেক বেশি অভিযোগ এনে এবং তার অনেকগুলোই কোর্টে প্রমাণিত হয়েছে বলে বাচ্চু রাজাকারের চেয়ে কাদের মোল্লাকে লঘু দণ্ড দেয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয়, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য পর্দার আড়ালে জামায়াতীদের সাথে কোনো একটা আপস করা হচ্ছে। তাই মানুষ প্তি হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আবালবৃদ্ধবণিতা, অবুঝ শিশু দাবি তোলেÑ ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই।’ কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। শুধু ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। চার-পাঁচ বছরের শিশুরাও রাজাকারের ফাঁসি চাই চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। অত শিশুকণ্ঠে যে ফাঁসির দাবি মানবিক নয়, রাজাকার হলেও সব রাজাকারের যে বিচারে ফাঁসি হবে নাÑ এই সাধারণ সাদা কথাটাও তখন কেউ শুনতে চাইত না।

ক’দিনের মধ্যেই যুক্ত হলো ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ধর্মীয় রাজনীতি চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চলবে না। কোনো ধর্মীয় রাজনীতি আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে এক নয়, এটাও তাদেরকে বোঝানো যাচ্ছিল না। ধর্মীয় রাজনীতি মানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানের রাজনীতি বন্ধ নয়, শুধু মুসলমানের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আমি লিখেছিলাম, যতকাল পৃথিবী থাকবে, যতকাল ইসলাম থাকবে, ততকাল ইসলামী রাজনীতি থাকবে। আল্লাহর পবিত্র ইসলাম আর জামায়াতে ইসলামী এক কথা নয়। গ্রামগঞ্জের মানুষ সাহস পেল। এর আগে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মসজিদে যেতে পারবে কি না, তা নিয়েও তারা শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। গুজব সব সময় বাতাসের আগে চলে। ২২ ফেব্র“য়ারি শুক্রবার জুমার নামাজের পরে কিছুু ইসলামপছন্দ দল নামাজ শেষে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তত দিনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগ আন্দোলনে ভাটা পড়ছিল। ২১ ফেব্র“য়ারি বৃহস্পতিবার তারা সাময়িক বিরতিও দিয়েছিল; কিন্তু শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ইসলামপছন্দ দলগুলো রাস্তায় নামতে গিয়ে কোথাও কোথাও শহীদ মিনার ভাঙল, কোথাও আবার জাগরণ মঞ্চ গুঁড়িয়ে দিলে আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আবুল কালাম আযাদ বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। গণজাগরণ মঞ্চে এবার আওয়ামী সাংস্কৃতিক ঐক্যজোটের নেতা নাসির উদ্দিন বাচ্চুর কর্তৃত্বে নেতৃত্ব চলে এলো। তিনি কী মর্যাদার যোদ্ধা ছিলেন জানি না; তার পাশে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ, মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, ড. মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর জিয়া উদ্দিনের মতো মুক্তিযুদ্ধের মহাবীররা এতিমের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা ময়দান প্রকম্পিত করে ফেলল। কিন্তু সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মহানায়কদের কেউ জিজ্ঞেসও করল না। সাজেদা চৌধুরীর মতো একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নারী যোদ্ধা অবহেলিত হলেন। সত্যের কল বাতাসে নড়ে। ব্লগার নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজাকারের ফাঁসি চাইতে গিয়ে ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করলেন, আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে ন্যক্কারজনক কটূক্তি করা হলোÑ যা একজন মুসলমান হিসেবে কেউ চিন্তাও করে না। নবী হওয়ার আগেই যেখানে আরব জাহানে তার সততা, দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততার জন্য আল আমিন খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন, তার সততা ও বৈবাহিক জীবন নিয়ে এমন সব উক্তি করল যেগুলো কল্পনারও অতীত। এ সময় হঠাৎ করেই এক ব্লগার রাজীব নিহত হয়। রাজীব নিহত হওয়ায় মনে হলো সরকার যেন হাতে চাঁদ পেল। তারা ঘোষণা করলেন, রাজীব দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বাড়ি গেলেন। হত্যার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করলেন। হতেও পারে তারাই দায়ী বা তারাই হত্যা করেছে; কিন্তু কোনো কিছু না জেনে তদন্ত ছাড়া দেশের প্রধান নির্বাহীর এমন কথা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। অথচ তারই ক’দিন আগে বিশ্বজিৎ নামে একটি সাধারণ হিন্দুর ছেলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে প্রশাসনের সামনে দিনদুপুরে নিহত হলো, তাকে দেখতে তিনি যাননি। ইসলাম ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি কটূক্তির কারণে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন বেরিয়ে এলো। ব্লগাররা বলল, রাজীবের ব্লগে অন্যেরা ওই সব কটূক্তি তার মৃত্যুর পর ঢুকিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল দুই তিন মাস আগ থেকেই সে তার ব্লগে কটূক্তি করছিল। জাগরণ মঞ্চ তাদের বিরোধী সবাইকে রাজাকার মৌলবাদী বলা শুরু করে দিলো। অন্য দিকে হেফাজতে ইসলাম ঢালাওভাবে সবাইকে নাস্তিক আখ্যায়িত করল।

এই হলো সূচনা। হেফাজতে ইসলাম ৬ এপ্রিল সব রকম সরকারি বাধার মধ্যে শুক্র ও শনিবার হরতাল থাকাতেও অসাধারণ সমাবেশ করেছিল শাপলা চত্বরে। তারা কথা দিয়েছিলেন, সে কথা রা করে ৫ মের মধ্যে ১৩ দফা দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অনেকে এখন পর্যন্ত তাদের ১৩ দফা ভালো করে পড়েও দেখেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে বয়ান দিলেন। কিছু কিছু দাবি নাকি তিনি মেনে নিয়েছেন। কিছু কিছু দাবি নিয়ে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন। তোমাকে কী বলি পিতা, তোমার কন্যা এখন জগজ্জননী, সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিধর। তাকে ঠেকায় কে? হিন্দু শাস্ত্রে আছেÑ মা কালী যখন জগৎ সংসার ধ্বংসে ব্রতী হয়েছিলেন, তখন দেবতা মহাদেব তাকে থামাতে পথে শুয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ মহাদেবের বুকে দেবী কালীর পা পড়ায় চমকে উঠে থেমে যান। যার প্রতীক হিসেবে কালীমন্দিরে মহাদেবের বুকে পা রাখা খড়গ হাতে দেবী কালীকে এখনো দেখা যায়। দেবী কালীকে থামাতে তবু মহাদেব ছিলেন। কিন্তু এখন তোমার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে থামাবে কে? আগেই বলেছি, ২১ ফেব্র“য়ারি জাগরণ মঞ্চ তাদের আন্দোলনে প্রায় ছুট দিয়েছিল। সেখানে ওলামা-মাশায়েখরা রাস্তায় বেরিয়ে শহীদ মিনার, জাগরণ মঞ্চ ভেঙে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। কারো মঞ্চ ভাঙা, শহীদ মিনার ভাঙা ধর্মের কাজ নয়। এরপর আসে ৬ এপ্রিল ঢাকার লংমার্চ। সরকারি দলকে কেউ হরতাল দিতে দেখেনি। জাগরণ মঞ্চের আহূত হরতাল শুক্রবার রাতে শুরু হয়ে শনিবার সন্ধ্যায় শেষ হয়। সারা জীবন হরতাল দেখেছি, যেকোনো কর্মদিবসে দিনে শুরু হয়ে রাতে শেষ হতে। ডিজিটাল জমানা ডিজিটাল কারবার চলছে। তার মধ্যেও লাখ লাখ লোক নিয়ে তারা সফল লংমার্চ ও সমাবেশ করেছিল। আবার এলো ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি। এ কর্মসূচির অবরোধের অংশ অভূতপূর্ব। কোথাও কোনো ফুলের টোকাও লাগেনি। আমি নিজেও ১১টার দিকে মিরপুর গাবতলী গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম মুসলমান হিসেবে। মুসলমানের ঘরে জন্মেছি, মুসলমান হিসেবে মরতে চাই। নাস্তিকদের সম্পর্কে আমার কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। যারা আল্লাহকে মানেন না, স্রষ্টাকে স্বীকার করেন না, তাদের নিয়ে স্রষ্টা বুঝবেন। সেখানে আমার কী? কিন্তু আমি যে আল্লাহ-রাসূল মানি, সেই আল্লাহ-রাসূল আমার ঈমান-আকিদা, আমার সত্তাÑ তাঁদের প্রকাশ্য অবমাননা মুখবুজে মানতে পারি না। কেউ রাসূলকে গালাগাল করবেন, মুসলমান হিসেবে সেটা মেনে নেবোÑ এটা পাগলেরও আশা করা উচিত না। ওটুকুই আমার প্রতিবাদ। তাই করতে গিয়েছিলাম। এ জন্য নানা কথা শুনেছি। কিছু নারীবাদীরা বলেছেন, শেষ পর্যন্ত আপনিও হেফাজতের ১৩ দফা সমর্থন করলেন? অথচ আমি ১৩ দফার সমর্থনে যাইনি, আমি এক দফার সমর্থনে গিয়েছিলাম। আমার দাবি নাস্তিকদের ফাঁসি চাওয়া নয়। কোনো নাস্তিকেরই আমি ফাঁসি চাই না। দেশের প্রচলিত আইনে সেই নাস্তিকদের বিচার চাই, যারা আল্লাহর রাসূলের অবমাননা করেছে, পবিত্র ইসলামের বিরুদ্ধে গালাগাল করেছে তাদের বিচার চাই, তাদের শাস্তি চাই। সংবিধানের পাতা থেকে আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দেয়া হয়েছে, তা পুনঃস্থাপন চাই। বর্তমান যুগে নারীরা গৃহবন্দী থাকুক, এটা আমার কাম্য নয়। তারা সংযত, পর্দায় সুন্দর পোশাকাশাকে থেকে যেকোনো কাজকর্ম করে সম্মানজনক জীবনযাপন করবেনÑ এটাই আমার কাম্য। তারা থাকবেন মার্জিত, রুচিশীল। তারা অরুচিকর কোনো কাজ করবেন নাÑ এটুকুই আমার প্রত্যাশা।

তোমাকে কী বলি পিতা, সেদিন রাতে এক দলকানা আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধার কন্যা দাবি করে এমন সব কথা বলল, মনে হলো সেই কন্যাই যেন দেশের মালিক। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, তাতে কী যে অহঙ্কার! আমিও যে একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমার কোনো জায়গাই নেই তার কাছে। যুদ্ধে শুধু হুকুম দেইনি, নিজে যুদ্ধ করেছি, অন্যকে করিয়েছি, পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছি। তার পরও আমি কিছু না, তারাই সব। তোমার পদতলে লাধিক অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিÑ যার আর্থিক মূল্য হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। তার পরও দলকানা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যারাই দেশের মালিক-মোক্তার। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা কেউ কিছু না। কী যে অবাক লাগে! কবি নজরুল এক জায়গায় লিখেছিলেন, বাঁশি যদি আর না বাজে। কবি বলে বলছিনে… আমারও কেন যেন অমন বলতে ইচ্ছে করে। বড় অশান্তিতে আছি। ন্যায় ও সত্যের মা-বাবা মারা গেছে বহু আগে। এখন সবাই নিজের প।ে অন্যের পরে ন্যায়কেও কাকের মতো ঠোঁট মুছে অস্বীকার করে। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন কুরআনে বলেছেন, আমি যদি চোখে দেখা সত্যকে না বলি বা অস্বীকার করি তাহলে তিনি তার জন্যও বিচার করবেন। তাই বড়ই বিপদে আছি।

গত ৬ মে দেশে এক কেয়ামত হয়ে গেছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের লাখ লাখ সমর্থক জমায়েত হয়েছিলেন। তাদের সরকার কম্বিং অপারেশনের মাধ্যমে রাজধানী থেকে বিতাড়িত করেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দু’টি হাসপাতালের সামনে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ তিন মাস নাচানাচি করতে পারল; কিন্তু গ্রামগঞ্জের হতদরিদ্র আলেমসমাজ আল্লাহর উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাজধানীতে নিরাপদে একটি রাত কাটাতে পারল না। তোমার কন্যা তাদের কাটাতে দিলো না। জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ বললেন, শহর ছেড়ে চলে না গেলে পরিণতি ভয়াবহ হবে। তার কণ্ঠ শুনে আমার মনে হয়েছিলÑ ইয়াহিয়া খান তোমাকে যে ভাষায় সাবধান করেছিল, আমাদের করেছিল, সৈয়দ আশরাফের বাপকে করেছিলÑ ঠিক সেই একই ভাষায় জনাব সৈয়দ আশরাফ বলছিলেন। তিনি তার কথা রা করেছেন। গভীর রাতে আলো বন্ধ করে কম্বিং অপারেশনের মাধ্যমে হেফাজতের অনুসারীদের বিতাড়িত করেছেন। সরকার বলেছে, একজনও হতাহত হয়নি। কী দতার অপারেশন! বেলা ওঠার আগে শাপলা চত্বরের আশপাশের সব রাস্তা দমকলের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হলো কেন? আর অমন দ অপারেশন যদি হয়ে থাকে, তাহলে মিডিয়াকে প্রচার করতে দেয়া হলো না কেন? দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি  বন্ধ করা হলো কেন? অন্য চ্যানেলগুলোও তো একইভাবে শাপলা চত্বরের অবস্থা বয়ান দিচ্ছিল। তাদের তো বন্ধ করা হয়নি। বন্ধ করা হয়েছে শুধু দুটো টিভিÑ প্রশ্ন তো উঠবেই। এই অনেকগুলো কেনর জবাব আমাদের খুঁজতে হবে। ৫ মে ব্যাপক তাণ্ডবে হকারদের বহু দোকান পুড়ে ছারখার হয়েছে। রাস্তার পাশের অনেক ভবনে আগুন জ্বলেছে। এগুলো প্রকৃতই কারা করেছে, তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। হেফাজতিরা করে থাকলে সে খেসারত হেফাজতিদেরকেই দিতে হবে। সরকারের কথা, সরকারি মাধ্যমের কথা মানুষ বিশ্বাস করছে নাÑ যেমন ’৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করত না। তোমার নামে স্টেডিয়াম ভেঙে চুরমার করেছে। এক খেলোয়াড় মো: ইয়াহিয়া বিবৃতি দিচ্ছেÑ মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখিনি। তোমাকে কী বলব, মুক্তিযুদ্ধের সময় ইয়াহিয়ার জন্ম হয়েছিল কি না, তাও জানি না। হলেও হয়তো মায়ের কোলে ছিল। হেফাজতের যে কর্মীরা গ্রামগঞ্জ থেকে এসেছিল ঈমানি দায়িত্ব পালন করতে তাদের অনেকের ঢাকা চেনা ছিল না। তারা স্টেডিয়ামে ঢুকবে কী করে? কিন্তু স্টেডিয়াম তবিত হয়েছে। তদন্ত করে এসব বের করা দরকার, কারা করেছে। আগামী পর্বে তোমাকে সব জানাবো। তবে হাজার হাজার লাখ লাখ গুলি চালিয়ে যে জমায়েতকে ভাঙা হয়েছে, সেটাকে রাজনৈতিক দতায় মোকাবেলা করা গেলে এক নয়া ইতিহাস রচিত হতো এবং তা করা তেমন কঠিন ছিল না। তাদের নেতা জনাব আল্লামা আহমেদ শফী সরকারের হেফাজতেই ছিলেন। তাকে দিয়ে শুধু একবার বলিয়ে নিলেই হতো তোমরা বাড়ি চলে যাও। তাতে কামান-বন্দুকের কোনো প্রয়োজন হতো না। এই সহজ কাজটি সহজভাবে করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

গত ৫ মে গভীর রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে পুলিশ, বিডিআর, র‌্যাব যৌথ অভিযান চালিয়ে শাপলা চত্বর খালি করার আগ পর্যন্ত ২০০৯ সালে পিলখানা বিডিআর হেড কোয়ার্টারের ঘটনায় সেনাবাহিনীকে অভিযানে অংশ নিতে না দিয়ে তোমার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থ রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করতাম এবং মুক্ত কণ্ঠে সে কথা এযাবৎ বলে এসেছি। কিন্তু ৫ তারিখ ওই নির্দয় অপারেশনের পর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে বিডিআর হেড কোয়ার্টার পিলখানায় যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে দেননিÑ এটা মানতে মন সায় দিচ্ছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাবতে হচ্ছে, নিজের দেশের মানুষের ওপর রক্তাক্ত অভিযান চালিয়ে যিনি সামান্য জায়গার দখল নিতে পারেন তিনি সাধারণ মানুষের জানমালের কথা চিন্তা করে পিলখানায় সামরিক অভিযানের অনুমতি দেননি এমন নয়; পিলখানায় সামরিক অভিযান হতো তার স্বার্থবিরোধী তাই তিনি করেননি। বিষয়টা বড়ই দুর্ভাগ্যের। জানি না কিভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবো। যারা নিহত হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তুমিও একটু দোয়া করো।

No comments

Powered by Blogger.