৬ মে’র গণহত্যা এবং বাংলাদেশের মিডিয়া by মুহাম্মদ আমিনুল হক

গত ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পর শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করে। ৬ এপ্রিলের মতো এ সমাবেশে লাখ লাখ তৌহিদি জনতা ভিড় করে। নানান দলের নানান মতের মানুষ জমায়েত হয়েছিল সেখানে। সবাই সেখানে গিয়েছিল আল্লাহ ও নবীপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে।
তাদের রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ ছিল না। দুনিয়ার অন্য কোনো মোহও তাদের সেখানে ডেকে নেয়নি। মতিঝিলের সমাবেশ নিয়ে টান টান উত্তেজনা দুপুরের আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। সরকারি বাহিনী ও সরকারদলীয় কর্মীরা শাপলা চত্বরে আগত জনতাকে পথে পথে হামলা করেছিল। পল্টন এলাকায় বেলা ১১টা থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় যুদ্ধংদেহী রূপ নিয়ে তারা হেফাজত কর্মীদের ওপর বর্বর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে ২৮ অক্টোবরের মতো লাশের ওপর নৃত্য করতেও দেখা গেছে। এই বর্বরতায় এবার এক ডাইনি মহিলার ভয়াল রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মিডিয়ার কল্যাণে। সরকারি বাহিনী ও সরকারি দলের হাজার হাজার রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ ও অসংখ্য তৌহিদি জনতা আহত এবং ৫-৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনার প্রভাব মতিঝিলের শাপলা চত্বরে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। ক্ষুব্ধ জনতা সরকারের এই বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে শাপলা চত্বরে অবস্থান দীর্ঘায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
হেফাজতে ইসলামের এই অবস্থান ছিল সরকারি বাহিনীর তাণ্ডবলীলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ। তবে তাদের এই অবস্থান ছিল শান্তিপূর্ণ। সবাই মাগরিবের নামাজ পড়ে আল্লাহর নামে জিকিরে মশগুল হয়ে পড়ে। রাত যত গভীর হতে থাকে ততই নেতিয়ে পড়তে থাকে হেফাজত কর্মীদের শরীর। সারাদিন অবরোধ কর্মসূচি, মিছিল-মিটিং করা ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত মানুষগুলো অজানা আশঙ্কা নিয়ে রাস্তায় ঘুমিয়ে গেলেন। কেউ কেউ ছিলেন তাহাজ্জুদ নামাজে ব্যস্ত। সারাদেশের গাঁও-গ্রাম থেকে সহজ সরল আল্লাহপন্থী এই মানুষগুলো কখনও ভাবতে পারেনি তাদের জন্য কোনো হায়েনা অপেক্ষা করছে। তারা কখনও কল্পনাতেও নিতে পারেনি নিজ দেশের সরকার তাদের ওপর নৃশংস কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু না, তাদের কল্পনাকে হার মানিয়ে আর গোটা জগত্বাসীকে অবাক করে তাদের ওপর নেমে এলো ইতিহাসের নির্মম নৃশংসতা। মুহূর্তেই নিষ্পাপ, পবিত্র, অসহায় আলেম-ওলামা, হাফেজে কোরআনের পিনপতন নীরবতা কেড়ে নিল সরকারি বাহিনীর বুলেটের আওয়াজ। যে শাপলা চত্বর কিছুক্ষণ আগেও পবিত্র মানুষের পদভার আর আল্লাহ আল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত ছিল, সেই শাপলা চত্বরে বয়ে গেল রক্তের বন্যা। ফেসবুকে অসহায় ওইসব নিরস্ত্র মানুষের নিথর দেহ দেখে কোনো পাষাণ হৃদয়ও চুপ থাকতে পারেনি। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেছে খোদাভীরু মানুষের বীভত্স চেহারা দেখে। যারা মানুষকে কোরআন-হাদিসের শিক্ষা দেন, সমাজকে সুখী-সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে যারা খেয়ে না খেয়ে রাত-দিন খেটে যাচ্ছেন—সেসব পবিত্র আত্মাগুলোও নিজ দেশের কোনো বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হবে কেউ তা কল্পনাতেও আনতে পারেনি। এরই মধ্যে ওই হত্যাযজ্ঞকে ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হায়েনাদের নির্মম আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করেছেন কেউ কেউ। বিএনপি এই গণহত্যাকে ঔপনিবেশিক ভারতের কুখ্যাত ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের’ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে এর আন্তর্জাতিক তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচার দাবি করেছে। ৬ মে’র ওই কালো রাতে আসলে কতজন শহীদ হয়েছেন তার হিসাব এখনও কেউ দিতে পারেনি। কেননা ওই অভিযান চলেছিল লাইট নিভিয়ে, মিডিয়া সেন্সর করে। হেফাজতের নেতারা ও বিভিন্ন মহল আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ নিহত এবং দশ হাজারের ওপর আহত হওয়ার দাবি করেছেন। তবে সত্য কখনও চাপা দিয়ে রাখা যাবে না, অদূর ভবিষ্যতেই নিহত হওয়া মানুষের সংখ্যা পাওয়া যাবে; তাদের লাশ পাওয়া যাক আর না-ই যাক। এই হিসাব পাওয়াটা মোটেও দুষ্কর নয়। এরই মধ্যে হেফাজতের পক্ষ থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সরকার যতই বলুক ওই রাতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, তা কেউ বিশ্বাস করছে না। কারণ বিভিন্ন মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ ও স্থির চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, যা থেকে গণহত্যার আলামত সুস্পষ্ট বোঝা যায়। শান্তিপ্রিয় ইসলামপন্থী ইবাদতরত জনগণের ওপর এই বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানানোর ভাষা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা নির্বাক। আমাদের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। এই নির্মমতার বিচার এই মুহূর্তে একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে চাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো কালের কোনো প্রতাপশালী টিকে থাকতে পারেনি। আদ, সামুদ, নমরুদ, ফেরাউনের পরিণতির ফিরিস্তি এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। এখন তারা শুধু ইতিহাস। বর্তমান সময়ে সাদ্দামের পরিণতি, লৌহমানব কর্নেল গাদ্দাফি, মিসরের হোসনি মোবারক, তিউনিসিয়ার বেন আলিদের পতনও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—ইতিহাস কাউকে ছাড়ে না। কিন্তু তারপরও আমাদের বোধোদয় হয় না। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি না। সরকারকে শুধু এতটুকু বলব, বুলেট দিয়ে গণমানুষের প্রকৃত জাগরণ থামানো যায় না। এদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান, তাদের চিন্তা-চেতনা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বেশিদিন টিকে থাকা দুরূহ হবে। বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা দি ইকোনোমিস্ট ্তুইধহমষধফবংয ারড়ষবহপব ড়হ ঃযব ংঃত্ববঃ্থ শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের গতি-প্রকৃতির ওপর গবেষণা করা হয়। সামাজিক জীবনে ধর্মের প্রভাব নিয়ে পিউ ফোরামের এই গবেষণায় দেখা গেছে, আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের শতকরা ৮২ ভাগ মুসলমান সরকারিভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়নের পক্ষে। আমাদের ধারণাও তাই। সরকার বিশ্বাস না করলে গণভোট দিয়ে দেখতে পারে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মিডিয়া এখন ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করেছে। এতদিন আমরা সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ এবং গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করতাম। আমাদের অধিকাংশ মিডিয়া বোধ হয় তাদের পুরনো অভিধা হারিয়ে ফেলেছে। সাংবাদিকরা দল-মতের ঊর্ধ্বে নন এটি অনিস্বীকার্য। কিন্তু তাই বলে মানবতার বিরুদ্ধে মিডিয়া দাঁড়াতে পারে? এদেশের মিডিয়ার একপেশে আচরণ সম্পর্কে কয়েক হাজার ফিরিস্তি তুলে ধরা যাবে যা এখানে তুলে ধরা যাবে না। হেফাজতে ইসলামের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর গণহত্যার রিপোর্টের চেয়ে শাপলা চত্বরের সবুজ গাছপালার সৌন্দর্য হারিয়ে যাওয়াকে নিয়ে যেসব সাংবাদিক রিপোর্ট করে, তাকে কী বলব আমরা? হাজার মানুষের প্রাণের দাম বেশি নাকি কয়েকটি গাছের দাম বেশি? একজন হেফাজত কর্মীর গুলতি ছোড়াকে যারা তাণ্ডব বলে নিউজ করেন তারা কি লাঠি দিয়ে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যার দৃশ্যকে দেখেন না? বায়তুল মোকাররমের দোকানগুলোতে কারা আগুন লাগাতে পারে তা আমাদের কাছে বোধগম্য হলেও ওইসব জ্ঞানপাপী সাংবাদিকের বোধগম্য হয় না। সত্যি কথা বলতে কী, এদেশের অধিকাংশ মিডিয়া দুঃখজনকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। মুসলমানদের ওপর যত গণহত্যা চালানো হোক না কেন তাতে তাদের মানবতাবোধ মোটেও জাগ্রত হয় না। উল্টো বরং মার খাওয়া নিপীড়িত মজলুম মানুষের ত্রুটি ধরতেই ওরা সিদ্ধহস্ত। এজন্য কোটি মানুষের জাগরণকে তারা ষড়যন্ত্র মনে করে। আর শ’ কয়েক নাস্তিকের জটলাকে তারা মনে করে মহাজাগরণ! শাহবাগি রাজিব খুন হওয়ার পর যারা একের পর এক অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করতে পেরেছে, তারাই ৬ মে’র কালো রাতে ঘটে যাওয়া নির্মম গণহত্যাকে ‘দশ মিনিটের সফল অভিযান’ নামে রিপোর্ট করেন, হেফাজতি কর্মীদের অসহায় আত্মসমর্পণ বলে নিউজ করে আনন্দ পান। ফেসবুক, টুইটার এমনকি আল-জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন নৃশংসতার প্রামাণ্য রিপোর্ট করতে পারলেও বাংলাদেশের তথাকথিত সাংবাদিকরা তা করতে পারেন না।
যে দেশের সরকার ও মিডিয়ার লোকজন একাকার হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার হরণের উল্লাসে মেতে ওঠে, সে দেশের ভবিষত্ কী হবে তা অনুমান করতে পারছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমাদের ভবিষ্যত্ খুব অন্ধকার। শত আশঙ্কার মধ্যেও আশাজাগানিয়া খবর হচ্ছে, একদল যুবক নানা অপপ্রচারের মাঝেও দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে কাজ করা শুরু করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে তারা ব্যবহার করছে। আজকাল ফেসবুকের মাধ্যমে অজপাড়া গাঁয়ের ছেলেমেয়েরাও আসল নিউজটি জেনে নিচ্ছে। আসমানে আল্লাহ আর জমিনে ওরাই এখন বাংলাদেশের প্রধান ভরসা।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.