ব্রাহ্মণবাড়িয়া লণ্ডভন্ড নিহত ২০, আহত ৫০০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ টর্নেডোর আঘাতে লণ্ডভন্ড হয়ে গেছে ২০টি গ্রাম। এতে শিশুসহ ২০ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক। জেলা সদর হাসপাতালে আহতদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের।
রাত ১টায় কুমিল্লা থেকে ৫৪ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেছে। যার নেতৃত্বে দিচ্ছেন লে. কর্নেল মশিউল মনির। জেলার তিনটি উপজেলায় ১৫ মিনিটের টর্ণেডোর ছোবলে কাঁচা ঘরবাড়ি ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়। ধারণা করা হচ্ছে, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। রাত  দেড়টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জেলা প্রশাসক নূর মোহাম্মদ মজুমদার ২০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। নিহত যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন- জেলা কারাগারের কারারক্ষী মাসুদুর রহমান (২৫), সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের আবু তাহের মিয়া (৬০) ও চিনাইর গ্রামের ঝানু চৌধুরী (৫২), বিজয়নগরের পত্তন গ্রামের লাভলী বেগম (৩৫) ও ডলি রাণী দে (২৭) এবং আখাউড়ার জারুইতলা গ্রামের জয়নাল মিয়া (৩২) ও সুমি বেগম (১০)। বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতদের ৩ হাজার টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। ঘটনার পর থেকে কুমিল্লা সিলেট মহাসড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ঘটনার পরপরই গ্রামবাসী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। বিকাল থেকে আক্রান্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।  প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বিকাল ৫টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিভিন্ন স্থানে বড় আকারের শিলাবৃষ্টি হয়। এর কিছুক্ষণ পর টর্নেডোর তাণ্ডব শুরু হয়। সদর উপজেলার রামরাইল, মাছিহাতা, সুলতানপুর, চিনাইর, আজমপুর, খরমপুর, আহমেদাবাদ, সিঙ্গারবিল, পত্তনসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে ভয়াবহ টর্নেডো আঘাত হানে। এসময় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের যানবাহনের উপর গাছ উপড়ে পড়লে একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এছাড়া বহু সিএনজিসহ বিপুল সংখ্যক গাড়ির উপর গাছ ভেঙ্গে পড়ে। এতে বাসযাত্রীরা গুরুতর আহত হয়। ঝড়ে সুলতানপুর ইউনিয়নের উড়শীউড়ায় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক থেকে বেশ কয়েকটি গাড়ি রাস্তা থেকে সিটকে যায়। সেখানে জেলা কারাগারের একপাশের দেয়াল ভেঙে পড়লে আহত হয় অনেক মানুষ। এ সময় কারাগারের পাগলা ঘণ্টা বাজতে থাকে। কারাগারের ভেতরে নিরাপত্তা চৌকিও ভেঙে গেছে। উড়িয়ে নিয়ে যায় কারা অভ্যন্তরের মসজিদ। কারাগারের নিরাপত্তায় বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। উড়শীউড়া গ্রামের হুমায়ুন কবির জানান, হঠাৎ করেই আকাশে কালো ধোঁয়া দেখতে পান। তিনি তখন উড়শীউড়া বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার মোটরসাইকেলটি উড়িয়ে নিয়ে ফেলা হয় কয়েক’শ গজ দূরে। ৩ মিনিটের মতো স্থায়ী হয় এই তাণ্ডব। হুমায়ুন যে দোকান ঘরে আশ্রয় নেন সেটিও উড়িয়ে নেয়া হয়। এই গ্রামে থাকা জেলা কারাগারটির পেছনের দেয়াল পুরোপুরি ধসে পড়েছে। টর্নেডোর সময় কাগজের মতো ঘরের বেড়া-চালা উড়ে যেতে দেখা যায়। উড়শীউড়ার কমপক্ষে ৫ শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে হুমায়ুন জানান। পাশের ফুলবাড়িয়ার ক্ষয়ক্ষতিও অনেক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের চিকিৎসক আবু সাঈদ জানান, লাভলি ও ডলিসহ চারজনকে হাসপাতালে আনার পর জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। অজ্ঞাত পরিচয় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন। আখউড়া হাসপাতালে নিহত হয়েছেন পাঁচ জন।  জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আবু সাঈদ এবং আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো: শাহ আলম এই মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া অন্তত কয়েকশ’ লোক আহত হয়েছেন বলে জেলা প্রশাসক জানান। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক নূর মো. মজুমদার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন চাকমাসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান।
অবিশ্বাস্য তাণ্ডব
আখাউড়ার আজমপুর গ্রামের বাসিন্দা সাব-রেজিস্ট্রার রমজান খান নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেন টর্নেডোর মুহূর্তটি। বলেন, বিকাল তখন সোয়া ৫টা হবে। হাবলা উচ্চ গ্রামের পশ্চিম দিকে লক্ষ্য করি হাতির সুরের মতো একটি কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি তীব্র  বেগে এগিয়ে আসছিল। সঙ্গে উড়ছে মানুষের কাপড়-চোপড় এবং গাছের পাতা। তখন লু-হাওয়াও ছিল। এই হাওয়া যার শরীরে লেগেছে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন দেখে আমরা কোরআন শরীফ পড়তে শুরু করি। আমাদের আখাউড়া প্রতিনিধি শাহাদৎ হোসেন লিটন চান্দি, বুধল, চিনাইর, জারুইলতলা, পাইকপাড়া, বাসুদেব, আখাউড়ার আহমদাবাদ ঘুরে জানিয়েছেন এসব এলাকার শতকারা নব্বই ভাগ বাড়িঘর নেই। শুধু বিল্ডিংগুলো আছে। কাঁচাবাড়ি ঘর সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভাতশালা রেলস্টেশনটি পুরোপুরি উড়ে গেছে। চিনাইর বাজারের কোন কাঁচা দোকানপাট আস্ত নেই। বিদুৎতের খুঁটিগুলো পড়ে গেছে। ধুবলার চরে পাকা রাস্তা পর্যন্ত উঠে গেছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণসহায়তা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টর্নেডোর আঘাতে নিহতদের পরিবার প্রত ২০ হাজার টাকা এবং পরিবার প্রতি ২০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া আহত ও যাদের ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাদের ঘর নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় টিন এবং প্রতি বান টিনের সঙ্গে আহতদের জনপ্রতি তিন হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর শোক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টর্নেডোতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এছাড়া আহতদের যথাযথ চিকিৎসা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে খাদ্য ও পোশাকসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়ার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী টর্নেডোতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার শোক
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টর্নেডোর আঘাতে নিহত এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। দলের সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি স্বাক্ষরিত এক বার্তায় এ শোক প্রকাশ করেন তিনি। বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল, উশীউড়া ও আখাউড়ায় টর্নেডোর প্রচণ্ড আঘাতে দশজন নিহত, তিন শতাধিক আহত ও পাঁচ শতাধিক ঘড়বাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ায় আমি গভীরভাবে শোকাভিভূত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণের প্রতি আমি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। খালেদা জিয়া নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।  পৃথক বার্তায় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শোক প্রকাশ করেন।

No comments

Powered by Blogger.