অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আয়োজন

বিরোধ নেই জুয়া আর অশ্লীল নৃত্যে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বৈরী রাজনৈতিক সম্পর্কের ছাপ পড়েনি এখানে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার এক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা মিলেমিশেই আয়োজন করেছেন আনন্দমেলার।
শুধু তারাই নয় মেলা নিয়ে মুখ বন্ধ প্রশাসনসহ সকল মহলের। প্রতিরাতে দু’-লাখ টাকা বখরা বিতরণ হচ্ছে। আর তাতেই এলাকার লোকজনের সকল অভিযোগ চাপা পড়েছে। আখাউড়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের জন্য জায়গা ক্রয় আর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের নামে গত দু’-সপ্তাহ আগে সেখানে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা আনন্দমেলা। এই মেলা পরিচালনায় রয়েছে স্থানীয় ২৫ জন প্রভাবশালীর একটি কমিটি। এর সভাপতি হয়েছেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা আলহাজ আবদুল হান্নান ভূঁইয়া (স্বপন)। সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. শাহীন খানকে। এলাকার লোকজনের অভিযোগ, নানা রকম জুয়া আর রাতভর নগ্ননৃত্য এই মেলার পুঁজি। কিন্তু মেলার মদতদাতা স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ প্রভাবশালীরা হওয়ায় ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। আর যাদের মুখ খোলার কথা উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সাংবাদিক-তাদের মুখ বন্ধ প্রতিদিনের বখরার লোভে। মেলা সূত্রই জানিয়েছে, মেলা পরিচালনা কমিটিকে প্রতি রাতে মাসোহারা হিসেবে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। এই টাকার মধ্যে ৫০ হাজার টাকা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের তহবিলের নামে রাখা হয়। বাকি টাকা বণ্টন করা হয় প্রভাবশালীদের মধ্যে। তাছাড়া আরও প্রায় লাখ টাকার মতো স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও কথিত কিছু সংবাদকর্মীদেরও বণ্টন করে দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণে সীমান্ত থেকে আধা কিলোমিটার দূরে এই মেলা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কার পাশাপাশি এলাকায় চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে এলাকার মানুষের। কিন্তু ক্ষুব্ধ মানুষ প্রভাবশালীদের ভয়ে মুখ খোলার যেমন সাহস পায় না তেমনি প্রশাসনও প্রতিকার করে না এসবের। খোঁজ নিয়ে এবং সরজমিনে দেখা গেছে নামমাত্র সার্কাসের পর রাতভরই মেলায় চলে সিনেমার এক্সট্রাদের নগ্ন নৃত্য। বসানো হয়েছে নানা রকম জুয়ার বোর্ড। সেখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সব বয়সী মানুষ। আছে হাউজি খেলা, সার্কাস। এই সার্কাসের বদলেই চলে নগ্ননৃত্য। মেলার প্রধান আকর্ষণই জুয়া আর নগ্ননৃত্য। জুয়া খেলতে দূর-দূরান্ত থেকে গাড়ি ভরে আসছে জুয়াড়িরা। স্থানীয় অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রও মেলায় ভিড় জমাচ্ছে নগ্ননৃত্য দেখতে। মাইকের শব্দে নীরবতা ভাঙছে অনেক দূর পর্যন্ত। স্থানীয় ঋষিপাড়ার লোকজনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে মেলার মাইকের শব্দে। কিন্তু তারা ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। একজন স্কুল শিক্ষক জানান, সারারাত এখানে অবাধে জুয়া খেলা চলার কারণে এলাকায় চুরি, ছিনতাই বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিরাতেই চুরির ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া এইচএসসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে এলাকায় এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডে পরীক্ষার্থীদেরও চরম ক্ষতি করছে। জানা গেছে, মেলায় প্রতি রাতে অর্ধ কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়ে থাকে। হাউজি, ওয়ান-টেন, চরকি, ডাব্বা, তাস সহ নানা ধরনের জুয়া খেলার ব্যবস্থা রয়েছে মেলায়। মেলা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিএনপি নেতা মো. শাহিন খানের কাছে মেলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শুরুতেই বলেন, মেলার অবস্থা ভালই। সার্কাস, হাউজি-বাম্পার-সবই তো আছে। ঢাকা থেকে চলচ্চিত্রের শিল্পীরা আসে। তারপরও মেলার আয়োজকরা বলে তাদের নাকি লস হচ্ছে। তিনি জানান, রাত ১০টার পর তিনি মেলা থেকে চলে আসেন। এরপর কি হয় তা বলতে পারেন না। মেলার কমিটি থাকলেও চেয়ারম্যান শুধু স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা দেখার দায়িত্বই পালন করেন বলে জানান শাহিন। বাকি দায়দায়িত্ব অর্থাৎ প্রশাসন, থানা-পুলিশ, বিভিন্ন সংস্থা, সাংবাদিক সব ম্যানেজ করার দায়িত্ব মেলা যারা মূলত চালায় তাদের। মেলার মূল মালিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের হিরন মিয়া বলে জানান তিনি। মেলার আরেকজন অন্যতম পরিচালক বিজয়নগর উপজেলার কাশিনগর গ্রামের মানিক মিয়া। আখাউড়া উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ আবদুল হান্নান ভূঁইয়া (স্বপন) বলেন মুক্তিযোদ্ধারা মেলা দিচ্ছে। পরিষদের জন্য জায়গা ক্রয় করার টাকা তিনি মেলা থেকে নিচ্ছেন বলে স্বীকার করেন। মেলায় অশ্লীল ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমি ঢাকায় আছি। এসব বিষয় জানি না। আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বশিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, মেলার অনুমতি দেন জেলা প্রশাসক। কিছু শর্তসাপেক্ষে মেলার অনুমতি দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে জুয়া খেলা হবে না, অশ্লীল নাচ-গান করতে পারবে না। নানা অনৈতিক কাজে এই মেলা ভরপুর বলে তাকে জানানোর পর তিনি বলেন, আমরা যখন যাই তখন এসব দেখি না। তিনি উপজেলা প্রশাসন বা উপজেলা পরিষদের নামে টাকা নেয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন। বলেন, আমরা কেউই এখান থেকে কোন সুবিধা নেই না। তবে থানা পুলিশের বিষয়টি আমার জানা নেই।

No comments

Powered by Blogger.